বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি বেলাল চৌধুরী। কবিতা লেখার পাশাপাশি বিশ্বখ্যাত কবিদের অনুবাদ ও করতেন। আজ ১১ নভেম্বর দাদার ( তিনি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন এবং তাঁর ছোটভাই খ্যাতনামা সাংবাদিক গিয়াস কামাল ভাইজানও আমাদের যেন পরিবারের একজন ছিলেন) জন্মদিন। তাঁকে গভীরভাবে স্মরণ করছি। তাঁর একটি লেখা এখানে শেয়ার করছি।
আকবর হায়দার কিরন
পাবলো নেরুদার রচনার ফলন রীতিমতো বিস্ময়কর। অর্ধশত কাব্যগ্রন্থ যার মধ্যে রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন সহস্রাধিক পৃষ্ঠার কাব্যসম্ভার, যার বিক্রিবাটা সম্ভবত গাণিতিক নিযুতকে ছাড়িয়ে কুবেরের বিষয়-আশয় হওয়ার পথে। আর কত যে ভাষায় তার তরজমা হয়েছে তার কোনো সীমা সরহদ্দ নেই। তরজমাকারদের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার কত যে গৌন থেকে প্রধান কবিরা রয়েছেন তার হিসেব কে রাখে।
এত এত কবিতার মধ্যে আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য সাধারণ টুকিটাকি জিনিস, এমন কি তৈজসপত্র নিয়ে তাঁর অননুকরণীয় ঈষদচ্ছ ভাষায় বিগত শতাব্দের শুরু থেকে পরবর্তী প্রায় সাত দশক অব্দি তাঁর জীবদ্দশায় তিনতিনটি ভাবগম্ভীর-ছন্দোময় আবাহনধর্মী গীতি কবিতা রচনা করে গেছেন। প্রাচীনকালে গ্রীক ভাষায় গীত হওয়ার জন্য এসব কবিতা রচিত হতো।
এ তিনটি বইয়ের মধ্যে ১৯৫৪ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘এনিমেন্টাল ওডস’ দিয়ে শুরু করে পরবর্তী সময়ে ‘নিউ এনিমেন্টাল ওডস’ আর ‘থার্ডবুক অফ ওডস’ রচনা করেন।
এগুলোর মধ্যে স্প্যানিশ ভাষার প্রফেসর এমেরিটাস মার্গারেট সেইয়ার্স পেদেনকৃত এবং নির্বাচিত গীতসমূহ থেকেই ‘সুরাগীতি’ বেছে নিয়ে বলতে গেলে তরজমার তরজমা করতে প্রয়াসী হয়েছি। কেননা, আমার মনে হয়েছে আরও অনেকানেক বিশিষ্ট নেরুদা-তরজমাকারদের মধ্যে একমাত্র শ্রীমতী পেদেনই তাঁর নিজের তরজমায় যথাযথ আর বিশদভাবে নেরম্নদার মনশ্ছবি আমাদের দিনানুদিনের বাস্তবতায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। অবশ্য তার জন্য তাঁকে যে পরিশ্রম করতে হয়েছে এক কথায় তার কোনও তুলনা হয় না।
জন্ম : ১২ জুলাই ১৯০৪, মৃতু্য : ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩
দিন-রঙা সুরা
রাত-রঙা সুরা
নীলচে-লাল পা-অলা সুরা
কিংবা পদ্মরাগমণি রুধিরা ভরা সুরা
মদিরা
মাটির
দু্যতিময় সন্তান,
মদিরা মোলায়েম
সোনালি তরবারি যেরকম
কোমল
কামাতুর মখমল যেরকম,
মদিরা সর্পিলাকৃতির ঝিনুক
আর বিস্ময়ভরা
প্রেমঘন,
সৈন্ধব;
কখনও একটি পানপাত্র ধারণ করতে পারে না তোমাকে
একটি গান, একজন মানুষ
তুমি বৃন্দগান, যূথচারী,
কম হলেও, অবশ্যই তোমাকে ভাগাভাগি করে নিতে হয়।
কখনও
পরিতুষ্ট হও নশ্বর
স্মৃতিতে;
তোমার তরঙ্গ আমাদের নিয়ে যায়
সমাধিস্তম্ভ থেকে সমাধিস্তম্ভে,
হিমশীতল সমাধিস্তম্ভেও প্রস্তরশিল্পী,
আর আমরা অশ্রুপাত করি
ক্ষণিক নয়নবারি;
তোমার মনোহর
বসন্তসজ্জা
ভিন্নরকম,
রুধির উৎসারিত হতে থাকে মঞ্জরির ভিতর দিয়ে
হাওয়া উসকে দেয় দিনকে
বাকি থাকে না আর কিছুই
তোমার নির্বিকার অন্তরাত্মার।
মদিরা
আন্দোলিত করে তোলে মধুঋতু, সুখ আর আনন্দকে
উদ্ভিদের মতন ফেটে পড়ে ধরাধামের উপর দিয়ে
চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ধসে পড়ে পাঁচিল
আর খাড়া উঁচু পাথুরে পর্বতগাত্র
গভীর গহ্বর যায় বুঁজে,
যে রকম জন্ম নেয় সংগীত
এক কুঁজো সুরা আর খাঁ খাঁ প্রান্তরে
আমার পাশে তুমি,
গেয়ে গেছেন যেমন প্রাচীন কবি।
সুরার কুঁজোকে দাও
নিজের চুম্বনে মজতে।
প্রিয়তমা আমার, হঠাৎ
তোমার কটিতট
কানায় কানায় উপচে পড়া বাঁক
সুরার পাত্রের,
তোমার স্তন হয়ে উঠে আঙুরের থোলো,
তোমার স্তনাগ্র যেন আঙুর;
সুরাসারের কোমল আভা তোমার কেশরাশিকে আলোকিত কওে,
আর তোমার নাভিকুণ্ড হোক নিষ্কলঙ্ক অভিজ্ঞান
তোমার রক্তবাহ উদরের উপর সীলমোহর মারা,
তোমার প্রেম এক অনিঃশেষ
সুরার তরঙ্গায়িত প্রসার
আমার বোধশক্তির ওপর আলো ফেলে উদ্ভাসিত করে তোলে
জীবনের ঐহিক জেলস্নায়।
প্রেমের চেয়েও ঢের বেশি তুমি,
জ্বলন্ত চুম্বন,
জীবনমদিরার চেয়েও ঢের বেশি
অগি্নতপ্ত;
তুমি হও
জনসমাজ,
ঈষদচ্ছ,
নৈতিকতার ঐকতান,
ফুলের অজস্রতা. উদ্বেল হূদয়োচ্ছ্বাস
যখন আমরা কথা কওয়াকয়ি করি
আমার পছন্দ টেবিলের ওপর
একটি হালকা কোমল বোতল
ক্ষিপ্রগতি সুরাভর্তি।
পান করো
আর স্মরণ করো
প্রতিটি ফোঁটার সুখস্বাদ
প্রতিটি পদ্মরাগমণি গেলাাস
প্রতিটি নীলাভ নীল জীবন অপরাহ্নের শ্রমলব্ধ
সুরা দিয়ে পূর্ণ করতে হবে,
তার আপিসের শাস্ত্রাচারও
সোজা সরল মানুষটিকে স্মরণ করতে দাও
মাটি আর তার কর্তব্য কর্মের প্রতি
সুরাপাত্রকে ছড়িয়ে দিতে।