বজলুর রায়হান
বাঙালির গর্ব ও গৌরবের বিশাল নান্দনিক স্থাপনা পদ্মা বহুমুখী সেতু। স্বপ্নের নয়, দৃশ্যমান পদ্মা সেতুর দ্বার আগামী ২৫ জুন যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই দিন সকাল ১০টায় বহুল আকাক্সিক্ষত এ সেতুর উদ্বোধন করবেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করার পর সেতুটি নির্মাণের চিন্তাভাবনা শুরু হয়। নানা আলোচনা-সমালোচনা এবং বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা।
শেখ হাসিনা, পদ্মা সেতু নিমার্ণে সফল রাষ্ট্রনায়ক
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, আগামী ২৫ জুন শনিবার সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। তিনি বলেন, আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদ্মা সেতুর দুটো সামারি (সার সংক্ষেপ) দিয়েছিলাম। একটা পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সামারি, যেখানে তিনি ২৫ জুন তারিখ লিখে সই করেছেন। আরেকটি ছিল পদ্মা সেতুর নাম ‘শেখ হাসিনা সেতু’ করার। সেটিতে তিনি সই করেননি। তিনি বলেছেন, পদ্মা সেতুর নাম ‘পদ্মা’ নদীর নামে হবে। এখানে কারও নাম থাকার দরকার নেই।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হতে শুরু করে পদ্মা সেতুর কাঠামো। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে বসানো হয় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর।
সকল প্রতিকূলতা পার হয়ে
সেতু নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে শুরু করে নানা গুজব মোকাবিলা করতে হয়েছে বর্তমান সরকারকে। একই সঙ্গে সরকারের মন্ত্রী, সচিব ও প্রকৌশলীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তবে সকল বাধা ও অভিযোগ পেরিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে, যা দেশবাসীকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ নিয়ে দেশের রাজনীতিতেও অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে একজন নোবেল বিজয়ী ও একটি পত্রিকার সম্পাদককে দায়ী করে অভিযোগ তোলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে পদ্মা সেতু নির্মাণের সমালোচনা করায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ারও সমালোচনা করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন বিএনপি নেতারা। বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের পাল্টা জবাব দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারাও।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি অভিযোগ করে বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ ঠেকাতে না পেরে বিএনপি এখন সেতু উদ্বোধনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের দরপত্রে প্রাক-যোগ্যতার ক্ষেত্রে অংশ নিয়েছিল ১১ প্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালের ২০ জুলাই প্রাক-যোগ্য বিবেচনায় পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের তালিকা বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিল সেতু বিভাগ। অনুমোদন না দিয়ে বিশ্বব্যাংক তিন মাস পর আবার প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের পরামর্শ দেয়।
দ্বিতীয় দফা প্রাক-যোগ্যতার জন্য আবেদন আহ্বান করার পর দরপত্রে অংশ নেয় ১০টি প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় দফায়ও প্রথমবারে মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ করা পাঁচটি প্রতিষ্ঠানই যোগ্য বিবেচিত হয়। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ওই তালিকা বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক একই বছরের ২৯ মার্চ বিশেষজ্ঞদের যাচাই-বাছাইয়ে অযোগ্য বিবেচিত চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ‘সিআরসিসি’কে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করার সুপারিশ করে।
কাগজপত্র পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা যায় না উল্লেখ করে ২০১১ সালের ৩০ মার্চ প্রতিবেদন দাখিল করে সেতু বিভাগ। ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি বিশ্বব্যাংক মনোনীত প্রতিষ্ঠানের রেকিং পাইলের অভিজ্ঞতার প্রমাণপত্র পর্যালোচনায় দেখতে পায়, অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ করা সেতুর ছবি পরিবর্তন করে সিআরসিসি নিজের নামে জমা দিয়েছে।
২০১১ সালের ৭ মে ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, সিআরসিসি মিথ্যা তথ্য দাখিল করেছে। এ অবস্থায় ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সেলরকে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অফিসে ডেকে নিয়ে সিআরসিসির চিঠি দেখানো হলে তিনি জানান, চিঠিতে উল্লিখিত স্বাক্ষর চীনা ভাষায় নকল করা। ২০১১ সালের ৯ মে সিআরসিসি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে মূল সেতুর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে।
প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকসহ চারটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা অর্থায়নে সহযোগিতার জন্য ঋণচুক্তি করেছিল সরকারের সঙ্গে। তাদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ইউএস ডলার ঋণ দিতে চুক্তি করে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল। ঋণচুক্তির ছয় মাসের ব্যবধানে ওই বছরই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি স্থগিত করে।
সমালোচনার মুখে ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর পদ থেকে সরানো হয় যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতুসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা এবং সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌসকে। এদের মধ্যে মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা, কাজী ফেরদৌসকে গ্রেপ্তার এবং সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছিল। মোশাররাফ, কাজী ফেরদৌস এবং এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ওই ঘটনায় তদন্তে নেমেছিল দুদকও। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দি নিয়ে এবং যাচাই-বাছাই করে তদন্ত শেষ করে দুদক। ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মামলার সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে উপস্থাপনের জন্য চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুমোদন করে দুদক।
‘জনগণ ও তাদের আশীর্বাদ ছিল বলেই পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি’
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) চেয়ারপারসন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে দেশের ভেতরের-বাইরের অনেক চাপ ছিল। জনগণ ও তাদের আশীর্বাদ ছিল বলেই পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি।
রাজধানীর শেরে-বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত ১ জুন একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে জানান।
সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়ে গেল। সেতু বাস্তবায়নে নানা স্ট্রাগল ও চাপের বিষয়ে একনেক সভায় খোলামেলা আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। জনগণ পাশে ছিল ও তাদের আশীর্বাদ ছিল বলেই পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হয়েছে। দেশের ভেতরের-বাইরের অনেক প্রতিকূলতা ছিল বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এসব বিষয় আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন।
একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা কাজটা করতে পেরেছি। এটা নিয়ে তিনি আনন্দে আপ্লুত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অনেক বড় বড় অর্জন আছে। তবে পদ্মা সেতু একটি অন্যতম অর্জন।
এম এ মান্নান বলেন, প্রতিটি স্থল বন্দর আরও উন্নত করতে হবে। আধুনিক স্থাপনা ও সিস্টেম বসাতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। গ্রামীণ সড়ক বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে। নতুন সড়ক বানানো প্রয়োজন। তবে বিদ্যমান সড়ক আগে সংস্কার করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো হলো পদ্মা সেতু। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। দ্বিতল এই সেতুর এক অংশ মুন্সীগঞ্জের মাওয়া এবং অপর অংশ শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যুক্ত। একই সঙ্গে রেল ও গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে এ সেতুতে। নির্মাণে মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
সেতুর নাম ‘পদ্মা’ রেখে গেজেট
পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত সেতুর নাম ‘পদ্মা সেতু’ নামকরণ করে সরকারি গেজেট হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নামে এ সেতুর নামকরণ করার দাবি উঠলেও এতে রাজি হননি সরকার-প্রধান। গত ২৯ মে সেতু বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারির পর সরকারি গেজেট জারি করা হয়।
এতে বলা হয়, সেতু বিভাগের অধীন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প’র আওতায় মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া এবং শরীয়তপুর জেলার জাজিরা প্রান্ত সংযোগকারী পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি সরকার ‘পদ্মা সেতু’ নামে নামকরণ করল।
গত ১৯ মে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, নদীর নামেই হবে এ সেতু। নামে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না- জানতে চাইলে সেদিন তিনি বলেন, ‘না না, উনি (প্রধানমন্ত্রী) বলে দিয়েছেন, পদ্মা সেতু ‘পদ্মা সেতু’ই। এটা উনি ক্লিয়ার করবেন যখন পদ্মা সেতু নিয়ে কথা বলবেন।’
২৬ জুন ভোর ৬টা থেকে পদ্মা সেতুতে চলবে গাড়ি
২৫ জুন উদ্বোধনের পর ২৬ জুন সকাল ৬টা থেকে পদ্মা সেতুতে গাড়ি চলাচল করতে পারবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত ১২ জুন মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সাংবাদিকদের নিয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু পরিদর্শনে এসে মন্ত্রী একথা জানান।
ওবায়দুল কাদের বলেন, এই সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্র করে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, জয়, পুতুল ও ববিসহ গোটা পরিবারকে অপমানিত করলো। শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, ‘আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করবো। সেদিন অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন কীভাবে সম্ভব? অনেকে আমাকে বলেছেন, তুমি এই বুদ্ধি দিচ্ছো, এটা হবে কোনো দিন? আমরাও পারি, সেটা তিনি (শেখ হাসিনা) প্রমাণ করেছেন।’
তিনি বলেন, যত সমালোচনা হয়েছে, আমাদের মনোবল আরও দৃঢ় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে। বিশ্বব্যাংক পরে বলেছে, আমাদের ভুল হয়েছে। সব ক্রেডিট শেখ হাসিনার। আমরা তার আদেশ পালন করেছি মাত্র। তিনি সেতু নির্মাণ করেছেন, বিশ্বকে জানিয়েছেন আমরা বীরের জাতি। আমরা দুর্নীতি করি না।
সমালোচকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, টোল আর টাকার কথা যারা বলেন, পুরো সংসদ চেয়েছে, এই সেতু শেখ হাসিনার নামে হোক। আমি দাবি তুলেছি, সামারিও লিখেছিলাম। তিনি নাকচ করে দিয়ে পদ্মা সেতুই রেখেছেন।
সেতুমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, ড. ইউনূস, খালেদা জিয়াসহ সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। এমন নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। এরই মধ্যে আমন্ত্রণপত্র ছাপার কাজ শেষ হয়েছে।
৬৪ জেলায় রেপ্লিকেশন
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় ৬৪ জেলায় এক সঙ্গে এর রেপ্লিকেশন হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। গত ৩০ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে তিনি এ তথ্য জানান। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ইনশাআল্লাহ সুপার গর্জিয়াস হবে। ৬৪ জেলায় এক সঙ্গে রেপ্লিকেশন হবে। এখানে অরিজিনাল উদ্বোধন, সব জায়গায় রেপ্লিকেশন হবে।
হাতিরঝিলে হবে লেজার শো
স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে ২৫ জুন রাজধানীর হাতিরঝিলে লেজার শোর আয়োজন করা হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে গত ৩ জুন জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
আগামী ২৫ জুন মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরায় হবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠান। সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান একযোগে সারাদেশে দেখানো হবে। উদ্বোধনশেষে প্রধানমন্ত্রী মাদারীপুরের শিবচরে জনসভায় বক্তব্য দেবেন। এ উপলক্ষে ওই এলাকায় ১০ লাখ মানুষের জমায়েত করার পরিকল্পনা করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ২৫ জুন থেকে ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ কয়েকটি জেলায় পাঁচ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলবে।
সেতুর উদ্বোধনে দশ লাখ মানুষ সমাগমের
প্রত্যাশা আওয়ামী লীগের
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ২৫ জুন। ওইদিন বেলা ১১টায় কাঁঠালবাড়ী প্রান্তে সমাবেশ করবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও দিনব্যাপী সেখানে নানান আয়োজন থাকবে। সেতুর উদ্বোধনের দিন আওয়ামী লীগের এ সমাবেশে ১০ লাখের বেশি মানুষের সমাগম ঘটবে বলে প্রত্যাশা করছে ক্ষমতাসীন দলটি। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ঘোষিত এ সমাবেশ সফল করতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে গত ১ জুন এক সমন্বয় বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত দলের নেতারা এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর আওয়ামী লীগের জনসভা হওয়ার কথা রয়েছে। পদ্মাপাড়ের কাঁঠালবাড়ী ফেরিঘাটে বেলা ১১টায় এ সমাবেশ শুরু হবে।
জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির শেকড়। এতে আমাদের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে। তাই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিনটি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা ও এর আশপাশ থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ আসবে। এছাড়া বরিশাল বিভাগ থেকে লোকজন আসবে।
প্রথমবারের মতো জ্বলল আলো
পদ্মা সেতুতে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বালানো হয় গত ৪ জুন বিকেলে। সেতুর ১২ নম্বর স্প্যান থেকে ল্যাম্পপোস্টগুলোর বাতি জ্বালানো শুরু হয়। ১৯ নম্বর স্প্যান পর্যন্ত একে একে ২৪টি বাতি জ্বালানো হয় বলে জানান পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের। ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতুর ভায়াডাক্টে প্রথম ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজ শুরু হয়। ৬.১৫ কিলোমিটার সেতুতে মোট ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতুতে ৩২৮টি, জাজিরা প্রান্তের ভায়াডাক্টে ৪৬টি, মাওয়া প্রান্তের ভায়াডাক্টে ৪১টি ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। মূল সেতুতে ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজ শেষ হয় গত ১৮ এপ্রিল।
সেতু দিয়ে গ্যাস লাইন, পাশ দিয়ে বিদ্যুৎ
পদ্মা বহুমুখী সেতু। এটা যে শুধু সড়ক সংযোগ করবে তা কিন্তু নয়। এর মাধ্যমে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। এজন্য সেতুর নিচ দিয়ে টানা হচ্ছে গ্যাস লাইন। সেই সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে অপটিক্যাল ফাইবার। তবে বিদ্যুতের লাইন সেতুর নিরাপদ দূর দিয়ে টানা হচ্ছে। এরই মধ্যে এসব লাইন নির্মাণে কাজ করছেন ৭৫ জন চীনের এবং ৯১০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক। তারা স্থায়ীভিত্তিতে কাজ করছেন। ৩০০-৪০০ জন শ্র্রমিক কাজ করছেন দৈনিকভিত্তিতে।
সেতুর পাশ দিয়ে বৈদ্যুতিক লাইন
পদ্মা সেতুর পাশ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে ৪০০ কেভির হাইভোল্টেজ বৈদ্যুতিক লাইন। আমিনবাজার-মাওয়া-মোংলা ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন (প্রথম সংশোধিত) উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ।
প্রকল্পটির আওতায় রিভার-ক্রসিং লাইন নির্মাণের জন্য পদ্মা নদীতে সাতটি টাওয়ারের ফাউন্ডেশন করা হয়েছে। প্রতিটি টাওয়ার ৮৩ মিটার দূরে অবস্থিত। পদ্মা সেতুর পাশ দিয়ে ৯ দশমিক ৪ কিলোমিটার ৪০০ কেভি রিভার ক্রসিং লাইন নির্মাণ হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। এর উদ্দেশ্য ঢাকা ও খুলনার মধ্যে ব্যাকবোন ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন, পদ্মা সেতুর পাশ দিয়ে ৪০০ কেভি রিভার ক্রসিং লাইন ও আমিনবাজারে ৪০০, ২৩০ কেভি উপকেন্দ্র নির্মাণ করা।
প্রথমে সেতু দিয়ে লাইন টানার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে পাশ দিয়ে লাইন নেওয়া হচ্ছে। আমিনবাজার-মাওয়া-মোংলা পর্যন্ত ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইন নির্মাণ হবে।
এদিকে মোংলা ও পায়রা বন্দরে কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্টসহ দক্ষিণাঞ্চলে অনেকগুলো পাওয়ার প্ল্যান্ট হচ্ছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় সরবরাহের জন্য সেখান থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত অপর একটি লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে পদ্মা নদী পারাপারের জন্য ১১টি টাওয়ার নির্মাণ। যার মধ্যে ৭টি টাওয়ার পদ্মা নদীর মাঝে। এগুলো স্থাপনের কাজ চলছে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায়। বাকি চারটি নির্মাণ করছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
সেতুর অবশিষ্ট কাজ শেষ পর্যায়ে
উদ্বোধনকে সামনে রেখে মেগাস্ট্রাকচারে ফিনিশিংয়ের কাজ সম্পূর্ণ করতে শেষ সময়ে চলছে দিনরাত কর্মযজ্ঞ।
মূল সেতুতে বসছে ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট। এসব ল্যাম্পপোস্টে বিদ্যুতের ক্যাবল সংযোগের কাজও শেষ পর্যায়ে। সমানতালে চলছে হ্যান্ড রেলিং বসানোর কার্যক্রম। সেতুর দুপাড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ম্যুরাল নির্মাণের কাজও চলছে।
প্রকৌশলীরা বলছেন, ১৫ জুনের মধ্যেই বাকি থাকা সব কাজ শেষ করত সক্ষম হবেন তারা। এরপরই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সেতু বুঝিয়ে দিবে কর্তৃপক্ষকে।
দু’ পাশে লাগানো হয়েছে
পৌনে ২ লাখ গাছ
প্রতিটি প্রকল্প নেওয়ার সময়ই পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ব্যতিক্রম হয়নি পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পও। সেতুর দুই দিকে বিস্তীর্ণ এলাকায় তৈরি করা হয়েছে সবুজ বেষ্টনী। এ জন্য মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে লাগানো হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৯৪টি গাছ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনা করে এ বনায়ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে নদীর পাড়জুড়ে এই বনায়নের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, নদীর পাড়কে শক্তিশালী ও নিরাপদ করা। গাছের শিকড় মাটিকে ধরে রাখতে সহায়তা করে। এ জন্য ভাঙন রোধে নদীর পাড় বাঁধাইয়ের বদলে এর উভয় পাড়ে দীর্ঘ শিকড় হয় এমন গাছ লাগানোকে উৎসাহিত করা হয়। সব মিলিয়ে নদীর পাড় রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, পর্যটন ইত্যাদি সব বিষয়কে মাথায় রেখেই পদ্মা সেতুর উভয় প্রান্তে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর সার্ভিস এরিয়া ও পুনর্বাসন এলাকাজুড়ে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কৃষ্ণচূড়া, বকুল, কাঞ্চন, সোনালু, মহুয়া, বহেড়া, অর্জুন, পলাশ ও শিমুলসহ প্রায় ১০০ প্রজাতির গাছ। এসব গাছের মধ্যে বনজ গাছ আছে ৮০ শতাংশ, ফলজ ১০ ও ঔষধি ৫ শতাংশ। এ ছাড়া সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে লাগানো হয়েছে মোট গাছের ৫ শতাংশ। ভবিষ্যতে এই এলাকা সবুজের ছায়াঘেরা একটি মনোরম পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হবে বলে আশাবাদী প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
পদ্মা সেতু এলাকায় নদীশাসনের কাজ চলমান । এই কাজ শেষ হলে আরও গাছ লাগানো হবে বলে জানালেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
পদ্মা সেতু ঘিরে ভিড় জাজিরা প্রান্তে
সড়কের কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রস্তুত পদ্মা সেতু। ২৫ জুন উদ্বোধনের পর ২৬ জুন যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এ সেতু। এরই মধ্যে সেতু ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার বাসিন্দাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে পদ্মার জাজিরা প্রান্ত।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু একনজর দেখতে এখানে প্রতিদিন বিকেলে ভিড় করছেন কয়েকশ দর্শনার্থী। কাছে যেতে না পারলেও স্মৃতি হিসেবে রাখতে দূূর থেকেই সেতুর সঙ্গে তুলে নিচ্ছেন স্থিরচিত্র। আবার কেউ করছেন ভিডিওচিত্রও।
কেউ কেউ স্মৃতির অ্যালবামে সংরক্ষণে রাখতে মোবাইল ক্যামেরায় নানা ভঙ্গিতে তুলছেন ছবি। পদ্মা সেতুুুর পূূর্ণাঙ্গ অবস্থায় দেখতে পেয়ে অনেকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছাবেদুর রহমান খোকা সিকদার বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবে এটা খুবই আনন্দের। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। পদ্মা সেতু ঘিরে জাজিরা প্রান্ত এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ২১ জেলার মানুষের আগ্রহের কেন্দ্র্রবিন্দু। অনেকেই পদ্মা সেতু একনজর দেখতে ছুুটে আসছেন জাজিরা প্রান্তে।৩
পদ্মা সেতুর যত বিশ্বরেকর্ড
পানি প্রবাহের বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরই পদ্মা নদীর অবস্থান। এমন খরস্রোতা নদীতে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সেতু তৈরি করতে পারাটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গর্বের। আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাওয়া এ সেতুু কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশ্বে রেকর্ড সৃৃষ্টি করেছে। নদীশাসন, পাইল ও বিয়ারিংয়ের ব্যবহারে পদ্মা সেতু বিশ্বরেকর্ড সৃৃষ্টি করেছে। সেতু বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
গভীরতম পাইল : খরস্রোতা পদ্মা নদীতে নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতু। পানি প্রবাহের বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরই এর অবস্থান। মাটির ১২০ থেকে ১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো হয়েছে এই সেতুতে। পৃৃথিবীর অন্য কোনো সেতু তৈরিতে এত গভীরে গিয়ে পাইল প্রবেশ
করাতে হয়নি। যা পৃৃথিবীতে রেকর্ড সৃৃষ্টি হয়েছে।
দশ হাজার টনের বিয়ারিং : দ্বিতীয় রেকর্ড হলো ভূমিকম্পের বিয়ারিং সংক্রান্ত। এই সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ এর সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
এর পরের বিশ্বরেকর্ড হলো পিলার এবং স্প্যানের মধ্যে যে বিয়ারিং থাকে সেটি। এখানে ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজনের একেকটি বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। পৃৃথিবীতে এর আগে কোনো সেতুতে এমন বড় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি।
সব থেকে বড় ক্রেন ব্যবহার : সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে পদ্মা সেতু। পিলারের ওপর স্প্যান বসাতে যে ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি আনা হয়েছে চীন থেকে। প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ গুনতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিশ্বে প্রথম কোনো সেতু তৈরিতে এত দীর্ঘদিন ক্রেনটি ভাড়ায় থেকেছে। এই ক্রেনটির দাম দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
সেতু নির্মাণে কংক্রিট ও স্টিলের ব্যবহার : পদ্মা সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়ই ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বে আর কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়নি। অর্থাৎ সেতুগুলো হয় কংক্রিটে নির্মিত, না হয় স্টিলের।
সেতু রক্ষায় নদীশাসন : অন্য রেকর্ডটি হলো নদীশাসন সংক্রান্ত। ১৪ কিলোমিটার (১.৬ কিলোমিটার মাওয়া প্রান্তে ও ১২.৪ কিলোমিটার জাজিরা প্রান্তে) এলাকা নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এই নদীশাসনে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। পদ্মা সেতু প্রকল্প তিন জেলায় বিস্তৃত। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মাদারীরপুরের শিবচর। ভাঙনসহ নানা কারণে পদ্মা সেতু যাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্যই নদীশাসন করা হচ্ছে। আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে এটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতু বিশ্বে কয়েকটি বিষয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সেটা হলো গভীরতম পাইল হয়েছে পদ্মায়। কারণ পদ্মার মতো এত খরস্রোতা নদী পৃথিবীর বুকে নেই বললেই চলে। আমরা ভূমিকম্প মোকাবিলায় যে বিয়ারিং ব্যবহার করেছি এটা পৃৃথিবীতে একটা রেকর্ড। এত বড় বিয়ারিং আগে কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। এটা প্রায় ১০ হাজার টনের কাছাকাছি। আরও একটা আছে নদীশাসন। সেতুর জন্য ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন আর কোথাও নেই। এত গভীরে আর নদীশাসনও কোথাও হয়নি।
পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
টোল দেওয়া যাবে ক্যাশ-ক্রেডিট কার্ডে
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ক্যাশের পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ডেও টোল দেওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত ১২ জুন তিনি বলেন, দুটো পদ্ধতিতেই টোল দেওয়া যাবে। ক্যাশে দেওয়া যাবে, ক্রেডিট কার্ডেও দেওয়া যাবে।
পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান সেতু বিভাগের সচিব মো. মঞ্জুর হোসেন।
সচিব বলেন, টোল আদায় ম্যানুয়াল ও অটোমেশন দুই পদ্ধতিই চলবে। প্রথমে একটি কাউন্টারে অটোমেশন হবে। পর্যায়ক্রমে অন্যগুলোতে করা হবে। তবে আমরা শুরুতে অটোমেশনে যাচ্ছি না। টোল আদায়ের যারা দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের ছয় মাস লাগবে। এরপর তারা একটি কাউন্টারে অটোমেশন চালু করবে। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে নগদ টাকা প্রদান এবং ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে টোল প্রদান করা যাবে ।
সেতু দিয়ে যাতায়াতের জন্য যে এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হয়েছে, তাতে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু করে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে টোল আদায় নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, এ বিষয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। জনগণের জন্য যে সেতু, সেই সেতুকে বোঝা হিসেবে আমরা উপহার দিতে চাই না।
দক্ষিণাঞ্চলের ১৯ জেলার গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করলে বাড়তি চাপ তৈরি হবে কি না? এ বিষয়ে সরকার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে কি না- জানতে চাইলে সেতুমন্ত্রী বলেন, দেখুন, এসব অনেক ভাবনা চিন্তা আমাদের আছে। সংশয় ছিল পদ্মা সেতু হবে কি হবে না। সেটা যখন পেরেছি, এসব চাপও আমরা ইনশাআল্লাহ মোকাবিলা করতে পারব।
সেতুর দুই প্রান্তে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ায় পুরো সড়কের মতো সেতুতেও যানবাহনের গতি নিরবচ্ছিন্ন রাখতে টোলপ্লাজায় এ আধুনিক স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটারের এই এক্সপ্রেসওয়ের কোথাও থামাতে হবে না গাড়ি। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুতে সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষ করে টোল আদায়ের ক্ষেত্রে। আমরা সেতু নির্মাণ করে দিচ্ছি, টোল আদায় করবে অন্য একটি বিভাগ। পদ্মা সেতুতে প্রথমদিন থেকেই ইটিসি বুথ কার্যকর থাকবে। ফলে ফুল স্পিডে গাড়ি যাবে এবং গাড়ির ড্যাশবোর্ডে যন্ত্র লাগানো থাকবে ওখান থেকেই সংকেতটা নিয়ে নেবে। গাড়িতে লাগানো যন্ত্রটা প্রি-পেইড, গাড়ি গেলেই টাকা কেটে দেবে। পাঁচ বছরের জন্য পদ্মা বহুমুখী সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছে যৌথভাবে কোরিয়া ও চীনের দুটি কোম্পানি। কোম্পানি দুটি হলো- কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি) এবং চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি)। কোম্পানি দুটি এজন্য মোট পাবে ৬৯২ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
পদ্মা সেতুতে টোল মোটরসাইকেল ১০০, বাস ২৪০০
পদ্মা সেতুতে টোলের হার চূড়ান্ত করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের উন্নয়ন অধিশাখা থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে মোটরসাইকেলের জন্য ১০০ এবং তিন এক্সেলের বাসের জন্য ২ হাজার ৪০০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ১৭ মে সেতু বিভাগের উপসচিব আবুল হাসান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, মোটরসাইকেলের জন্য টোলের হার ১০০ টাকা; কার, জিপ ৭৫০ টাকা; পিকআপ ভ্যান ১ হাজার ২০০ টাকা; মাইক্রোবাস ১ হাজার ৩০০ টাকা; ছোট বাস (৩১ আসন বা তার কম) ১ হাজার ৪০০ টাকা; মাঝারি বাস (৩২ আসন বা তার বেশি) ২ হাজার টাকা; বড় বাস (তিন এক্সেল) ২ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এছাড়া ছোট ট্রাকের জন্য (৫ টন পর্যন্ত) ১ হাজার ৬০০ টাকা; মাঝারি ট্রাক (৫ থেকে ৮ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ১০০ টাকা; মাঝারি ট্রাক (৮ থেকে ১১ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ৮০০ টাকা; বড় ট্রাক (তিন এক্সেল পর্যন্ত) ৫ হাজার ৫০০ টাকা; ট্রেইলার (চার এক্সেল পর্যন্ত) ৬ হাজার টাকা এবং ট্রেইলার (চার এক্সেলের অধিক) ৬ হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা যুক্ত হবে।
প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, টোলের এ হার পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচলের দিন থেকে কার্যকর হবে।