ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার সময় পার করছে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। দেশটির অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকটসহ চরম বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে কঠিন সময় কাটাচ্ছে শ্রীলঙ্কা।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও অর্থনীতির বিশ্লেষকরা শ্রীলঙ্কার বিপর্যয়ের যেসব কারণ তুলে ধরছেন, সেগুলোর মধ্যে সে দেশের করোনার দুই বছর আয়ের প্রধান খাত পর্যটন শিল্পে ধস নেমেছে। ফলে এ খাতের আয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে দেশটি। বিপরীত দিকে পর্যটক আকৃষ্ট করতে গ্রহণ করা নানা প্রকল্পে আগে নেওয়া বিপুল বিদেশি ঋণের কিস্তি ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাছাড়া শিল্প উৎপাদনে ধস নেমেছে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সও পৌঁছেছে তলানিতে। পাশাপাশি কর ও ভ্যাট কমানো, কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার শূন্যতে নামিয়ে আনার কারণে উৎপাদনের ঘাটতিসহ সব মিলিয়ে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের অবস্থা হবে কিনা তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বিরোধীদলের নেতারাও বক্তৃতার মঞ্চ গরম করছেন। অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গত ২ এপ্রিল ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত প্রাক-বাজেট আলোচনায় বলেছেন, ‘মেগা প্রকল্পের লগ্নি ফেরত না এলে বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কা হবে।’ এছাড়া ভারতের গণমাধ্যমেও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
তবে বাংলাদেশকে নিয়ে যে আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে অর্থনীতিবিদরা এসব বিষয়কে গুজব বলছেন। এসব গুজবে কান না দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন তারা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির গতি ভিন্ন। বাংলাদেশে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) বাড়ছে, রয়েছে রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ। তাছাড়া ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাত পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির মাধ্যমে যে আয় আসছে তা দিন দিন বাড়ছে। করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবক’টি সূচক ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। তাতে শ্রীলঙ্কা যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে তা বাংলাদেশে হওয়ার আশঙ্কা নেই। দেশের অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপকালে তারা এসব কথা জানান।
বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি
বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি নেই। দেশের প্রধান খাদ্য আমদানি-নির্ভর নয়। বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের পরিমাণ এবং রপ্তানি আয় দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪.৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ দুই বিলিয়ন ডলারেরও কম। তাছাড়া বাংলাদেশের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২৯২.১১ ডলার, আর শ্রীলঙ্কার মাথাপিছুু ঋণের পরিমাণ ১৬৫০ ডলার।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বিপর্যয় দেখা দেওয়ার পর বাংলাদেশকে নিয়ে যে গুজব বা আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, এ ধরনের আশঙ্কার কোনো ভিত্তি নেই। বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে। শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার কোনো কারণ নেই। এসব খামোখা কথাবার্তা; অমূলক। যা বাস্তবসম্মত নয়।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, জুনেই পদ্মা সেতু চালু হবে। মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ আরও কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলও চালু হবে এ বছরই। এসব প্রকল্প চালু হলে বাংলাদেশের উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ হবে। আমার মনে হয় আর পেছনে তাকাতে হবে না।
তিনি আরও বলেন, আমার বিবেচনায় বাংলাদেশ যেসব বড় বা মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তার একটাও অপ্রয়োজনীয় নয়; সবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সঙ্গে সঙ্গে রিটার্ন আসবে। দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। কর্মসংস্থান হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এই সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী গতি সঞ্চার করেছে, তা এখন আমরা প্রতি মুহূর্তে অনুধাবন করছি। পদ্মা সেতুসহ যেসব প্রকল্প এখন চলমান রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলেও একই ধরনের রিটার্ন পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, অযথাই কেউ কেউ নেগেটিভ চিন্তাভাবনা করছেন। এসব চিন্তার কোনো যুক্তি নেই। শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার কোনো কারণ বাংলাদেশে নেই।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রচুর খাদ্য মজুত আছে। সরকারি গুদামগুলোতে মজুত অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি, ২০ লাখ টনের মতো। কয়েক বছর বাম্পার ফলন হওয়ায় মানুষের কাছেও প্রচুর ধান-চাল মজুত আছে। তাই খাদ্য নিয়ে এক-দুই বছর বাংলাদেশকে ভাবতে হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি শ্রীলঙ্কার মতো ২০ শতাংশে ওঠার কোনো কারণ নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মতো জিডিপি আর মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি নিয়ে সারাক্ষণ ‘রোল মডেল’ দাবি আর উৎসবের খবর না পেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছুু আয় যেখানে ২৫৯০ ডলার (নতুন হিসাবে), শ্রীলঙ্কায় সেখানে ৩৮৩০ ডলার। অপরিণামদর্শী নীতি, বাণিজ্যিক ঋণনির্ভরতা বৃদ্ধি, বিচার বিবেচনাহীন মেগা প্রজেক্ট, এক পরিবারের নেতৃত্বে ব্যাপক দুর্নীতির বিস্তার আর সেই সাথে প্রতিকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে পথে বসিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় উচ্চ মাথাপিছুু জিডিপি তাকে রক্ষা করতে পারেনি বরং যে প্রক্রিয়ায় জিডিপি বাড়ানো আর তথ্য আড়াল করে ‘উন্নয়ন’ দেখানো হয়েছে সেটাই কাল হয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কায় যে বিপর্যয় হয়েছে তা বাংলাদেশে হওয়ার আশঙ্কা নেই।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট নাজনীন আহমেদ বলেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বিপর্যয় পরে বাংলাদেশকে নিয়ে যারা আশঙ্কা করছে তাদের বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়। তবে এটি একটি গুজব। এই গুজবে কান না দেওয়াই ভালো। বাংলাদেশের অর্থনীতির যত ইন্ডিকেটর আছে তা সবক’টিই ইতিবাচক। বিপরীত দিকে শ্রীলঙ্কার সকল ইন্ডিকেটরই ছিল নেতিবাচক। তাই বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করা ঠিক নয় বলেই আমি মনে করি।
বাংলাদেশের মেগাপ্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম
পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল। এসব প্রকল্প চালু হলে ভালো রিটার্ন আসবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিদেশি ঋণ চিত্র
বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বা পরিমাণ ৪ হাজার ৯৪৫ কোটি ৮০ লাখ (৪৯.৪৫ বিলিয়ন) ইউএস ডলার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৩ লাখ। এই হিসাবে মাথাপিছুু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হয় ২৯২ দশমিক ১১ ডলার। আর ২ কোটি মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের মোট পরিমাণ ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। এই হিসাবে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬৫০ ডলার। বাংলাদেশের তুলনায় শ্রীলঙ্কার জনগণের মাথাপিছু ঋণ সাড়ে ৫ গুণেরও বেশি। ২০১৪ সাল থেকেই ঋণের বোঝা বাড়তে শুরু করে ক্রমেই মুখ থুবড়ে পড়ে জিডিপি। ২০১৯ সালে বিদেশি ঋণ পৌঁছে যায় জিডিপির ৪২ দশমিক ৮ শতাংশে, বাংলাদেশে এটি ১৩ শতাংশেরও নিচে।
রেমিট্যান্স
গত জানুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কার রেমিট্যান্সের আয় হয়েছে মাত্র ২৭ কোটি ১০ লাখ ইউএস ডলার। বাংলাদেশে গত জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছে ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ ডলার এবং মার্চে রেমিট্যান্স এসেছে ১৮৬ কোটি ডলার। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারির মধ্যেও ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে। শ্রীলঙ্কা ক্যালেন্ডার বছরকে আর্থিক বছর ধরে। ২০২১ সালে দেশটিতে রেমিট্যান্স এসেছিল ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো। অর্থাৎ করোনায় শ্রীলঙ্কার প্রবাসী আয়ে ধস নেমেছে।
রপ্তানি আয়
বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত মার্চে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। গত জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কা পণ্য রপ্তানি থেকে আয় করেছে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয়ে ধস নামালেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো।
রিজার্ভ
বাংলাদেশের বিদ্যমান রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার (এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব)। আর শ্র্রীলঙ্কার রিজার্ভ দুই বিলিয়ন ডলারেরও কম। গত জানুয়ারি মাস শেষে শ্র্রীলঙ্কার রিজার্ভ ছিল ২ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার।
গত বছরের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ ছিল ৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলারের ওপরে।