১৯৫৬ সালে আমার বয়স ছিল ষোল, রেলওয়েতে আব্বার চাকরি উপলক্ষে থাকতাম কুষ্টিয়ার পোড়াদহে। আমাদের বাসার কাছেই থাকতেন আবদুর রশীদ নামে রেলওয়েরই একজন পুলিশ, তাঁর বাড়ি ছিল বরিশালের এনায়েতপুর। রশীদ সাহেবের ছিল একটা গ্রামোফোন বা কলেরগান আর বেশকিছু বাংলা গানের রেকর্ড। তবে অধিকাংশ দিন যে দুটি গান বেশি শোনা যেতো বলে এখনও মনে পড়ে তা হচ্ছে — তীরভাঙ্গা ঢেউ আর নীড় ভাঙ্গা ঝড় এবং এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি, মাঝখানে নদী বয়ে যায়।
সত্যি বলতে কি, ওই বয়সেও আমি মান্না দে, হেমন্ত কিংবা সতীনাথের কণ্ঠের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না অর্থাৎ হেমন্ত মুখার্জির গানকে কেউ শ্যামল মিত্রের বললে আমার ধরার সাধ্য ছিল না, কেবল এরা যে আধুনিক বাংলা গানের খুব নামকরা শিল্পী এইটুকু জানতাম। এর কারণ হতে পারে, ধর্মীয় গোঁড়ামি, পারিবারিক পরিবেশের অভাব আর সেই সঙ্গে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তখন পর্যন্ত রেডিও নামক বস্তুটির সঙ্গেও আমাদের পরিচয় হয়নি আর খুব ছোটবেলায় গ্রামেরই এক মামার বাড়িতে যে কলেরগান দেখেছিলাম, তারপর আর সেই যন্ত্রটিও ছুঁয়ে দেখিনি। এভাবেই সঙ্গীত জগতের সব দিকপাল ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে আমার অনেকটা সময় লেগেছিল। এরপর অনেকবার আলাদা আলাদা করে এদের গান শুনেছি, পত্রিকায় সাক্ষাৎকার পড়েছি এবং টেলিভিশনে গান শুনেছি। এখন আর কোনো শিল্পীর কণ্ঠ চিনতে তেমন ভুল হয় না। সেই যে অনেক বছর আগে আবদুর রশীদের গ্রামোফোনে কোনো এক অচেনা শিল্পীর গলায় তীরভাঙ্গা ঢেউ আর নদী বয়ে যাওয়ার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম, তিনি যে বাংলা ও হিন্দি সঙ্গীত জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র মান্না দে সেকথাও অনেক আগেই জেনে গেছি।
মান্না দে, যার প্রকৃত নাম প্রবোধ চন্দ্র দে, আজ তাঁর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিক। জন্মেছিলেন কলকাতায় ১৯১৯ সালের পয়লা মে আর লোকান্তরিত হন ৯৪ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ২৪ শে অক্টোবর, বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে। তাঁর স্ত্রী সুলোচনা কুমারণ তার একবছর আগে মারা যান। তাঁদের দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে।
মান্না দে বাংলায় প্রথম গান রেকর্ড করেন ১৯৫৩ সালে — ‘ আর কত দূরে নিয়ে যাবে বলো ‘। তিনি বাংলা ও হিন্দি গানে সমান জনপ্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে রাগাশ্রয়ী গানে তার জুড়ি ছিল না। তিনি ভারতের বিভিন্ন ভাষায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি গান রেকর্ড করেছেন। এরমধ্যে ধ্রুপদী গান, আধুনিক বাংলা, সিনেমার গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতি সবই রয়েছে। দীর্ঘ সঙ্গীত সাধনায় তিনি ভারত সরকারের পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ এবং দাদাসাহেব ফালকে মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। আমি এই প্রসঙ্গে তাঁর পরিচিত ও জনপ্রিয় কয়েকটি বাংলা গানের উল্লেখ করছি :
১। আমি কোন পথে যে চলি ২। আর কত দূরে নিয়ে যাবে ৩। তুমি আর ডেকো না ৪। সেই তো আবার কাছে এলে ৫। এই কূলে আমি আর ৬। তীরভাঙ্গা ঢেউ আর ৭। কফি হাউজের সেই আড্ডাটা ৮। ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে ৯। এক ঝাঁক পাখিদের মতো রোদ্দুর ১০। আমি যে জলসাঘরের বেলোয়ারি ঝাড় ১১। আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে ১২। ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না । ১৩। সে আমার ছোটবোন বড় আদরের ১৪। কতটা চোখের জল ফেলেছো ১৫। যদি কাগজে লেখো নাম ১৬। সবাই তো সুখী হতে চায় ইত্যাদি ।
এই অমর শিল্পীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা। ( পুরনো লেখা ) ।