কাওসার চৌধুরী
ক’দিন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে গিয়েছিলাম আমার কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র জমা দেয়ার উদ্দেশ্যে। বিশেষত ‘বধ্যভূমিতে একদিন’ আর্কাইভে জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ফিল্ম জমা নেয়ার ক্ষেত্রে নতুন কী নিয়ম কানুন হয়েছে সেটা জানার জন্যই মূলতে সেদিন আর্কাইভে যাওয়া। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে নিয়ম হলো- যে কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেই তার একটি কপি স্বেচ্ছায় দেশের ফিল্ম আর্কাইভে জমা রাখা; যাতে পরবর্তী প্রজন্ম চলচ্চিত্রটি নিয়ে পুনরায় চর্চা করতে পারে, গবেষণা করতে পারে। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশে সাধারণত আমরা ওই কাজটি করি না; আফসোস!
সেদিন ফিল্ম আর্কাইভে গিয়ে বেশ লাভ হলো; উপরি পেয়েছি অনেক। আর্কাইভের অনেকটা অংশ ভালোভাবে দেখা হয়ে গেলো ফিল্ম আর্কাইভের পরিচালক ড. মো. মোফাকখারুল ইকবালের কল্যাণে। ফিরবার সময় এই প্রতিষ্ঠানের মহা পরিচালক মো. নিজামূল কবীর তাঁদের সাম্প্রতিক প্রকাশনা ‘সিনেমার পোস্টার’ (২য় খণ্ড- ১৯৮৭- ২০১২) গ্রন্থটি উপহার দিলেন। গ্রন্থটির সম্পাদক উনি নিজেই।
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের বর্তমান ভবনটি আগারগাঁও-এ প্রশাসনিক এলাকায়। ভবনটির স্থাপত্য শৈলী সত্যিই নান্দনিক। ভেতরে সংরক্ষণাগার, মিলনায়তন, শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার, সেমিনার কক্ষ- সব মিলিয়ে একটি আধুনিক আর্কাইভের গন্ধ পাওয়া যায় নতুন এই ভবনে।
একটু পেছনে ফিরে যাই।
আমাদের চলচ্চিত্র গুরু আলমগীর কবিরের কর্ম এবং জীবন নিয়ে আমি একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলাম ‘প্রতিকূলের যাত্রী’ শিরোণামে। সেটা ’৯২ কি ’৯৩ সালের কথা। সবাই বেশ প্রশংসা করেছিল ফিল্মটির (ইউটিউবে দেখা যায়)। আমিও বেশ আপ্লুত হয়ে ওই বছরেই কোন একদিন হাজির হয়ে যাই সরকারি ফিল্ম আর্কাইভে- ফিল্মটি ওখানে জমা দেবো বলে।
তখন ফিল্ম আর্কাইভ ছিল আগারগাঁও বেতার ভবনের আশেপাশে কোথাও একটি দালানে। প্রামাণ্যচিত্র ‘প্রতিকূলের যাত্রী’ আর্কাইভে জমা দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতাশেষে আর্কাইভের বিভিন্ন কামরা একটু ঘুরে দেখছিলাম তাঁদের অনুমতি নিয়ে।
চলচ্চিত্রের রীল সংরক্ষণের একটি কামরায় ঢুকে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। সংরক্ষিত ফিল্মের র্যাকের উপরে কারা যেন আধাখাওয়া শিঙাড়ার একটি প্লেট এবং শেষ চুমুক দেয়া দু’টি চায়ের কাপ ফেলে এসেছেন অসংকোচে! দেখে তো আমার চুল খাড়া হবার দশা! ফিল্ম সংরক্ষণ করতে হয় সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে। আর, এই সংরক্ষণাগারগুলো থাকে সাধারণত বেশ কড়া নজরদারীতে। সেই ‘কড়া নজরদারীর’ সংরক্ষিত কামরায় চা-শিঙাড়া এলো কীভাবে বুঝতে পারি নি! সেটা ছিল রীতিমত ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! বিষয়টি আমি তখন তখনই তৎকালীণ কিউরেটর সাহেবের নজরে এনে প্রতিবাদ জানাই।
‘চা-শিঙাড়া’র দূষণে দুষিত সেই আর্কাইভের পরে এই সেদিন গিয়েছি নতুন আর্কাইভে। ফিল্ম আর্কাইভের নান্দনিক বিশাল ভবনটি দেখেই মনটা জুড়িয়ে গেলো! প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে, প্রতিটি কামরায় বিশ্বমানের সব আয়োজন মনকে নাড়া দেয়। জাতি হিসেবে আমাদের জাদুঘর এবং আর্কাইভসগুলো এই রকমই তো হওয়া উচিৎ। যা আপনাকে আমাকে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে কথা বলতে সহযোগিতা করবে।
একাত্তরে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তো জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করা প্রয়োজন। ভুলে গেলে চলবেনা- ’৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প, বানিজ্য এবং শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে উনারই প্রবল আগ্রহ এবং পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ঢাকা চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ (এফডিসি)। তারই ধারাবাহিকতায় এ দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং চলচ্চিত্র সংরক্ষনের ধারাটি আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। সেদিক থেকে- বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের বর্তমান আবস্থান মূল আদর্শের সাথে সাযুজ্যপূর্ণই বলতে হয়।
চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সামগ্রী সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং গবেষণার মাধ্যমে চলচ্চিত্র কেন্দ্রিক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করাটাই তো কোন ফিল্ম আর্কাইভের মূল কাজ বলে জানি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান- নিঃসন্দেহে।
১৯৭৮ সালের ১৭ মে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ’ নামে এই প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। শিল্পী এ. কে. এম. আব্দুর রউফ ছিলেন সেই সময়ের কিউরেটর। সুযোগ পেয়ে একটু বলে নেই- ইনি সেই আব্দুর রউফ- বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাহাত্তরে বাংলাদেশের সংবিধান যিনি নিজের হাতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। যে সংবিধানের অঙ্গসজ্জা করেছিলেন শিল্পী হাশেম খান। সার্বিক তত্বাবধানে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। প্রতিটি পৃষ্ঠা অলংকরণে ছিলেন শিল্পী জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী এবং আবুল বারাক আলভী। সংগ্রাহকদের জন্য বলছি- বাহাত্তরের এই সংবিধানের অবিকল প্রতিলিপি বাজারে পাওয়া যায় কিন্তু।
একাশি সালে সেই ‘ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ’-এর সাথে যুক্ত হয়ে প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির কয়েক মাস মেয়াদের ফিল্ম এ্যপ্রিসিয়েশন কোর্স পরিচালনা করেছিলেন এখান থেকে। সেই সময়ে আমরা (বিকল্প ধারার চিত্র নির্মাতাদের কয়েকজন) ওই কোর্সগুলোতে অংশ নেই। কিন্তু তৎকালীণ সরকার কিছুদিনের মধ্যেই কোর্সগুলো বন্ধ করে দেয়- ওখানে (ইন্সটিটিউটে) বাম ধারার রাজনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধ-চর্চার অপরাধে!
১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ’ নামের প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৪ সালে শুধু- ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ’ নামকরণ করা হয়। জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রতিষ্ঠানটি ধানমন্ডির শংকরে একটি ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হয়ে আসছিল। আমরা ওখানেই ক্লাস করেছি।
এরপরে ফিল্ম আর্কাইভের একটি নিজস্ব ভবনের জন্য জাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ৪০ বছর। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহে ঢাকার আগারগাঁও-এ নির্মিত হয়েছে বিশ্বমানের আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন ফিল্ম আর্কাইভ ভবন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর নবনির্মিত বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ভবন উদ্বোধন করেন।
ফিল্ম আর্কাইভের বর্তমান মহা পরিচালক মো. নিজামূল কবীরের সাথে আলাপ করে জানা গেলো- এরমাঝে ‘চলচ্চিত্র সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফিল্ম আর্কাইভে ডিজিটাল যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। ফলে এনালগ ফিল্মকে ডিজিটাল ফরমেটে রূপান্তর, রেস্ট্রোরেশন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ আধুনিক প্রযুক্তির সক্ষমতা লাভ করেছে। চলচ্চিত্রের রীল সংরক্ষনের জন্য বর্তমান আর্কাইভে ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস, ৮ এবং ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার রক্ষনাগারের পাশাপাশি শুন্য ডিগ্রী এবং মাইনাস ৪, মাইনাস ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার ফিল্ম রক্ষণাগার তৈরি হয়েছে কয়েকটি।
ফিল্ম আর্কাইভের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়- এসব রক্ষনাগারে বর্তমানে এক হাজার ১৩৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ১১৬টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, এক হাজার ২৫৪টি বিভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র এবং ৪৮৮টি সংবাদচিত্রসহ মোট দুই হাজার ৯৯৪টি চলচ্চিত্র সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের লাইব্রেরিতে সংগৃহীত পুস্তকসহ বিভিন্ন সামগ্রীর সংখ্যা ৬৯ হাজার ১৭৫ টি।
এছাড়াও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ৫০০ আসনবিশিষ্ট একটি মাল্টিপারপাস হল, ৩০০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রজেকশন হল এবং ১২০ আসন বিশিষ্ট একটি সেমিনার হল এবং দেশের একমাত্র ‘ফিল্ম মিউজিয়াম’ রয়েছে এই ফিল্ম আর্কাইভ ভবনে।
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ১৯৮০ সালে বিশ্বব্যাপী আর্কাইভের আর্ন্তজাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশানাল ফেডারেশন অব ফিল্ম আর্কাইভস্ (FIAF) এর এবং ২০১৯ সালে ইন্টারন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন অব অডিও ভিজ্যুয়াল আর্কাইভ (IASA) এর সদস্য পদ লাভ করেছে।
কোন ফিল্ম আর্কাইভে শুধুমাত্র ভবনের নান্দনিক স্থাপত্য আর বিজ্ঞানসম্মত রক্ষণাগার এর সকল উদ্দেশ্য আদর্শ আর কর্মযজ্ঞকে সফলতা প্রদান করতে পারে না। চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থী, নির্মাতা, কর্মী, গবেষক আর চলচ্চিত্র দর্শকদের একটি বড়ো আস্থার জায়গা এই ফিল্ম আর্কাইভ। শ্রেণী-পেশা এবং স্তরভেদে উল্লেখিত স্টেকহোল্ডারদের চাহিদা পূরণ- ফিল্ম আর্কাইভের অন্যতম দায় এবং দায়িত্বের অংশ।
সেই জন্মলগ্ন থেকে আর্কাইভে চলচ্চিত্র নির্মাণের এবং চলচ্চিত্র অনুধাবনের জন্য সংক্ষিপ্ত কোর্স পরিচালনা করা হতো- আগেই বলেছি। সেই মর্মে এই নতুন ভবনে বেশক’টা আধুনিক শ্রেণীকক্ষও আছে দেখলাম। কিন্তু সেগুলো পড়ে আছে নির্জীব, মৃত! জানা গেলো- সরকারি উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ সিনেমা এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’ (বিসিটিআই) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আর্কাইভের সংক্ষিপ্ত কোর্সগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে।
পরিতাপের বিষয়, শুরুর দিকে ‘সিনেমা এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে’ শিক্ষার্থীদের যে আশাব্যঞ্জক উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল- ক্রমশ সেটা আশংকাজনক হারে কমে এসেছে। ফলে, ‘প্রশিক্ষণের’ এ কূল ও-কূল দু-কূলই এখন লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার ক্রসরোডে এসে দাঁড়িয়েছে! এসব বিবেচনায় ফিল্ম আর্কাইভের সংক্ষিপ্ত কোর্সগুলো পুনরায় চালু করা যায় কী না ভেবে দেখা প্রয়োজন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জয় হোক। চলচ্চিত্র হোক জীবনের প্রকাশিত সত্য।