২০০৮ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সেদিন অনেকেই অলীক স্বপ্ন বলে মশকরা করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছে।
২০১৬ সালে ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ শীর্ষক কর্মসূচি শুরু হয়। গত ২১ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার ঘোষণার মধ্য দিয়ে যা সফল বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ হয়। দুর্গম চরাঞ্চল থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো। বাংলাদেশ আজ শতভাগ বিদ্যুতায়নের দেশ।
একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বিদ্যুৎ ছাড়া কল্পনা করা যায় না। বর্তমান সরকারের সময়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছেছে বাংলাদেশ, তার পেছনে বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম প্রধান অবদান রয়েছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত মাত্র ৪৭৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সীমিত সম্পদ নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-৭৫ এই স্বল্পতম সময়ে আশুগঞ্জ, ঘোড়াশাল ও সিদ্ধিরগঞ্জে তিনটি পাওয়ার হাব প্রতিষ্ঠা করেন। তার আগে শুধুমাত্র কাপ্তাই জল বিদ্যুৎকেন্দ্রটিই ছিল বাংলাদেশের সম্পদ।
কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের অপরিসীম গুরুত্বের বিষয় তুলে ধরে ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘বিদ্যুৎ ছাড়া কোনো কাজ হয় না, কিন্তু দেশের জনসংখ্যা শতকরা ১৫ ভাগ লোক যে শহরের অধিবাসী সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থা থাকিলেও শতকরা ৮৫ জনের বাসস্থান গ্রামে বিদ্যুৎ নাই। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করিতে হইবে। ইহার ফলে গ্রাম বাংলার সর্বক্ষেত্রে উন্নতি হইবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ চালু করিতে পারিলে কয়েক বছরের মধ্যে আর বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানি করিতে হইবে না।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর অন্য সবকিছুুর মতোই বিদ্যুতের উন্নয়নও থমকে যায়।
এক সময় বিদ্যুৎ খাত ছিল সম্পূর্ণ সরকার- নির্ভর খাত, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সেজন্য জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে বিদ্যুৎ খাত ছিল দুর্নীতির অভয়ারণ্য। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এ সময় বিদ্যুৎ খাত বেসরকারি মালিকানার জন্য উম্মুক্ত করা হয়। সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে দেশি-বিদেশি অনেক বিনিয়োগ আসে। কিন্তু আবার সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে বিদ্যুৎ খাতেও ছন্দপতন ঘটে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছিল দেশের বিদ্যুৎ খাত। বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান এ খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করেন। তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ‘খাম্বা লিমিটেড’ বিদ্যুতের বদলে শুধু খাম্বা বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যাপক দুর্নীতি করে। সেসময় বিদ্যুতের এতটাই লোডশোডিং ছিল যে, মানুষ কখন বিদ্যুৎ গেছে সেটা না বলে বলতো কখন বিদ্যুৎ এসেছে। বিদ্যুতের এতটাই বেহাল অবস্থা ছিল যে, মানুষ আলোর চেয়ে অন্ধকারেই বেশি থাকত।
বিএনপি সরকারের সময়ে বিদ্যুতের দাবিতে জনগণকে জীবন দিতে হয়েছে। ২০০৬ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু হলে পুলিশের গুলিতে ২০ জন নিহত ও শতাধিক লোক আহত হয়। ঠিক একই সময়ে ঢাকার শনির আখড়ায় বিদ্যুতের দাবিতে রাস্তায় নেমে সহিংস বিক্ষোভ করে এলাকাবাসী। বিক্ষোভ নস্যাৎ করতে গিয়ে তখনকার স্থানীয় সংসদ সদস্য সালাহউদিন আহমেদ জনরোষে জীবন বাঁচাতে দৌড়ে পালিয়ে যান। তখন থেকে তিনি ‘দৌড় সালাউদ্দিন’ হিসেবে পরিচিতি পান।
বর্তমান মেয়াদে দেশরতœ শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সাল থেকেই মূলত বিদ্যুৎ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাত এগিয়ে আসার কারণে দ্রুতই বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি হতে থাকে। বর্তমানে দেশের মোট বিদ্যুতের ৪৩ শতাংশ বেসরকারি খাতে উৎপাদন হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে উৎপাদন হচ্ছে আরও ৬ শতাংশ। মোট প্রায় ৫০ শতাংশই বেসরকারি মালিকানা। সেদিন যারা এই কুইক রেন্টালের বিরোধিতা করেছিল তাদের কথা শুনলে আজও বাংলাদেশকে অন্ধকারেই থাকতে হতো।
পাওয়ার সেলের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা হয়েছে ১৫০টি। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে হয়েছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। তখন দেশে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। বর্তমানে গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ২১ লাখ। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬০ কিলোওয়াট ঘণ্টা।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর অঙ্গীকার মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে অনেক বড় বড় নদী, সাগর মোহনায় আছে অসংখ্য দ্বীপ ও লোকালয়। সেসব স্থানে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়াও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। শরীয়তপুরের চর আত্রা, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি, ভোলার চরকুকরিমুকরি, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মতো স্থানগুলোয় বিদ্যুৎ পৌঁছাতে সাবমেরিন কেবল প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হয়েছে। সাগরের তলদেশ দিয়ে ১৫ কিলোমিটার সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করে সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। যেসব দুর্গম জায়গায় কোনোভাবেই বিদ্যুৎ লাইন নেওয়া সম্ভব হয়নি সেখানে সোলার প্যানেল স্থাপন করে বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা হয়েছে।
গত ২১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন। এটি চালুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ১৩তম দেশ হিসেবে আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল ক্লাবে প্রবেশ করছে। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এশিয়ায় সপ্তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র ভারতে এ ধরনের আর একটি মাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। ওয়ার্ল্ড এনার্জি কাউন্সিলের প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড এনার্জি ট্রিলেমা ইনডেক্স ২০২০-এর তথ্য মতে, জ্বালানি খাতের দ্রুত উন্নয়ন করছে এমন শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।
বর্তমান সরকার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৪ হাজার মেগাওয়াট, যা লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেও ছাপিয়ে গেছে। পরবর্তী লক্ষ্য ২০৩০ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা। সে লক্ষ্যকে টার্গেট করে এগিয়ে চলছে মেগা প্রকল্প। রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, মাতারবাড়ি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় রূপপুরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আরও অনেক প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ আজ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। একযুগ আগেও যে সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৭ শতাংশ। এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। পটুয়াখালীর পায়রায় তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন ও শতভাগ বিদ্যুৎ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওয়াদা করেছিলাম প্রতিটি মানুষের ঘর আলোকিত করব। প্রতিটি মানুষ আলোকিত হবে। আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছি।’ আজ দেশের প্রতিটি ঘর আলোকিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে আরেকটি ধাপ এগিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা তাঁর প্রতিটি ওয়াদা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছেন বলেই বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির পথে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।
লেখক : সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা