কথার কথকতা
–মাইন উদ্দিন আহমেদ
আজকের লেখার বিষয়বস্তু হচ্ছে অন্তর, মন, হৃদয় ইত্যাদি। পাঠকবৃন্দকে সাথে নিয়ে এই তিনটা শব্দের গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করবো আমরা। সত্যি কথা বলতে কি, এই তিনটা শব্দের বিষয়বস্তুর অবস্হান এবং সত্যতা নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে এগুলো বাস্তবতার নিরিখে আবিস্কারের চেষ্টা করা হবে।
অন্তর শব্দের অর্থ খুঁজতে গিয়ে সমার্থক যে শব্দগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে হৃদয়, মন, ফাঁক, তফাৎ, শেষ, পার্থক্য ইত্যাদি। তবে অন্তর নামক কোন অংগ-প্রত্যঙ্গ মানব শরীরের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেটা গুরুত্ত্বের সাথে লক্ষ করা গেছে তা হলো শব্দটির অর্থ তালিকায় হৃদয় ও মন এই দুটো শব্দ পাওয়া গেছে যেগুলো আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়েরও অন্তর্ভুক্ত।
আসুন, দেখি মন কি এবং তা কোথায় পাওয়া যায় আর কোথায়ইবা বাস করে। মনকে খুঁজলাম ইন্টারনেটে। জানা গেলো, “চিন্তার সমষ্টিকে মন বলা হয়। চিন্তা ছাড়া মনের কোন অস্তিত্ত্ব নেই।”
শরীরের বিভিন্ন অংশের দিকে তাকিয়ে খোঁজাখুজি করে দেখলাম, মন নামের কোন অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ পাওয়া যায়নি। মনের সাথে দেহের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করে সবাই আবিষ্কার করলো, “মস্তিষ্ক ও অন্তরের সংযোগ স্হাপনকারী হচ্ছে মন।” শরীরে কোথাও আমরা অন্তর বা মন কোনটাই খুঁজে পেলামনা। তবে একটা দিক নির্দেশনা পেলাম এই মর্মে যে, “আমরা প্রতিনিয়ত যা দেখি বা শুনি বা পড়ি সবকিছু আমাদের ব্রেনের মধ্যে রেকর্ড হতে থাকে।”
এবার আমরা হৃদয়-এর সন্ধান করবো। অন্তর এবং মন খুঁজে পাওয়া যায়নি শরীরের মধ্যে। দেখা যাক হৃদয়ের খবরাখবর কি।
ইন্টারনেটে দেখা গেলো দুটো প্রশ্ন: “মন আর হৃদয় কি একই জিনিস? যদি একই হয় তাহলে দুই নামে ডাকা হয় কেনো?” আরেকটা প্রশ্ন পাওয়া গেলো এই মর্মে যে, “হৃদয় কি মন না কি হৃৎপিন্ড?” হৃৎপিন্ড শব্দটা আমরা সাধারনতঃ হৃদপিন্ড লিখে থাকি। হৃদপিন্ডকেই আমরা হৃদয় নামে ডাকি। হৃদয় শব্দটির ব্যবহার হয় অহরহ। মানুষ হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে। প্রিয়জনকে স্হান দেয় হৃদয়ের মনিকোঠায়। হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা নিবেদন করি আমরা। বিরহ বেদনায় আমাদের হৃদয় ভেংগে চৌচির হয়ে যায়। প্রেমাষ্পদের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলেও তার ছবিটি হৃদয়ে অংকিত বা খোদিত হয়ে থেকে যায়। আসুন, দেখি হৃদয় জিনিসটা কি। আমরা ইংরেজী হার্ট শব্দের বাংলা অর্থ পাই হৃদয় এবং হৃদপিন্ড। এর কাজ কি, এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা জানলাম, ইন্টারনেটে উইকিপেডিয়া বলছে, হৃদপিন্ড সমগ্র শরীরে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত সঞ্চালন করে।
হৃদয় বা হৃদপিন্ড সমগ্র শরীরে প্রেম-ভালোবাসা সঞ্চারিত করে কিনা তা জানতে চাইলে আমরা কোন উত্তর পাইনি। ইংরেজী ভাষায়ও আমরা হার্ট-এর কাজ নিয়ে প্রশ্ন করে উত্তর যা পেয়েছি তার অর্থ হলো হার্ট, হৃদয় বা হৃদপিন্ড পাম্প করে সমগ্র শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে। মগজ থেকে পা পর্যন্ত সর্বত্র পাম্প করে রক্ত পাঠানোর কারনে আমরা বেঁচে থাকি নাহলে রক্ত জমাট বেঁধে বা দুষিত হয়ে মানুষ মরে যেতো। হৃদয় বা হৃদপিন্ডের রক্ত সঞ্চালনের কাজ সম্পর্কে কোন দ্বিমত নেই কিন্তু প্রেম-ভালোবাসায় এর ভূমিকা সম্পর্কে বাস্তববাদী মানুষেরা খুবই বিরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁদের মতে হৃদয় সম্পর্কে অজ্ঞতা মানুষকে রোমান্টিক করে তোলে। একটা মানুষ যখন বিশ্বাস করে, হৃদয় প্রেম ছড়ায় তখন তিনি অজ্ঞতা এবং আবেগের গভীর স্তরে নিমজ্জিত থাকেন আর যখন তিনি জ্ঞান আহরন করেন তখন বলেন, এটি মানব দেহে রক্ত সঞ্চালন করে দেহটি বাঁচিয়ে রাখে, আমি নামক অবস্তুগত সত্ত্বাটিকে সচল রাখে। হৃদয় বা এর মনিকোঠার সন্ধান কোন বিজ্ঞ মানুষের কাছে পাওয়াই গেলোনা। আবেগী মানুষ বুকে হাত দিয়ে বলে, “ওকে হারিয়ে আমার হৃদয় ফেটে যাচ্ছে” আর ডাক্তার বলেন, “জীবন যাপনে অনিয়ম করার কারনে ওনার হার্ট এটাক হয়েছে, এটি দেহে সঠিকভাবে ব্লাড সার্কুলেট করছেনা”। তাহলে আসল কথা এই দাঁড়াচ্ছে যে, আমরা প্রেমানুভূতি সম্পন্ন হৃদয়কে মানব দেহে খুঁজে পাচ্ছিনা, পাচ্ছি সমগ্র দেহে রক্ত সঞ্চালনকারী হৃদপিন্ডকে।
আমরা অন্তর, মন এবং হৃদয়কে মানব দেহের কোথাও খুঁজে পেলামনা। তাহলে এবার একটু প্রেম সন্ধান করে দেখা যাক। সর্বজ্ঞানের ভান্ডার ইন্টারনেট বলছে, “প্রেম হচ্ছে পবিত্র দুটি মনের মানসিক তৃপ্তিসম্পন্ন মিলন যাতে কোন স্বার্থ থাকেনা।” আমরা ইংরেজীতে ‘হোয়াট ইজ লভ’ জানতে চাইলে উত্তর পেলাম, “লভ ইজ এ সেট অফ ইমোশান্স এ্যান্ড বিহেভিয়র্স কারেকটারাইজ্ড বাই ইন্টিমেসী, প্যাশন এ্যানড কমিটমেন্ট।” কীযে বস্তুহীন কথাবার্তা!
উক্ত সূত্রদুটো নিয়ে একজন স্পষ্টবাদী বয়স্ক মানুষের সাথে আমরা কথা বলে দেখলাম, তিনি সম্পূর্ণ ভিন্নমত ব্যক্ত করলেন। তিনি বললেন, মানুষ সুন্দর কিছু দেখতে চায়, দেখতে পেলে ছুঁয়ে দেখতে চায়, ছুঁতে পেলে আলীঙ্গণ করতে চায়, আলীঙ্গণ করতে পারলে বিদ্ধ করতে চায়, বিদ্ধ করতে পেলে নিঃসরণ চায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এক পর্বেই সবগুলো স্তর অতিক্রম করাতে সামাজিক বাধা আছে বলে ‘প্রেম’ শব্দের মোড়কে একটি প্রক্রিয়া আছে, এরকম একটা বায়বীয় বিষয় প্রতিষ্ঠা করেছে কিছু চতুর মানুষ। তারা বোকাদেরকে এই প্রক্রিয়ার দিকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা বিত্তশালী হয় এবং সুন্দরসমূহকে সরাসরি উপভোগ করে। তথাকথিত প্রেমের বায়বীয় ঘূর্নিতে পড়ে যারা সব হারায়, অনেকে ঝরে যায়, কেউ কেউ কয়েক লাইন কবিতা লেখে আর বিত্তশালী ও ভোগবাদি লোকগুলো তাদেরকে পুরস্কার দেয়। বস্তুতঃ হৃদয়, প্রেম, অন্তর, মন এগুলো হলো মানুষ ঠকানো কতগুলো শব্দ ও ধারনা যেগুলো চালাক মানুষেরা রঙ্গীন মোড়ক লাগিয়ে সরল লোকদেরকে খাইয়ে দেয়, এতে খাদক মাতাল হয়, ঢুলতে ঢুলতে চলতে থাকে আর চালাকেরা সুন্দর সেবন করে হাজারো রকমে– ভেজে খায়, রেঁধে খায়, ঝোল করে খায়, বাঁকা হয়ে খায়, সোজা হয়ে খায়, এইভাবে খায়, ওইভাবে খায়, সেইভাবে খায়, মুখের বোল ছুঁড়ে খায়, গালের টোল ছুঁয়ে খায় আর পৃথিবীর সকল মজা নিয়ে যায়। অন্যদিকে মজনু, ফরহাদ, ইউসুফ এবং মাইন উদ্দিনেরা অপার তৃষ্ণা নিয়ে করে হায় হায়।