বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনের বৃহৎ কারখানা চালু করেছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই)। দেশে এটাই প্রথম এ ধরনের কারখানা।
সম্প্রতি কারখানাটিতে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের কাঁচামাল পিভিসি ও পেট রেজিন তৈরির প্রথম কারখানা এটি। এই কারখানা চালুর মধ্য দিয়ে নতুন শিল্পের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ।
নতুন এই কারখানার অবস্থান নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে। এই কারখানায় বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি ইউএস ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ১০০ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পে বড় অঙ্কের ঋণ সুবিধা দিয়েছে নেদারল্যান্ডসের আইএনজি ব্যাংক। বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের একক কোনো কারখানায় এটিই সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ।
প্লাস্টিকের মূল কাঁচামাল পিভিসি ও পেট রেজিন এত দিন ছিল শতভাগ আমদানি-নির্ভর। নতুন এ কারখানা স্থাপনের ফলে আমদানি-নির্ভরতা কিছুটা হলেও কমবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ২৫০ প্রতিষ্ঠান তিন লাখ ২৬ হাজার টন পিভিসি আমদানি করেছে। আর আমদানিতে ব্যয় হয় প্রায় ৪৭ কোটি ডলার বা ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া গত অর্থবছরে পেট রেজিন আমদানি হয়েছে ২ লাখ ২৯ হাজার টন। এতে ব্যয় হয়েছে ২৭ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, দেশে প্লাস্টিকের কাঁচামালের চাহিদা বাড়তে থাকায় নতুন এই শিল্পে বিনিয়োগ করেছি। এই কারখানায় বছরে যে পরিমাণ কাঁচামাল তৈরি হবে, তাতে দেশীয় চাহিদার অর্ধেকের বেশি মেটানো যাবে।
এমজিআইয়ের নতুন এ কারখানায় পিভিসি ও পেট রেজিনের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ২ লাখ ৯৫ হাজার টন। অর্থাৎ কারখানাটিতে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হলে তাতে প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানি-নির্ভরতা অর্ধেক কমে যাবে।
আমদানি-নির্ভরতা কমার পাশাপাশি সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রার। আবার রপ্তানিরও সুযোগ থাকবে।
কারখানাটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, কারখানার মূল ইউনিট হলো ভিনাইল ক্লোরাইড মনোমার বা ভিসিএম প্ল্যান্ট। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত অক্সিভিনাইল কোম্পানি থেকে এই প্ল্যান্ট আনা হয়েছে। এ ছাড়া ফ্রান্সের কেম ওয়ান ও জার্মানির ওরলিকন কোম্পানির দুটি প্ল্যান্ট রয়েছে। ইতালি, সুইজারল্যান্ড, জাপান, অস্ট্রিয়া, চীন এবং ভারতের যন্ত্রপাতিও সংযোজন করা হয়েছে নতুন এ কারখানায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০১৭ সালে এই কারখানার নির্মাণকাজ শুরু হয়। তবে করোনার কারণে কারখানা স্থাপনের কাজ কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এ কারখানার দুটি ইউনিটে উৎপাদন শুরু হয়েছে চলতি বছর। এর মধ্যে এক সপ্তাহ আগে পিভিসি উৎপাদন শুরু হয়। আর পেট রেজিনের উৎপাদন শুরু হয়েছে মাস দুয়েক আগে।
দুই কাঁচামাল থেকে হাজারো পণ্য
পিভিসি বা পলিভিনাইল ক্লোরাইড দেখতে সাদা মিহি দানা আকারের। পেট বা পলিইথিলিন টেরেপথালেট রেজিন দেখতে সাদা রঙের ছোট দানা আকারের। পিভিসি দিয়ে প্লাস্টিকের পাইপ, দরজা, গ্লাভস, খেলনা, জুতা, কৃত্রিম চামড়া, ঘরের মেঝের উপকরণ, গাড়ির নানা উপকরণ ও গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের হাজারো পণ্য তৈরি হয়। আর এই কারখানায় উৎপাদিত ফুড গ্রেডের পেট রেজিন ব্যবহার হবে পানি, সফট ড্রিংকসহ খাওয়ার উপযোগী পণ্য রাখার নানা ধরনের প্লাস্টিকের বোতল তৈরিতে।
মাইনাস ১৬৯ ডিগ্রিতে কাঁচামাল আমদানি
পিভিসি তৈরির মূল কাঁচামাল ইথিলিন হলো ক্ষুদ্র গ্যাসীয় অণু। এটি মাইনাস ১৬৯ দশমিক ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরলে পরিণত হয়। এ তরল অবস্থা থেকে তাপমাত্রা যদি ৬৫-৬৬ ডিগ্রি বাড়ানো হয়, তাহলে সেটি পুনরায় গ্যাসীয় আকার ধারণ করে। বন্দর থেকে এই কাঁচামাল খালাস করে কারখানায় আনার জন্য মেঘনা গ্রুপ বিশেষায়িত দু’টি জাহাজ সংগ্রহ করেছে। বিশেষায়িত এ দুই জাহাজে করে মাইনাস ১৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কারখানায় আনা হয় পিভিসি ও পেট রেজিন তৈরির কাঁচামাল। ইথিলিন ছাড়াও মনো ইথিলিন গ্লাইকল বা এমইজি, পিউরিফায়েড টেরেপথালিক অ্যাসিড বা পিটিএ ও ক্লোরিন কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই চার কাঁচামালের মধ্যে ক্লোরিনের উৎস এমজিআই গ্রুপের কস্টিক সোডা কারখানার উপজাত। বাকি তিনটি কাঁচামাল আমদানি করে উৎপাদন করা হচ্ছে পিভিসি ও পেট রেজিন। গ্রুপটি ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদনের জন্য সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার ৬২ হাজার টন কাঁচামাল আমদানি করেছে।
শিল্পে নতুন যুগের সূচনা
প্লাস্টিকশিল্পে এত দিন ধরে মূলত মধ্যবর্তী কাঁচামাল ব্যবহার করে নানা পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে প্লাস্টিকশিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল ও সরঞ্জাম আমদানি হয় প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলারের। আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৩ লাখ টন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় পিভিসি ও পেট রেজিন। মেঘনা গ্রুপ উৎপাদন শুরু করায় প্রধান দুটি মধ্যবর্তী কাঁচামালের জন্য এখন আর দেশের বাইরে যেতে হবে না। মেঘনাই জোগান দেবে এই কাঁচামালের। তাতে বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় হবে।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, প্লাস্টিক খাতের বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। প্রতিবছর খাতটি ২০ শতাংশ হারে বড় হলেও এই খাতের কাঁচামাল তৈরির কোনো কারখানা এত দিন দেশে ছিল না। ফলে এ খাতের পাঁচ হাজার প্রতিষ্ঠানই আমদানি করা কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এমজিআই কাঁচামালের কারখানা চালুর ফলে এই খাতে নতুন যুগের সূচনা হলো।