শিব্বীর আহমেদ
ব্যক্তিগতভাবে চিহ্নিতকরণ তথ্যগুলোর এখনো সুরক্ষিত হয়নি বাংলাদেশে। তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং এর সাথে সাথে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের সকল ব্যক্তিগত তথ্য। অনিরাপদ হয়ে উঠতে শুরু করেছে মানুষের জীবন। তথ্য প্রযুক্তির এইযুগে সবকিছুই তথ্যের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় ব্যাংক বীমা অপরাধ সংগঠন, অপরাধ দমনের সকল তথ্যই যেন মানুষের হাতেহাতে মানুষের পরিচয়পত্রে পাসপোর্টে। যার কাছেই যাচ্ছে আইডি পাসপোর্টগুলো ব্যক্তিকে চিহ্নিতকরণ সকল তথ্যই তার কাছে চলে যাচ্ছে অনায়াসে।
বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয় পত্র দেয়া হয়েছে সকল নাগরিককে। কিন্তু সেই পরিচয় পত্রে একজন ব্যক্তির সকল গোপনীয় তথ্যই ছাপানো হয়েছে সরকারি ভাবে যা অত্যন্ত বিপদজ্জনক। জাতিয় পরিচয় পত্রে ব্যক্তির নাম, আইডি নাম্বার, পিতা মাতার নাম, জন্ম তারিখ, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা সকল তথ্যই সরকার কর্তৃক ছাপা হয়েছে। এই জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে যেকোন ব্যক্তির দ্বার যেকোন অপরাধ সংগঠন সম্ভব। কারন মাত্র এই একটি পরিচয় পত্রের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তির সকল গোপন তথ্য চলে যাচ্ছে অন্যজনের কাছে। বাংলাদেশের প্রতিটি কাজ ও কর্মের জন্য এই আইডিটি দেখানো এখন বাধ্যতামূলক। যার ফলে সরকার বা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের বাইরেও আরো একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীর কাছে চলে যাচ্ছে সাধারন মানুষের সকল ব্যক্তিগত সুরক্ষা তথ্য।
বাংলাদেশের মত যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের কোন জাতীয় পরিচয় পত্র নেই। কিন্তু সেখানে সোসাল সিকিউরিটি নাম্বার বা এসএসএন প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই এসএসএন কার্ডে নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম ও একটি ইউনিক নাম্বার ছাড়া আর কোন তথ্যই ছাপা হয়না। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বা অনুমোদিত কর্তৃপক্ষ সোসাল সিকিউরিটি নাম্বারটি যথাযথ এবং অথারাইজড যেকোন ডিভাইসে প্রবেশ করালেই প্রয়োজনীয় অন্যান্য তথ্যগুলো পেয়ে যাবে। সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয়, কিংবা গোপনীয় তথ্য জানার যাদের কোন অধিকার নেই অনুমোদন নেই তারা কখনোই একজন ব্যক্তির সকল তথ্য জানবার কোন সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত পাসপোর্টগুলোর মাধ্যমেও দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টগুলোতে পাসপোর্ট নাম্বার, নাম, জন্ম তারিখ ছাড়া অন্যকোন ব্যক্তিগত তথ্য ছাপানো হয়না। কিন্তু বাংলাদেশের পাসপোর্টে একজন ব্যক্তির সকল তথ্য যেমন নাম, জন্ম তারিখ, জাতীয় পরিচয় পত্রের নাম্বার, পিতা, মাতা, স্ত্রী, জরুরি যোগাযোগকারী ব্যক্তির নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার ছাপানো হয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি পাসপোর্টে পূর্ববর্তী পাসপোর্টের নাম্বার পর্যন্ত প্রিন্ট করা হয়। শুধুমাত্র একটি পাসপোর্টের মাধ্যমেই বাংলাদেশের সকল নাগরিকের সকল গোপনীয় তথ্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার বিষয়ে অজ্ঞতা থাকার কারনে বাংলাদেশের সাধারন মানুষ তাদের আইডির কপি ফেসবুক, ট্যুইটার, ইনিষ্টাগ্রাম সহ বিভিন্ন সোসাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে তথ্যগুলো হাতছাড়া যাচ্ছে খুব সহজেই। সোসাল মিডিয়ায় ওতপেতে থাকা ক্রিমিনালরা সহজেই পেয়ে যাচ্ছে তথ্যগুলো। হ্যাক করছে ফেসবুকের আইডি সহ অন্যান্য একাউন্টগুলো। বাড়ছে অপরাধ প্রবনতা। সোসাল মিডিয়া হ্যাক করে হ্যাকাররা করছে নানা অপরাধ। পাসপোর্ট এবং জাতীয় পরিচয় পত্রের সকল তথ্য ব্যবহার করে নিজেই হয়ে যাচ্ছে সেই ব্যক্তি। করে যাচ্ছে নানা অপরাধ। অথচ আসল ব্যক্তির ঐ বিষয়ে কোন হাত নেই। কিম্বা কে আসল আর কে নকল এটা নিশ্চিত করাই অনেক দূরহ হয়ে পড়ছে।
একজন নাগরিক হিসেবে তার সব ধরনের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ (খ) নম্বর অনুচ্ছেদে প্রাইভেসি বা ব্যক্তির তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা (অনুচ্ছেদ ১২) নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদ (অনুচ্ছেদ ১৭), জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স (অনুচ্ছেদ ১৪) এবং শিশু অধিকার সনদ (অনুচ্ছেদ ১৬)-এ প্রাইভেসিকে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশের সকল নাগরিেেকর সকল তথ্য সুরক্ষার দায়িত্বও সরকারের বা রাষ্ট্রের।
বাংলাদেশের টেলিফোন নাম্বারগুলো জেলা বা উপজেলা পর্য্যায়ে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশের ফোন কোম্পানীগুলো যে নাম্বার ইস্যু করে থাকে তা কোন জেলা বা উপজেলার তা চিহ্নিত করার কোন সুযোগ সাধারন মানুষের নেই। দেশের কোন টেলিফোন নাম্বার কোন জেলার বা কোন উপজেলায় ব্যবহার করা হবে তা এখনই নিশ্চিত করতে হবে। একটি জেলায় যদি ১০টি উপজেলা থাকে সেখানে প্রতিটি উপজেলার জন্য একটি করে মোট দশটি এরিয়া কোড ইস্যু করা অত্যন্ত জরুরি। এতে সহজেই অনুমান বা আইডেন্টিফাই করা যাবে ফোন কলটি কোথা থেকে আসছে। এই বিষয়ে সরকারি নীতিমালা প্রয়োজন।
২০০১ সালে পাস হওয়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন ২০১০ সালে সংশোধিত আইনে ফোনে আড়ি পাতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলোর বাইরে যেকোনো ব্যক্তির কথোপকথন আড়ি পেতে রেকর্ড করলে বা প্রচার করলে দুই বছর কারাদন্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য কোথায় কীভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করবে সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা হয়নি। জাতীয় স্বার্থে আড়ি পাতা হলে এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু আমাদের দেশে যেহারে গোপন আলাপ রেকর্ড ও ফাঁস হচ্ছে তা অত্যন্ত বিপদজ্জনক। এই কিছুদিন পুর্বেও সরকারের এক উচ্চ পর্য্যায়ের উপদেষ্টার ফোন কল রেকর্ড করা হয়েছে এবং ফেসবুক সহ বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
দেশের সকল নাগরিকদের তথ্য সুরক্ষিত থাকবে সকল তথ্য দেশেই থাকবে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছেই থাকবে এই বিষয়টি নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। জাতীয় পরিচয় পত্র, পাসপোর্টে ব্যক্তিগত সকল তথ্য না ছাপানো যত দ্রæত সম্ভব নিশ্চিত করতে হবে সরকার বা রাষ্ট্রকে। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিদেশি অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বাংলাদেশে ডেটা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি। সাংবিধানিক ভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপদে রাখা সুরক্ষিত রাখা এবং ব্যক্তিগত তথ্য কঠোরভাবে সংরক্ষণ করা।
– কথাসাহিত্যিক – সাংবাদিক, ঢাকা