হাসান মীর
দীর্ঘদিন ওয়াশিংটনে ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা সম্প্রচারের সঙ্গে জড়িত ছোটগল্প লেখক, ঔপন্যাসিক ও কবি দিলারা হাশেম ৮৬ বছর বয়সে আজ ২০শে মার্চ ( স্থানীয় সময় শনিবার ) যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে ইন্তেকাল করেছেন। দুপুরে ফেসবুক উল্টাতে গিয়ে Mohammad Abdullah ‘র দেওয়া একটি সংক্ষিপ্ত ঘোষণায় তাঁর মৃত্যু সংবাদটি জানতে পেলাম। মেরিল্যান্ডে তিনি দুই মেয়ের সঙ্গে থাকছিলেন বলে জানা গেছে। স্বামী অনেক আগে মারা গেছেন।
আমি ভিওএ’র নিয়মিত শ্রোতা ছিলাম না, মিসেস হাশেমের সঙ্গে কখনো সরাসরি যোগাযোগ বা দেখাও হয়নি। তবে ১৯৬০’র দশকে করাচিতে থাকাকালে তাঁর নামের সাথে পরিচিত হই। তিনি রেডিও পাকিস্তান করাচি কেন্দ্র থেকে প্রথমে বাংলা গান পরিবেশন করতেন, পরে বাংলায় খবর পড়তেন। আমি তখন ফেডারেল ক্যাপিটাল এরিয়া নামে পরিচিত সরকারি কর্মচারীদের আবাসিক এলাকায় একটি মেসে থাকতাম। সময় কাটানো আর বিনোদনের সঙ্গী হিসাবে আমার ছিল চার ব্যান্ডের একটি ফিলিপস ট্রানজিস্টার রেডিও। আমি টিউনিং হুইল ঘুরিয়ে দেশ- বিদেশের বিভিন্ন বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতাম। তবে একমাত্র করাচি কেন্দ্র থেকেই বাংলায় খবর ও কিছু সময়ের জন্য বাংলা গান শোনা যেতো। যতদূর মনে পড়ে কোনো একদিন বিকেলের দিকে রেডিওতে দিলারা হাশেমের কণ্ঠে ‘ যা রে যাবি যদি যা পিঞ্জর খুলে দিয়েছি ‘ গানটি শুনি। বশির আহমদের গাওয়া ও সুর দেওয়া এই গানটি তখন জনপ্রিয় হয়েছিল। ( রুণা লায়লার মা লায়লা এমদাদও তখন করাচি রেডিও থেকে বাংলা গান গাইতেন ) ।
যাইহোক, এর ক’দিন পর রেডিওতে দিলারা হাশেমকে বাংলায় খবর পড়তে শুনে একরকম খুশিই হলাম — বাহ! মহিলার তো অনেক গুণ, গল্প লেখেন, গান করেন আবার খবরও পড়েন … এবং সত্যি বলতে কি, নতুন হলেও তাঁর সংবাদ পাঠের স্টাইল, উচ্চারণ এবং কণ্ঠস্বর ভালোই ছিল। আমি অচেনা এই মহিলার বহুমুখী প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে পরদিন বেঙ্গলি নিউজ ডিপার্টমেন্ট, রেডিও পাকিস্তান, করাচি — এই ঠিকানায় তাঁকে প্রশংসা সূচক একটি চিঠি লিখে পাঠালাম। আর এতেই ঘটলো বিপত্তি। আমি যে সময়ের কথা বলছি, গত শতাব্দের সেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আজকের দিনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক কিছুই আবিস্কৃত হয়নি, আমাদের অনেকেরই একটা প্রিয় হবি ছিল পত্রমিতালী, আর ছিল গান শোনা, ক্লাসিক মুভি দেখা কিংবা ডাকটিকেট সংগ্রহ করা। বস্তুত সেই ২৩/২৪ বছর বয়সে আমার বেশ ক’ জন কলম- বন্ধু ছিলেন, নিয়মিত পত্র-যোগাযোগ হতো। সেই শখের বশেই দিলারা হাশেমকে চিঠি লেখা কিন্তু তিনি যে বিষয়টি সিরিয়াসলি নেবেন, সে সম্পর্কে ধারণা ছিল না। ওই সময় করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার প্রভাষক অথবা সহকারী অধ্যাপক ছিলেন বরিশালের মুজিবুর রহমান নামে এক ভদ্রলোক, তাঁর ছোটভাই ছিলেন আমাদের বন্ধু, সেই সূত্রে স্যারের সঙ্গে পরিচয়। তিনিও ফেডারেল এরিয়াতেই একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। একদিন স্যারের ভাইয়ের সাথে দেখা করতে তাদের বাসায় গেছি। কথা প্রসঙ্গে স্যার আমার নাম জানতে চাইলেন, বললেন — আপনার মূল নামটা তো হাসান, সাথে আর কী আছে ? বললাম। তিনি জানতে চাইলেন — আপনি কি নীল প্যাডের কাগজে চিঠি লেখেন আর চিঠির উপরে রাবার স্ট্যাম্পে নাম- ঠিকানা লেখা থাকে ? বললাম — ঠিক তাই, কিন্তু আর রহস্য না করে ব্যাপারটি খুলে বলবেন ? এবার মুজিবুর রহমান স্যারের কাছে দিলারা হাশেমকে লেখা আমার চিঠির কথা জানা গেলো। স্যার বললেন — মহিলা হয়তো আরও দু’একজনের কাছে পত্র লেখক সম্পর্কে খোঁজ খবর করেছেন, একইভাবে আমার কাছেও জানতে চাইলেন কারণ আমি আর আপনি দু’ জনেই এখানে এফ- টাইপের বাসায় থাকি, আর তারচেয়েও বড় কথা তিনি ভেবেছেন পত্র লেখক হয়তোবা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সেই সুবাদে আমি হয়তো তাকে চিনতেও পারি। সব শুনে বললাম – আমি তো কোনো বাজে মন্তব্য করিনি, কেবল তাঁর সংবাদ পাঠের প্রশংসাই করেছি। তাছাড়া চিঠিতে আমার নাম-ঠিকানাও দেওয়া ছিল… । স্যার বললেন — চিঠিটা তিনি আমাকে দেখিয়েছেন, আমি পড়েছি। আসলে সবার রুচি- পছন্দ তো একরকম হয় না। তাঁর গান আর সংবাদ পাঠ আপনার ভালো লেগেছে, হয়তোবা আপনার প্রশংসা তাঁর কাছে ভালো লাগেনি। যাইহোক, এভাবে অজানা – অচেনা কারো কাছে চিঠি লিখে বিপত্তিতে পড়তে যাবেন না।
সংযোজন — দিলারা হাশেমের জন্ম যশোরে ১৯৩৬ সালের ২৫শে অগাস্ট। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ঘর মন জানালা তাঁর প্রথম উপন্যাস, প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। এটি সিনেমা হয়েছে এবং বিদেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। অন্যান্য রচনা – একদা এবং অনন্ত, শংখ করাত, আমলকির মৌ, হলদে পাখির কান্না ইত্যাদি । প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৬টি। তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ( ১৯৭৬) ও অন্যান্য পুরস্কার লাভ করেন। রেডিও পাকিস্তান করাচি ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ বেতার এবং বিটিভি থেকেও খবর পড়েছেন। ১৯৮২ সাল থেকে তিনি ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ২০১১ সালে অবসরগ্রহণ করেন। সম্পাদিত ও পরিমার্জিত।