• সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০২:৫৬ পূর্বাহ্ন

আসুন, কৃষি আর কৃষকদের কথা ভাবনা করি মো: ফজলুল হক মাস্টার

অর্থকন্ঠ ডেস্ক / ১৭১ ভিউ
আপডেট সময়: রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৩
কৃষি
আসুন, কৃষি আর কৃষকদের কথা ভাবনা করি মো: ফজলুল হক মাস্টার

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের দেশগুলোতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫.৫ বিলিয়নের বেশি লোকের বাস। এসব অঞ্চলের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারও মাত্রাতিরিক্ত। এখানকার গ্রামাঞ্চলের মানুষ নিম্ন মানের জীবন যাপন করে। গ্রাম থেকে ছুটে আসা হতদরিদ্ররা শহরের বস্তিতে বাস করে। বস বাস করে ফুটপাতেও। এশিয়ার জনবহুল শহরগুলোর এক-তৃতীয়াংশের অধিক লোক বস্তিবাসী। অশিক্ষা ও দরিদ্রতার ভারে কোটি কোটি বঞ্চিত মানুষের রোদন ও হাহাকারের প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে এ অঞ্চলের অগ্রযাত্রাও বাধাগ্রস্ত। এসব মানুষের আদি পেশা ছিল কিন্তু কৃষিই। কৃষি ও শিল্পে বিপ্লব ঘটেছে। ঘটেছে নব্য প্রযুক্তির ব্যবহার। বিপ্লবের প্রাপ্য ফল সম্পদের অপর্যাপ্ততার জন্যে বাড়তি জনসংখ্যার খোরাক মিটাতে দারুণভাবে পরাহত। হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতির অপার সৃষ্টির মহিমায় গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক সম্পদ নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে বিশ্ব নিয়ন্ত্রকরা আধিপত্যবাদের যে প্রকাশ্য লড়াই শুরু করেছে সেটাও মূলত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আধিপত্যবাদ বিস্তার বা করায়ত্ত করার হীন মানসেই।
মাটি খাঁটি। এবং খাঁটি কৃষকরাও। বাংলাদেশের ভূমিদস্যুতা সময়ে সময়ে চরমে পৌঁছে। চরমে কৃষি আর কৃষক অবহেলার ব্যাপারটিও। কৃষকের হাত থেকে পণ্য ব্যবসায়ীরা একদম নড়তে না পারলেই মূল্যবৃদ্ধি পায় দ্বিগুণ। এটাও কৃষিপণ্যের মূল্য দস্যুতার শামিল। আমাদের জমি উর্বর, কিন্তু বিধিবাম; কৃষকরাই দরিদ্র। খাঁটি মাটি যেমন ব্যবহারের ফলে উর্বরতা হারায় তেমনি কৃষকরা ন্যায্যমূল্য আর কৃষি উপকরণের অভাবে উৎপাদনে মার খেয়ে ভূমি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যায়। নিঃস্ব কৃষক অভাবের তাড়নায় দিশেহারা। তারপরও আমাদের অভ্যন্তরীণ আয়ের ৩০%-৩৫% আসে কৃষি থেকে। যত্নের অভাবে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত আর অধিক প্রাপ্তির প্রত্যাশার কবলে প্রাকৃতিক সম্পদ মাটি ও জলাশয় সংকুচিত হয়ে আসছে। পরিবেশও প্রতিকূল হয়ে উঠছে, যাতে করে কৃষির পরিস্থিতি নাজুক হতে চলছে দ্রুততার সাথে।
বাংলাদেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ১৮ শতাংশ আসে শস্যখাত থেকে, ৫ শতাংশ মৎস্যখাত থেকে, ৪ শতাংশ গবাদিপশু ও ৩ শতাংশ বনায়ন থেকে আসে। কৃষি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অপর্যাপ্ত। বঞ্চনাও আকাশচুম্বী। কৃষি ক্ষেত্রে ধস যত ত্বরান্বিত হবে আমাদের সুড়ঙ্গে পড়ে যাবার ব্যাপারটিও ততই নিশ্চিত হবে। আজকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে যে হতাশা ও হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কিন্তু উৎপাদন কম হওয়ার কারণেই। বলা চলে, আমরা সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে পড়েছি, তাই শত চেষ্টা তদ্বির করেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।
কৃষি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অপর্যাপ্ত, যা আমাদের চলার পথকে থমকে দিচ্ছে। আমাদের দেশে সহজেই কম শ্রমে, কম খরচে বিরাট প্রাপ্তির সম্ভাবনা যেখানে কৃষিতে রয়েছে সেখানে উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায়ভার আমাদেরকেই নিতে হবে। কৃষিজ কাঁচামালের জন্যে উন্নত বিশ্বের লোকেরা তাকিয়ে রয়েছে। শ্রমিকের জন্যেও তারা হাঁ করে থাকে। সুতরাং কৃষির প্রাপ্তির দরজাকে উৎকর্ষে ভরে দিতে হবে। আমাদের দেশের শ্রমিক নিয়ে বিদেশিরা ছাগল, ভেড়া লালন ও পরিচর্যা করাচ্ছে অথচ আমরা ১টি গাভী, ১টি বাড়ি- এ স্লোগানের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি না। ছাগল প্রকল্প যা করা হয়েছিল সেটাও দলীয়করণের ডামাডোলে তলিয়ে গেছে।
কৃষি থেকে প্রাপ্ত অনুষঙ্গই আমাদের জীবন বাঁচানোর সরাসরি নিয়ামক। খাদ্য ও পুষ্টি আমাদের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর একমাত্র উপাদান, এসবের যোগানও আসে কৃষি থেকে। আমাদের চাহিদার তথা প্রয়োজনের বড় প্রাপ্তি যেহেতু কৃষি থেকে আসে তাই বিরাট ভরসার স্থল এবং বেঁচে থাকার ও উন্নয়নের নির্ঘন্টক মৌলিক ক্ষেত্রও কৃষি।
পৃথিবীর ৫৫০ কোটি মানুষের বাৎসরিক বৃদ্ধির হার ২%। ৪০ বছরে এ জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য যোগান কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বর্তমান আবাদযোগ্য জমি থেকে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে মাটি ও জলের সঠিক ব্যবহারজনিত শিক্ষা ব্যতিরেকে মানুষের টিকে থাকার বিকল্প ভালো কিছুই নেই। লবণাক্ততা বা জলাবদ্ধতার কারণে মাটি অনুর্বর হয়ে পড়েছে। যত্রতত্র কল-কারখানা, অপরিকল্পিত বসতবাড়ি চাষোবাদ ব্যবহারযোগ্য মাটি কমিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে মাটি ও পরিবেশ রক্ষায় বনায়নের আয়তন ২৫ ভাগ থাকার কথা। কাগুজে ১৩ ভাগের কথা দাবি করা হলেও আমাদের প্রকৃত বনভ‚মি ৭ ভাগে নেমে এসেছে- যা এ দেশের ভ‚মি রক্ষায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাটির বুনট বা গাঁথনি অর্থাৎ মাটিতে বালি, কর্দম ও কণার উপস্থিতি কতটা রয়েছে- তা প্রশিক্ষণবিহীন চাষিদের পক্ষে চিহ্নিত করা মোটেই সম্ভব নয়। জমির ধরন নির্বাচনে সরকারকে ভ‚মিকা রাখতে হবে। কেননা সব জমিতে সব রকম ফসল ফলানো যায় না। গত শতকের ৬০-এর দশকে সারা বিশ্বে কৃষি ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব শুরু হয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহারজনিত কারণে আমাদের দেশেও কোনো কোনো জমিতে দুই/ তিনগুণ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এ বিপ্লব একেবারে মাঠ পর্যায়ে চাষিদের নিকট পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। সেজন্যেই প্রান্তিক চাষিদের ভাগ্যের বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এখনো কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে। অনুরূপ মানসে কৃষকদের সাথে ক্ষেতে-খামারে নামতে নারাজ। কৃষকরা হেলা-খেলায় নিজস্ব উদ্যোগে যেসব পণ্যসামগ্রী বাজারজাত করছেন তার সবটাই সিন্ডিকেট মার্কা ব্যবসায়ীদের কব্জায়। মূল্য প্রান্তির অনিশ্চয়তায় পাট ও আখের মতো অর্থকরী ফসলের উৎপাদন নাজুক পর্যায়ে চলে গেছে। পেঁয়াজ, রসুন, ডাল যে পণ্যগুলোর পর্যাপ্ত উৎপাদন সম্ভব সেগুলোরও আমদানি-নির্ভর হয়ে ওঠায় চড়া মূল্য দিয়ে ক্রয় করতে হচ্ছে বাজার থেকে।
দেশের স্থানীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত না করতে পারলে প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্ব বাজারের সাথে এঁটে ওঠা আমাদের মতো দেশের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠবে। একটি বাড়ির আঙিনায় থাকা ব্যবহারযোগ্য মাটিকে চাষের অধীনে আনতে হবে। লাউ, কুমড়ো, করলা, শিম, আদা, হলুদ পারিবারিকভাবে যতটা প্রয়োজন- তা বাড়ির আঙিনায় উৎপাদনে কৃষক পরিবারসহ সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বসতবাড়ির আঙিনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদনে গ্রহণযোগ্য জাগরণ করতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। দাপট কমবে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াটির। দু’একটি মরিচের গাছ বাড়ির আঙিনায় থাকলে এক টাকায় এক মরিচ কিনতে হবে না। এটা নিশ্চিত বিষয়। সময় ও সম্পদ অর্থের অপচয় রোধ করে এটার ফলপ্রসু রূপায়ণ তখনই দেখা দিবে কৃষিপ্রধান দেশের মানুষ হিসেবে যখন আমরা জমিতে শ্রম দিতে আগ্রহী হয়ে উঠবো। এ জাগরণের সম্যক কার্যকারিতায় সরকারের সাথে শিক্ষিত সমাজকেও কৃষিতে নামতে হবে। কৃষি শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাবোধই বছরে বর্ধিত ২০ লাখ বেকার সমস্যা কমিয়ে আনার অন্যতম উপায়। মাটি আর কৃষিতে খাঁটি কৃষকদের অবদান স্বীকার করলেই আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হবো। উন্নয়নের সোপান যখন কৃষি তখন আসুন, আমরা সবাই কৃষি আর কৃষকদের কথা ভাবনা করি।

মো: ফজলুল হক মাস্টার

মো: ফজলুল হক মাস্টার
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এই বিভাগের আরো খবর