স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে জনমুখী ও টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি রাষ্ট্রে সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে তিনি এ কথা বলেন।
দেশে ও প্রবাসে বসবাসরত সব বাংলাদেশিকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, এ দিনে আমি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থাপতি, সর্বকালের সর্বশ্র্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ চালালে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ ন’মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
আবদুল হামিদ সশ্র্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। এছাড়াও তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন জাতীয় চার নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সমর্থক, বিদেশি বন্ধু এবং সর্বস্তরের জনগণকে, যারা অধিকার আদায় ও মুক্তিসংগ্রামে বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন।
বঙ্গবন্ধু সবসময় রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। দারিদ্র্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দারিদ্র্যের হার কমছে। এক দশকে মাথাপিছু আয় বেড়েছে তিনগুণ।
তিনি বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে, যা গোটা বিশ্বে ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের ধারণার ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণাধীন পদ্মাসেতু এবছরই যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব হবে। মেট্রোরেল, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজও নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ এরইমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, টেকসই উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, ইনশাল্লাহ।
তিনি উল্লেখ করেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার (কোভিড-১৯) গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োচিত ও সাহসী পদক্ষেপের ফলে সরকার করোনার প্রভাব মোকাবিলা করে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে নানামুখী আর্থসামাজিক ও বিনিয়োগধর্মী প্রকল্প, কর্মসূচি এবং কার্যক্রম গ্রহণের ফলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এসময় প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, করোনা মোকাবিলায় সকলের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারের পাশাপাশি সকলকে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনসহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’- বঙ্গবন্ধুর এ আদর্শ অনুসরণে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাসহ আন্তর্জাতিক পরিম-লেও আমাদের অর্জন প্রশংসনীয়।
রাষ্ট্রপতি বলেন, একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত ও নির্যাতিত লাখ-লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সকল ধরনের সুযোগ সুবিধাসহ উন্নত আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী।
রাষ্ট্রপতি এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য মিয়ানমারসহ জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহত করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী, সুন্দর ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেওয়া আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) নীতি-আদর্শকে মুছে ফেলার পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে চিরতরে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাঙালি বীরের জাতি। কোনো কিছুই বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। বরং বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর মধ্যদিয়ে হয়ে উঠেছেন মহামৃত্যুঞ্জয়ী। মৃত্যু তাঁকে নিঃশেষ করেনি বরং বাঙালির চিত্তাকাশে আরও উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত করেছে। তাই, নতুন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বোঝাতে হবে, আজ তারা যে পথটি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা তৈরি করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভবিষ্যতেও তাঁর দেখানো পথই হবে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সোপান।
রাষ্ট্রপতি বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ক্ষুধা-দারিদ্র্র্যমুক্ত উন্নত দেশে পরিণত হোক, মহান স্বাধীনতা দিবসে এটাই আমার প্রত্যাশা।