চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় দুই বান্ধবীকে ধর্ষণের পর হত্যার ১৮ বছর পর দুই খুনির ফাঁসি যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হয়েছে। সোমবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে একই সাথে দুইজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাকির হোসেন (অতিরিক্ত দায়িত্ব)। যাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে তারা হলেন চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার রায়ের লক্ষীপুর গ্রামের আলী হিমের ছেলে মিন্টু ওরফে কালু (কয়েদী নং-৩৬২১) ও একই গ্রামের বদর ঘটকের ছেলে আজিজুর ওরফে আজিজুল (কয়েদি নং-৩৩০৮)।
তারা উপজেলার জোড়গাছা হাজিরপাড়া গ্রামের কমেলা খাতুন ও তার বান্ধবী ফিঙ্গে বেগমকে ধর্ষণের পর হত্যা করেন।
কারা সূত্রে জানা গেছে, ফাঁসি কার্যকর করার আগে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। এছাড়া, তাদের পছন্দ অনুযায়ী গত শনিবার গরুর কলিজা ভুনা ও ইলিশ মাছ, রোববার তন্দুর রুটি ও গ্রিল ও সোমবার মুরগীর মাংস, দই এবং মিষ্টি খাওয়ানো হয়।
কারারীতি অনুযায়ী ফাঁসির মঞ্চে তোলার আগে দুইজনকে গোসল করানো হয়। এরপর তাদেরকে তওবা পড়ান কারাগার জামে মসজিদের ইমাম আরিফ বিল্লাহ। এর আগে থেকেই মঞ্চ প্রস্তুত ছিলো। ফিলিপাইনের তৈরি মেনিলারোপ ফাঁসির দড়ি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দুইটি ও খুলনা কারাগার থেকে একটি মোট তিনটি আনা হয়। যাতে পর্যাপ্ত ঘি, কলা, ডিম ও মাখন লাগিয়ে ফাঁসির জন্য প্রস্তুত করা হয়। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে তারা খুব শান্ত ছিলেন। তারা হেঁটে ফাঁসির মঞ্চে যান। ঠিক ১০টা ৪৫ মিনিটের সময় জল্লাদ কেতু কামাল ও মশিয়ারের নেতৃত্বে লিটু ফকির, আব্দুল কাদের ও আজিজুল এ রায় কার্যকর করেন।
ফাঁসিকালে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক সার্কেল) বেলাল হোসাইন, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার তুহিন কান্তি খানসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে গভীর রাতে দুই আসামির পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
এর আগে মিন্টুর পিতা আলী হিমের সাথে মোবাইলে কথা হলে তিনি জানান, মিন্টু এলাকায় জেলের কাজ করতেন। তার স্ত্রী ও এক মেয়ে (২৮) রয়েছে। তিনি ছেলের মরদেহ যশোর থেকে আনার জন্য নিকটতম কয়েকজনকে পাঠিয়েছিলেন।
অন্যদিকে, আসামি আজিজুরের বড়ভাই সভা ইসলাম জানান, আজিজুর চাষাবাদ করতেন। এর মধ্যেই এ মামলায় জড়িয়ে পড়েন। তারা
মামলার বিবরণীতে জানা যায়, আলমডাঙ্গা থানার জোরগাছা হাজিরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা কমেলা খাতুন ও তার বান্ধবী ফিঙ্গে বেগম ২০০৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর খুন হন। হত্যার আগে তাদের দু’জনকে ধর্ষণ করা হয় বলে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধের পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলা কাটা হয় ওই দুই নারীর। এ ঘটনায় নিহত কমেলা খাতুনের মেয়ে নারগিছ বেগম খুনের পরদিন আলমডাঙ্গা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দুইজনসহ চারজনকে আসামি করা হয়। অপর দুইজন হলেন সুজন ও মহি। ২০০৩ সালে ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর আজিজুরকে আটক করে চুয়াডাঙ্গা কারাগারে পাঠানো হয়।
মামলা বিচারাধীন অবস্থায় মারা যান মহি। ২০০৭ সালের ২৬ জুলাই চুয়াডাঙ্গার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল সুজন, আজিজ ও মিন্টুকে মৃত্যুদন্ড দেন। পরে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট তা বহাল রাখে। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রæয়ারি আপিল বিভাগ দু’ আসামির রায় বহাল রেখে সুজনকে খালাস দেন। গত ২০ জুলাই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান সুজন।
এদিকে, গত ৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগ থেকে চিঠি পাঠানো হয়। যা ৮ সেপ্টেম্বর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে। এরপর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার সকল প্রস্তুতি শেষে সোমবার রায় কার্যকর করা হয়।
এদিকে, ফাঁসি কার্যকর করাকে কেন্দ্র করে কারাগারের সামনে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রধান ফটকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ফাঁসির খবর শুনে উৎসুক জনতা ভিড় করে কারা ফটকে।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার তুহিন কান্তি খান জানান, সোমবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন এবং সিভিল সার্জনের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রাতেই ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।