সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় যা ঘটে গেল, তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। একটা তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে নিউমার্কেটের দুই দোকানির ঝগড়ায় যেভাবে পার্শ্ববর্তী ঢাকা কলেজের ছাত্রদের জড়ানো হলো; এর পর দু’পক্ষ যেভাবে নীলক্ষেত থেকে সাইন্সল্যাব পর্যন্ত গোটা এলাকাকে রণক্ষেত্র তৈরি করল, তা আমাদের সত্যিই হতবাক করেছে। আরও অবাক কাণ্ড ছিল ২৪ ঘণ্টাব্যাপী ব্যবসায়ী-ছাত্রদের এ রক্তক্ষয়ী ‘যুদ্ধ’ চলার সময় পুলিশের নীরবতা। শুরুতেই তারা যদি হস্তক্ষেপ করত তাহলে ওই এলাকা দিয়ে যাতায়াতকারী লাখ লাখ মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হতো না এবং সংঘর্ষের প্রভাবে রাজধানীর অন্যান্য সড়কেও এ রমজানের দিনে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পরিবহন যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো না। এটাও অস্বীকার করা যাবে না, মঙ্গলবার নিউমার্কেট এলাকা দিয়ে এলিফ্যান্ট রোডে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় কুরিয়ার সার্ভিসের যে তরুণ কর্মী দু’পক্ষের ‘ক্রসফায়ারে’ পড়ে অকালে প্রাণ হারাল এবং এর মাধ্যমে সংশ্নিষ্ট পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়ল, তা এড়ানো যেত যদি পুলিশ সময়মতো যুযুধান দুই পক্ষকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করত।
এখানে ব্যবসায়ী নেতারাও, বিশেষ করে নিউমার্কেট দোকান মালিক সমিতির নেতারা দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। ঘটনার সূত্রপাত ইফতারের সময় বাইরে টেবিল পাতা নিয়ে নিউমার্কেটের দুটি খাবারের দোকানের কর্মচারীদের ঝগড়ার মাধ্যমে। এদেরই এক পক্ষ অপর পক্ষকে শায়েস্তা করতে ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্রকে ডেকে আনে। স্বাভাবিকভাবেই অন্যপক্ষ আত্মরক্ষার্থে দল ভারী করে ওই ছাত্রদের পিটিয়ে দেয়। মূলত এর পরই শুরু হয় ‘যুদ্ধ’। একদিকে ঢাকা কলেজের মার খাওয়া ছাত্ররা ক্যাম্পাসে গিয়ে রটিয়ে দেয়- নিউমার্কেটের দোকানিরা তাদের ‘অন্যায়ভাবে’ পিটিয়েছে। এটা শুনে কলেজের হোস্টেলবাসী ছাত্রদের মধ্যে গোষ্ঠীতান্ত্রিক চেতনা জেগে ওঠে। দলবলে তারা রাজপথে নেমে আসে ‘ভ্রাতৃ’নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে। অপরপক্ষও মার্কেটে ছড়িয়ে দেয় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের দ্বারা ব্যবসায়ী নির্যাতনের গুজব। তা শুনে ওই একই গোষ্ঠীপ্রীতি থেকে দোকান মালিক-কর্মচারীরা যে যা পায় তা নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ঘটনা শুরুর আগে কিংবা গুজবে কান দিয়ে দু’পক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার পর হয়তো ব্যবসায়ী নেতাদের কিছু করার ছিল না। কিন্তু যেভাবেই হোক সংঘর্ষ সোমবার রাত আড়াইটার পর কয়েক ঘণ্টার জন্য থেমে যায়। তখন কি তারা অন্তত সংঘর্ষের সূত্রপাত বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে তা নিরসনের চেষ্টা চালাতে পারতেন না? এমনকি মঙ্গলবার সকালে যখন ব্যবসায়ীরা ছাত্রদের সঙ্গে আবারও সংঘাতে লিপ্ত হন, তখনও তাদের নিরস্ত করার জন্য ওই নেতাদের কেউ এগিয়ে আসেননি।
ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষই বা কোথায় ছিল, যখন ক্যাম্পাসে গুজব ছড়ানোর পর ছাত্ররা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হোস্টেল থেকে দলে দলে বের হয়ে এলো? প্রতিটা হোস্টেলে একাধিক শিক্ষক থাকেন হোস্টেল ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ছাত্রদের ভালোমন্দ দেখভাল করার। তাদের কাউকেই তখন ছাত্রদের বুঝিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে নিয়ে যেতে দেখা যায়নি। মঙ্গলবার রাতে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ যখন বলেন, তার ছাত্ররা নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে গিয়ে দোকান কর্মচারীদের মারধরের শিকার হলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়; তখন বুঝতে বাকি থাকে না- তিনি অন্তত কৌতূহলবশতও এত বড় একটা ঘটনার বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান চালাননি। এ-ই যদি হয় ঢাকা কলেজ ও হোস্টেলগুলোর কর্তৃপক্ষের অবস্থা, তাহলে ছাত্ররা তো স্রেফ গুজবের ওপর ভিত্তি করে একটা দক্ষযজ্ঞ বাধাবেই।
ছাত্ররা বয়সে তরুণ, যে-বয়সে রক্ত বরাবরই ‘গরম’ থাকে। এই বয়সে স্বভাবগতভাবেই মানুষের প্রবণতা যতটা গড়ার দিকে থাকে; ততটা কিংবা তার চেয়েও বেশি থাকে ভাঙার দিকে। অনেকটা এ কারণেই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কখনও কখনও রাজনৈতিক দলাদলি না থাকলেও ছাত্রদের মাঝে নানা ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটতে দেখা যায়। লক্ষণীয়, ছাত্রদের মধ্যকার ওইসব বিবাদ কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই স্থায়ী রূপ পেতে দেখা যায়। কারণ এ বয়সটা যেমন মারামারির, তেমনি প্রেমেরও। অর্থাৎ ছাত্রদের মনটা মাঝেমাঝে কঠিন মনে হলেও মূলত কোমল হয়। বিষয়টা বোঝা যাবে ঢাকা কলেজের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক বিবেচনায় নিলে। ঢাকা কলেজের পাশেই আছে টিচার্স ট্রেনিং (টিটি) কলেজ। একটু দূরেই আছে সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজসহ আরও কিছু কলেজ। এই সেদিনও টিটি কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ হলো। সেই সময়ও ওই এলাকার রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে পড়েছিল। এর পরও দুই কলেজের ছাত্রদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়নি। কয়েক মাস আগে ঢাকা কলেজের ছাত্র সিটি কলেজের এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার পর দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুমুল মারামারি হলে শিক্ষকরা এর সমাধানও করে ফেলেন। আইডিয়াল কলেজের সঙ্গেও প্রায় একই কারণে ইতোপূর্বে ঢাকা কলেজ ছাত্রদের মারামারি লেগেছে। কিন্তু তা উল্লিখিত সংকটের সময় আইডিয়াল কলেজের ছাত্রদের বাধা দেয়নি ঢাকা কলেজ ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে।
তবে নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজ ছাত্রদের সংঘাত এসব সূত্র মানে না। দশকের পর দশক ধরে মাঝেমধ্যেই তা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- ছাত্ররা ‘তোলাবাজি’ করে; তাদেরকে শান্তিতে ব্যবসা করতে দেয় না। অন্যদিকে ছাত্রদের অভিযোগ, নীলক্ষেত ও নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা যে কোনো উছিলা ধরে ছাত্রদের হেনস্তা করে। এমনকি কখনও কখনও ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করতেও দ্বিধা করে না। আমাদের দেশের প্রায় সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পেশিবাজি, অস্ত্রবাজি ও তোলাবাজি চলে- এটা অস্বীকার করা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ প্রবণতা বেশি এবং এসব প্রতিষ্ঠানের আশপাশের ব্যবসায়ীদের এ জন্য প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি মানতে হয়, তাও আমরা জানি। কিন্তু এ জন্য কি সুযোগ পেলেই শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করা বা পিটিয়ে দেওয়া যায়?
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার কতিপয় ছাত্রের ব্যবসায়ীদের কাছে তোলা চাওয়া এবং ব্যবসায়ীদের দ্বারা শিক্ষার্থী হেনস্তার মতো অপরাধ হয়তো আমরা খুব শিগগিরই দমাতে পারব না। কিন্তু এসব বিষয় যে বিদ্যমান এবং এগুলোর জেরে মাঝেমধ্যেই ঢাকা কলেজ ও নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন, তা তো সবারই জানা। সবাই বলতে আমরা পুলিশ, কলেজ প্রশাসন ও ব্যবসায়ী নেতাদের বোঝাচ্ছি। সংঘর্ষ এড়াতে বা তা যাতে তীব্র না হয় তার জন্য
আগাম কোনো ব্যবস্থা তারা নিতে পারেন না? আমাদের প্রত্যাশা, এবারের প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর সবার বোধোদয় হবে এবং পারস্পরিক সহাবস্থানের একটা উপায় বের করা হবে।
সাইফুর রহমান তপন: সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্রনেতা