আবেদীন কাদের
আমাদের দেশের রাজনীতি এবং সমাজ জীবনকে একটি বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা রাষ্ট্রগঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনন্য ভূমিকা রয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের সাহিত্য বা শিল্প ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অনেকে নিজেদের উদ্যোগে লেখালেখি করে ভাল সাহিত্য উপহার দিয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মূল কাজ গবেষণা বা অন্যান্য লেখালেখির কাজ সে ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটু পিছিয়ে আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত এক শতাব্দীতে যে সকল গবেষণামূলক গ্রন্থ বেরিয়েছে বা যেসব প্রবন্ধ সম্বলিত গবেষণা পত্রিকা বেরিয়েছে সেসব নিয়ে আমাদের পণ্ডিতরা বেশ সমালচনামুখর। বিশ্বের জ্ঞান জগতে উপস্থাপন করার মত গবেষণা কাজ এখানে তেমন বের হয়নি বলে অনেকে বলছেন। কিন্তু আজ আরেকটা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ভাবার সময় এসেছে, কারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন বা পড়িয়েছেন এবং তাঁদের মধ্য থেকে আগামী পৃথিবী মনে রাখবে এমন মানুষ কারা ছিলেন। আমি শুধু উপমহাদেশের কথা বলছি না, তার বাইরেও যাঁদেরকে মানুষ মনে রাখবেন এমন কেউ আছেন বা ছিলেন কিনা। সকল স্মরণীয় পণ্ডিত মানুষদের সম্পর্কে আমরা জানি না। বিদেশীদের মধ্যে যারা এই
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মের পর পড়িয়েছেন, তাঁদের দুচারজন স্মৃতিকথা লিখেছেন, কিন্তু সবাই লেখেন নি। আর যারা প্রথম দিককার শিক্ষক তাঁদের কয়েকজনকে এদেশের শিক্ষিত মানুষরা জানেন, শ্রদ্ধা করেন। তবে এঁদের সংখ্যা খুবই হাতে গোণা। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক আবু মাহমুদ, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক জি সি দেব, অধ্যাপক নাজমুল করীম, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও আরও কয়েকজন আছেন যারা প্রায় সকলেই শ্রদ্ধেয়। কেউ কেউ শুধু তাঁদের পাণ্ডিত্যের জন্য, কেউ কেউ শিক্ষক হিশেবে অবদানের জন্য শ্রদ্ধেয়। কিন্তু দুচারজন আছেন বা ছিলেন, যাঁদের জীবনের ব্রত ছিল সন্তের মত, নিজেদের জ্ঞান তাঁরা শুধু ছড়িয়ে দিয়েছেন তাই নয়, একটি জনগোষ্ঠীকে সত্যিকার উজ্জ্বল শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য শ্রেণীকক্ষের বাইরেও কিছু ভূমিকা রেখেছেন। রাজনীতিতে এবং সহকর্মী এবং ছাত্রদের মাঝে উন্নত নৈতিক চরিত্রগঠনের জন্য নিজেকে উদাহরণ হিশেবে স্থাপন করেছিলেন। এমন সন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব বেশি ছিল না, কিন্তু অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বা অন্য কেউ কেউ ছিলেন। জ্ঞানী বা পণ্ডিত হয়ে, গ্রন্থ রচনা করে অনেকেই জাতির কল্যাণ করতে পারেন, কিন্তু নিজের জীবনকে একটি উদাহরণ হিশেবে সন্তের মত যাপন করে উদাহরণ সৃষ্টি করা খুব কঠিন কাজ। এর জন্য শিক্ষা এবং মেধার সঙ্গে আরও দুয়েকটি বিষয় থাকা ভীষণ জরুরি। যেমন বৈভবের প্রতি নির্মোহ থাকা, সততা বা নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেয়া এবং নিজের সমাজটিকে গভীরভাবে অন্তর দিয়ে ভালোবাসা। এসব গুণ সব পণ্ডিতের থাকে না। আমাদের সমাজে বিশেষ করে ইংরেজ শাসনামলে কেউ কেউ ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান আমলে বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন এমন মানুষ আজকাল কেন বিদ্যা পাড়ায় বা শিক্ষা জগতে নেই! এর সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বা কারণ অন্বেষণ করা যেতে পারে। আজকাল যেহেতু মানুষের জীবনবোধ এবং মূল্যবোধ বদলে গেছে নানা কারণে, তাই এধরনের মানুষ খুঁজতে যাওয়া বিফল হবে। কাল বা যুগের দাবী বদলে গেছে, আর বিদ্যা পাড়া সেই মূল্যবোধের ঢেউ থেকে দূরে থাকতে পারে না! এখন আর বিদ্যাদান কোন সামাজিক মিশন বা ব্রত নয়, এটাও পুঁজিবাদী সমাজের উৎপাদিত পণ্য এবং শিক্ষকরা এই পণ্যের বিনিময়ে সর্বাধিক মুনাফা বা মোহর দাবি করেন। এই পরিবর্তন একটি সমাজে প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে না, এর পেছনে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণ থাকে। বাংলাদেশেও তা রয়েছে। চাইলেই আজ কেউ এসমাজে আবদুর রাজ্জাক বা জি সি দেব পাবেন না। কারণ বিদেশী সংস্থায় গবেষণা-ঠিকাদার বা কনসালটেনট হয়ে আর যাই হোক আবদুর রাজ্জাক, জি সি দেব বা আবু মহামেদ হাবীবুল্লাহ হওয়া সম্ভব নয়। তাঁদের মত জ্ঞানী হয়তো হওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাঁদের মত সন্ত-শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়। কারণ জ্ঞান তাঁদেরকে সন্ত করেনি, করেছে জ্ঞানীর ‘চরিত্র’, সেটি আধুনিক পুঁজিবাদী ‘পরগাছা’ সমাজ কেড়ে নিয়েছে আমাদের অধ্যাপকদের জীবন থেকে।
আমি আর মমীন ভাই, (শামস আল মমীন) কাল সন্ধ্যায় কয়েক ঘণ্টা ধরে বিবর্ণ ও কিছুটা বিষণ্ণ আবহে বসে আলোচনা করছিলাম। আমাদের কথাবার্তায় কবিতা বা সাহিত্যই থাকে মূল বিষয়। কিন্তু সাহিত্যিকরা বা শিল্পীরা কেমন হলে আমরা বেশি পছন্দ করি সেসব নিয়েও আমরা কথা বলি প্রায় সব সময়। আমাদের দুজনেরই ভীষণ শ্রদ্ধার মানুষ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। কেন অধ্যাপক খান নিশ্চিত মার্কিনী জেল্লা, চকচকে ঝকঝকে মাখনের জীবন ছেড়ে ডিগ্রী নেয়ার পাঁচ দিনের মাথায় দেশে ফিরে গেলেন এবং গত কুড়ি বছর জীবনটাকে কীভাবে ব্যবহার করলেন, সেসব আমরা ভাবি, আলোচনা করি, বা কখনও কখনও ভিন্নভাবে বোঝারও চেষ্টা করি। মমীন ভাই সলিমুল্লাহ বিষয়ে তেমন কিছু লেখেননি, আমিও কখনও লিখিনি। কিন্তু আমরা যেহেতু চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধু, খুব কাছ থেকে মেশা এবং তাঁর লেখা প্রায় সব লেখা তন্ন তন্ন করে পড়েছি, তাই আমাদেরও কিছুটা উচিৎ তাঁকে নিয়ে সামান্য কিছু লেখা। মমীন ভাই তাও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাঁর দীর্ঘ, আমি প্রায় কিছুই লিখিনি। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বিষয়ে অনেকের উষ্মা আছে, তাঁর বক্তৃতা বিষয়ে অনেকের অনুযোগ আছে, অনেক পণ্ডিত মানুষ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য নিয়ে কেউ কেউ মনঃক্ষুণ্ণও হয়েছেন। তিনি পাবলিক ফোরামে বা মিডিয়ায় এমন অনেক মন্তব্য করেছেন যা নিয়ে আমাদের অনেকের কাছের বন্ধুদের মধ্যেও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আমরা ভেবেছি এমনটা না করলেই হয়তো তিনি ভাল করতেন, কারণ তাঁর সময়ের মূল্য আমাদের মত সাধারণ মানুষের সময়ের মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর সময় তিনি সেসব কাজে ব্যয় করলেই অনেক ভাল হত! তাছাড়া তাঁর সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ লেখার সময় তাঁর হাতে তো খুব বেশি নেই!
আজ অবধি আমি অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান সম্পর্কে গভীরভাবে মূল্যায়ন করে কোন লেখা আমার চোখে পড়েনি, হয়তো কেউ লিখেছেন। একমাত্র শ্রদ্ধেয় লেখক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী ও বন্ধু আলম খোরশেদ একটি করে গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন। যদিও সেই লেখা দুটি আরও বিশদ ও বিশ্লেষণধর্মী করে খোরশেদ ও চৌধুরী সাহেবের পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল। ছাত্রজীবন থেকে যে মানুষটি আজ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে আমাদের মনন জগতে তক্কাতক্কি করে চলেছেন, এবং লিখছেনও বেশ কিছু লেখা, তাঁকে নিয়ে কেন আমাদের পণ্ডিতরা লিখছেন না! এর কারণ অন্বেষণও প্রয়োজন মনে হয়। অনেকে বলেন তিনি গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ কোন গ্রন্থ এখনও রচনা করেননি, বা তিনি অসাধারণ বক্তা, কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে কয়েক শতাব্দী টিকে থাকবে এমন লেখা তিনি লেখেননি। আসলে কি এগুলোই কারণ, নাকি অন্য দিক থেকেও বিষয়টি আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন! সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের পি এইচ ডি অভিসন্দর্ভ, তিনিও তো এর আগে তেমন কিছু লেখেন নি, কিন্তু আমাদের বিদ্যা-জগতে সেই মনিষীর ভূমিকা এমন আকাশচুম্বী হল কী করে! একজন অধ্যাপক বা পণ্ডিতের লেখার বাইরেও একটি সমাজের মানস গঠনে যে বিশাল ভূমিকা থাকতে পারে আমরা বোধ হয় সেটাও ভুলতে বসেছি। আজ কয়েক মাস ধরে মমীন ভাই ও আমি সে বিষয়টিই বোঝার চেষ্টা করেছি সলিমুল্লাহ বিষয়ে কথা বলে, বিশেষ করে কালকের ধূসর সন্ধ্যার প্রায় পাঁচটি ঘণ্টা আলোচনা করে!
সলিমুল্লাহ খানকে আমি প্রথম দেখি শরীফ মিয়ার চায়ের দোকানে ‘৭৬ সালের শেষদিকে বা ‘৭৭ সালের প্রথমে। জাহাঙ্গীরনগরে অনার্স পরীক্ষা দিয়ে আমি প্রায় সারাদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী পাড়ায় রাজা, ডেনী, দিশু, দুলু ও আরও দুয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দেই। কেউ একজন একটি লাবণ্যভরা সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার তরুণকে দেখিয়ে বলে ছেলেটি মেধাবী ছাত্র, চট্টগ্রাম থেকে বোর্ডে প্রথম হয়ে এসেছেন। আইন পড়েন। হাফ হাতা শাদা সার্ট কোমরবন্ধহীন প্যান্টের মধ্যে গুঁজে দেয়া। জামার নীচে স্নিগ্ধ ত্বকের শরীর গেঞ্জিহীন দৃশ্যমান, ওপরের দিকে দুয়েকটি বোতাম খোলা। লম্বা চুল ঘাড় অবধি নেমে গেছে, কিন্তু বাম হাতের রুপালী ঘড়িটি রুপালী ধাতুর বেল্টে কব্জি থেকে অনেকখানি উপরে কনুইয়ের দিকে বাঁধা! পোশাক ও ঘড়ি পরার অনন্যতা তাঁর চেহারাটায় কিছুটা আলাদা রুচির ইংগিত দিয়েছে, কিন্তু ভীষণ মুগ্ধ হলাম তাঁর সঙ্গে কথা বলে। সাহিত্য তাঁর প্রিয় বিষয়, কিন্তু তাঁর চর্চার অনেকটা সময় কেড়ে নেয় সমাজচিন্তা। মার্ক্স বিষয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাঁর কথা মন দিয়ে শুনলাম। এরপর মাঝে মাঝে লাইব্রেরি পাড়ায় তাঁর কথা পাশে বসে শুনি, কিন্তু বন্ধুত্ব গভীর হয়নি। কিছুদিন পর ‘প্রাক্সিস’ নামে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাটি পড়ে ভাল লেগেছিল। এভাবেই বছর তিনেক কেটে যায়। একদিন তিনি আমাকে স্বাক্ষর করে একটি বই উপহার দেন। এটি অধ্যাপক রাজ্জাকের একটি বক্তৃতা বিষয়ে তিনি যে সমালোচনা লিখেছিলেন ‘প্রাক্সিস’ পত্রিকায়, সেটি বই আকারে বেরিয়েছে। এই সমালোচনাটি নিয়ে অধ্যাপক রাজ্জাক অনুসারীদের মাঝে একটু বিচলিতভাবের হিল্লোল উঠেছিল সে সময়ে, কিন্তু অধ্যাপক রাজ্জাকের নাকি লেখাটা পছন্দ হয়েছিল। এরপর আশির দশকের মাঝামাঝি তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকার আই বি এ-তে আসেন অধ্যাপক হয়ে। একদিন ‘শ্রাবণ’ পত্রিকার জন্য একটি লেখা চাইতে রাতে তাঁর পরীবাগের বাসায় যাই। তিনি তখন বেশ একটু বিপাকে ছিলেন সরকারী অনুমতি পেতে, সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে, তাঁর যুক্তরাষ্ট্র যেতে হবে পড়তে, নিউ স্কুলে। লেখাটা দিতে পারেন নি, কিন্তু ‘শ্রাবণ’ সম্পাদক কবি মনজুরে মওলাকে ফিরে এসে তাঁর আমলাতন্ত্র-সৃষ্ট বিপদের কথা বলি। মওলা সাহেব একটু হেসে বলেন, ‘না, কিছু হবে না। একটু ভোগাচ্ছে, পেয়ে যাবে অনুমতি।’
এরপর অনেকদিন কেটে যায়। নব্বই দশকের গোড়ায় আমি নিউ ইয়র্কে এলে আবার সলিমুল্লার সঙ্গে আড্ডা জমে সৈয়দ শহীদের বইয়ের দোকান ‘অনন্যা’য় । এসময়টাতেই কয়েক বছর ধরে ওঁকে আমি সত্যিকার চিনতে পারি কিছুটা। ওঁর পাণ্ডিত্যের সত্যিকার রেঞ্জটাও কিছুটা বুঝি। আমি হান্টার কলেজে এম এ পড়ি আর সলিমুল্লাহ নিউ স্কুলে অভিসন্দর্ভ লিখছেন। সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। তখন ওঁর জীবন কীভাবে কাটে, কী ধরনের আসুরিক ক্ষুধা তাঁর বই পড়ার, কেমন ক্ষুরধার বিশ্লেষণী ক্ষমতা ওঁর তা বুঝতে পারি। নিউ স্কুলে তখন একটি নিয়ম ছিল পি এইচ ডির ছাত্রদের একটা ইউরোপীয় ভাষা, ইংরেজির বাইরে, আবশ্যিকভাবে শিখতে হতো। আর সেই শেখার সার্টিফিকেট জমা দিতে হত। জার্মান, ফ্রেঞ্চ, বা ইটালিয়ান যে কোন একটি ভাষা। সলিমুল্লাহ তখন নিউ স্কুল পাড়ার পুরনো বইয়ের দোকানগুলো তন্নতন্ন করে ঘোরেন আর বই সংগ্রহ করে পড়েন। ওঁর মাথায় এলো অংক শিখবেন। একাডেমীক এফেয়ার বিভাগে গিয়ে তিনি জানান যে ইউরোপীয় ভাষার বদলে তিনি অংক শিখবেন। তারা তো অনুমতি দিতে চান না। পরে সলিমুল্লাহর সঙ্গে তক্কাতক্কি। সলিমুল্লাহ তাদেরকে সিগনিফায়ার ও সিগনিফায়েড তত্ত্ব ঝেড়েছিলেন কিনা আমি জানি না, কিন্তু তারা ওঁর যুক্তি শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ওঁর যুক্তি ছিল অংক আসলে একটি ‘ভাষা’। এরপর ওঁর সুপারভাইজার ওঁর অভিসন্দর্ভের কিছুটা পড়ে দেখেন সলিমুল্লাহ ইংলনডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি বিষয় বলতে গিয়ে জাঁক লাকার একটি তত্ত্বের উল্লেখ করেছেন, অধ্যাপক কিছু বুঝতে পারেন না। তখন তিনি সলিমুল্লাহকে ব্যাখ্যা করতে বলেন। সলিমুল্লাহ ব্যাখ্যা করেন, তিনি না মেনে পারেন নি। কিন্তু তিনি পরামর্শ দেন এই অধ্যায়ের আগে জাঁক লাকার তত্ত্বটি সম্পর্কে কয়েক পাতা লিখতে।
এধনের ঘটনা তাঁর ক্ষেত্রে আগেও ঘটেছে। নিউ স্কুলের কোর্সগুলো করার সময় যে পেপারগুলো জমা দিতেন, সেসব লেখা নিয়ে অধ্যাপকরা সন্দেহ করতেন, তাঁরা ভাবতেন সলিমুল্লাহ এগুলো নিজে লেখেন নি, কারো কাছ থেকে টুকেছেন। সলিমুল্লাহ হাসতে হাসতে আমাদের বলতেন, ‘এঁদের নিয়ে তো মহাবিপদ হল আমার!’
তাঁর নিজের বিষয় আইনশাস্ত্র, নিউ স্কুলে পি এইচ ডি করলেন অর্থশাস্ত্র নিয়ে। বছর তিনেকের মধ্যে কোর্সওয়ার্ক শেষ করে কম্প্রিহেন্সিভ শেষ করে ফিল্ড স্টেটমেন্ট লিখে বছর খানেকের মধ্যে অভিসন্দর্ভ শেষ করে বাড়ি যেতে পারতেন ডিগ্রী নিয়ে। কিন্তু এর মাঝে তাঁর নেশা জাগলো দর্শনটা ভাল করে পড়বেন। কয়েক বছর ধরে ইউরোপীয় দর্শনে বুঁদ হয়ে রইলেন। সারাদিন বই পড়া আর সপ্তাহে ঘণ্টা তিন চারেক পড়ানো। এই করে তাঁর কেটে গেল কয়েক বছর। ঘরের মেঝে থেকে ছাত স্পর্শ করছে বইয়ের স্তূপ। বইয়ের সঙ্গেই তাঁর বসবাস। মাঝে মাঝে সেই সুদূর ব্রঙ্কস থেকে আসেন জ্যাকসন হাইটসে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। আমরা কিছুটা ঋদ্ধ হই, কিছুটা বিস্ময়ের ঘোর লাগে। নিউ স্কুল দশ বছরের বেশি সময় দেয় না ডিগ্রী শেষ করতে। সে সময় পেরিয়ে যায়, বার বার তাঁকে নোটিস দেয়, কিন্তু সলিমুল্লাহ বর্ধিত সময়ের জন্য আবেদন করেন। তখন তাঁর অস্থি-মজ্জা জুড়ে দর্শন ও সমাজতত্ত্ব লেপটে আছে, অভিসন্দর্ভ লেখার সময় কোথায় তাঁর। এভাবে বছর তিনেক কাটলে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ চিঠি ধরিয়ে দেয়। সলিমুল্লাহও দরোজা জানালা বন্ধ করে মাস কয়েকের মধ্যে লিখে ডিফেনড করে ঢাকার টিকিট কাটেন। যে ডিগ্রী তিনি চার বছরেই শেষ করতে পারেন, সেটা ফেলে রেখে প্রায় চৌদ্দটি বছর মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান শাখার কয়েকটি বিষয়ে নিজেকে সত্যিকার পণ্ডিত হিশেবে তৈরি করে দেশে ফিরে যান।
প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অগণিত বিভাগে ছেলেমেয়েরা প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়, অধ্যাপক হয়। তাদের সঙ্গে সলিমুল্লাহর মৌলিক কিছু জায়গায় পার্থক্য আছে। নিজেকে নিয়ে মশকরা করার অশেষ ক্ষমতা তাঁর। যাকে পণ্ডিতরা বলেন Self-dersion. ঢাকার অনেক অধ্যাপকের নাম ধরে তিনি গণমাধ্যমে বলেন তাঁরা তাঁকে চাকুরী দেননি, কারণ তিনি চার বছরের ডিগ্রী করতে চৌদ্দ বছর লাগিয়েছেন। তার উত্তরে সলিমুল্লাহ বলেন, ‘আমি পারিনি, ফেল করেছি, তাই এতদিন লেগেছে।’ কিন্তু যারা সলিমুল্লাহর নিউ ইয়র্কের জীবন নিয়ে কিছুটা জানেন, তাঁরা বলতে পারবেন চৌদ্দটি বছর তিনি কীভাবে ব্যয় করেছেন, বাড়ি ফেরার সময় কয়েক হাজার বই নিয়ে আসলে তিনি কী করেছেন!
আমাদের মত সাধারণ মানুষরা একটি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হিমশিম খাই, কিন্তু সলিমুল্লাহ আইন, অর্থশাস্ত্র, সমাজতত্ত্ব, ফরাসী ইতিহাস বা ইউরোপের ইতিহাস, এবং সবশেষে তাঁর অন্তরের খুব কাছের বিষয় সাহিত্য বিষয়ে এক অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। এত বিষয়ে এমন গভীর জ্ঞান আমাদের সমাজে আর কারো আছে বলে আমি জানি না। আমি নিউ স্কুলের ছাত্র ছিলাম বলে সেখানকার নিয়ম কানুন কিছুটা জানি। জার্মান ঘরানার এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ডিগ্রী দেয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রদের হাড়-মাংস কেমন ছিবড়ে আলাদা করে ফেলে, তার কিছুটা আমি বুঝেছি। সলিমুল্লাহর কথা ভাবলেই আমার এক ছাত্রীর কথা মনে আসে। ২০০৬ সালে আমি সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন্স কলেজে সোশ্যাল থিওরি পড়াই। একটি ইহুদী তরুণীকে দেখি আমার থিওরি ক্লাসে। ভীষণ মেধাবী। পরের সেমিস্টারে আমি একই কলেজে গ্রাজুয়েট ক্লাসে থিওরি পড়াই, দেখি মেয়েটি সেখানেও উপস্থিত। এরপর একদিন আমার অফিস ঘরে সে আসে একটি বই নিতে, জিজ্ঞেস করলাম সে গ্রাজুয়েট ক্লাসে কেন। জানালো তার মা তাকে ল’ স্কুলে পাঠাবে। তাই সে ভাবলো একটু মানবিক শাখার সকল বিদ্যায় একটু Well-grounded হয়ে আইন পড়তে যাবে। সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এ ডিগ্রীর জন্য ১২৮ ক্রেডিট দরকার। ততদিনে মেয়েটি ১৯৮ ক্রেডিট করে ফেলেছে Well-grounded হওয়ার জন্য। চাইলে এই ক্রেডিটগুলো দিয়ে বা এই সময়ে পি এইচ ডির সব কোর্স শেষ করতে পারতো সহজেই। আসলে সলিমুল্লাহ খান হলেন আমাদের সমাজে একমাত্র ব্যক্তি যিনি মানবিক বিদ্যার প্রায় সকল বিষয় রপ্ত করা এক Well-grounded পণ্ডিত, যেমনটা আমরা আগে কখনও দেখিনি। জীবনের প্রায় শেষদিকে এসে তিনি কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষা শিখলেন, অনুবাদ করলেন সেসব ভাষার কিছু সাহিত্য। বুকে, মাথায় আর কব্জিতে কতোটা শক্তি থাকলে একজন পণ্ডিতের এত কাজ করার ক্ষুধা থাকতে পারে সেটাই আমার বিস্ময়!
মমীন ভাই আর আমি আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম, সেটি হল সলিমুল্লাহর সঙ্গে বহু বিষয়ে আমরা দ্বিমত করতে পারি, করিও, কিন্তু তাঁর যুক্তি খণ্ডন করা সত্যিই দুরূহ। সে জন্যই মমীন ভাই বলেন, সলিমুল্লাহ ঢাকার পণ্ডিত মহলে এক ‘টেরর’, তিনি প্রায় আমাদের পণ্ডিত সমাজকে টেররাইজ করে ফেলেছেন। এক মঞ্চে অন্য পণ্ডিতরা কথা বলতে ভয় পান।’ তাঁকে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে তাঁর মুখ থেকে কামানের গোলার মত যেসব কথা বেরোতে থাকে তার সামনে দাঁড়ানো প্রায় বাঙালি পণ্ডিতদের অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া ভাই সলিমুল্লাহকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কয়েক বছর আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ যে কী এক অসাধারণ স্মৃতিশক্তি আর বিশ্লেষণ ক্ষমতা দিয়ে ওঁকে বানিয়েছে, ভাবা যায় না!’
রাজনীতি বা সাহিত্যের বহু বিষয়ে আমি তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করি, কিন্তু তাঁর মতকে আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি! পশ্চিমা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কিছু জগৎ বিখ্যাত পণ্ডিত দেখেছি। কিন্তু সলিমুল্লাহর মত ক্ষুরধার পণ্ডিত আমি সত্যিই কম দেখেছি। তবে এসব কিছু আমার কাছে পূজনীয় নয়, তাঁর যে গুণটিকে আমি অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করি, সেটা হল একজন পণ্ডিতের যে নৈতিক অবস্থান থাকা জরুরি, সেটা তাঁর আছে। এবং জাগতিক বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্মোহ থেকে শুধু জ্ঞানচর্চা করেই তিনি একটি জীবন পার করে দিচ্ছেন। তাঁর পক্ষে যতটুকু সম্ভব সবটুকুই আমাদের তরুণ ছাত্র সমাজকে দিচ্ছেন। আজকাল প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে তিনি নিজের ভাবনাগুলোকে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু আরেকটি জরুরি কাজ মনে হয় তাঁর করা প্রয়োজন, তাহলো যেহেতু আয়ু তাঁর অসীম নয়, তাই তাঁর পরিকল্পিত বইগুলো লেখার জন্য আরেকটু বেশি সময় দেয়া। শতাব্দীকাল বেঁচে থাকার মত বই লেখার ক্ষমতা, মেধা এবং প্রস্তুতি সবই তাঁর আছে, এখন প্রয়োজন দরোজা জানালা বন্ধ করে টেবিলে বসা। আমার বিশ্বাস তলোয়ার দিয়ে দাড়ি কামানো তাঁকে সাজে না! তাঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা!