বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন আরা লেখা; যিনি ২০২৩ সাল থেকে উত্তরা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে তাঁর অগাধ অভিজ্ঞতা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি গড়ে তুলেছেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি অল্প সময়েই উত্তরা ইউনিভার্সিটিকে সমৃদ্ধ এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন। বরেণ্য শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, খ্যাতিমান উদ্যোক্তা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. এম আজিজুর রহমান ছিলেন তাঁর নির্ভরযোগ্য সহযাত্রী। তিনি উত্তরা ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য এবং বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্মাণে ড. ইয়াসমীন আরা লেখা’র অঙ্গীকার ছিল অটল, যা কোভিড-১৯ মহামারির সময় তাঁর কার্যকর নেতৃত্বের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। ড. লেখার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন অব্যাহত রাখে এবং শিক্ষকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে।
প্রফেসর ড. ইয়াসমীন আরা লেখা শিক্ষার গণ্ডির বাইরে ব্যবসা ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক উদ্যোগেও সক্রিয়, শিক্ষাক্ষেত্রে জবাবদিহিতা এবং ন্যায়পরায়ণতার এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মাননা ও মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর গবেষণা ও লেখাগুলো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অধ্যয়ন করা হয়, যা ড. লেখা’র চিন্তার গভীরতা ও প্রজ্ঞার পরিচায়ক।
১৯৭০ সালের ৯ জুলাই জন্মগ্রহণকারী ইয়াসমীন আরা লেখা শুধু একজন শিক্ষাবিদ নন, বরং অনুপ্রেরণার প্রতিচ্ছবি। তাঁর একাডেমিক উৎকর্ষ, নেতৃত্বের মেধা এবং মানবতার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা তাঁকে আলাদা মাত্রায় উন্নীত করেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত করতে তাঁর অবিরাম প্রচেষ্টা আমাদের শিক্ষা, সমাজ ও জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
অর্থকণ্ঠ : উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের দেশেও শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। শিক্ষার আধুনিকায়নে কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন আরা লেখা : শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নের জন্য আমাদের প্রয়োজন প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী জ্ঞান প্রদান। বিশেষ করে, ডিজিটাল লার্নিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি, কারিগরি ও উচ্চশিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। উত্তরা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে আমি বলতে পারি, পড়াশোনার পাশাপাশি এই ইউনিভার্সিটিতে খেলাধুলা, ডিবেট, সামাজিক কার্যক্রম ও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও জোর দেয়া হয়। আমাদের একটি হিউম্যানিটিজ ল্যাব আছে, যেখানে গেলে যেকোনো মানুষের মন ভালো হয়ে যাবে অল্প সময়েই।
এছাড়া ফুল টাইম কাউন্সেলিং করার জন্য কাউন্সিলর ও স্টাফ আছেন যারা শিক্ষার্থীদের সাপোর্ট দিয়ে থাকেন। আমাদের অনেক গ্র্যাজুয়েট আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে সফলতার সঙ্গে কাজ করছে। তবে বৈশ্বিক বাজারে যে হারে জব পাওয়ার কথা সে সংখ্যাটা তুলনামূলক কম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়নমূলক কোর্স চালু করা হয়েছে ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতিতে সহায়তা করতে নিয়মিত কর্মশালা আয়োজন করা হচ্ছে।
অর্থকণ্ঠ : উচ্চশিক্ষার গুণগত মানের বিষয়টির সাথে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় ল্যাব, শিক্ষার উপকরণসহ শিক্ষার অধিকারের প্রতিষ্ঠায় সমতার প্রসঙ্গ উঠে আসে। কিন্তু সেই পরিবেশ কি গড়ে উঠেছে?
অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন আরা লেখা : দেশে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন পূর্বের তুলনায় অনেক এগিয়েছে। বিশেষ করে এখন অধিকাংশ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলে গিয়েছে। আর প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যে তৈরি এবং এখানে ল্যাব, লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভৌত সুবিধাদি অনেকটাই বিস্তৃত। যদি উত্তরা ইউনিভার্সিটির কথা বলি তাহলে বলবো, এখানে ৫০টির বেশি ল্যাব রয়েছে আর শিক্ষার সকল আধুনিক উপকরণ তো আছেই। মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি উত্তরা ইউনিভার্সিটি বড় একটি বিশেষত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবান্ধব। এখানে শিক্ষার্থীরা সহজেই শিক্ষকের কাছে আসতে পারে, শিক্ষকরা সহজেই ম্যানেজমেন্টের কাছে আসতে পারেন। আমাদের টিম স্পিরিটটা অনেক ভালো যার ফলে যেকোনো কাজে হাত দিলেই সাফল্য আসছে। সম্প্রতি প্রচুর বিদেশি ডিগ্রিধারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে, যাঁরা গবেষণার কাজও করছেন। শিক্ষক নিয়োগের পর নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান থাকে। পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য আন্তর্জাতিক কর্মশালা, সেমিনার ও গবেষণা সহযোগিতা প্রদান করা হয় যাতে তাঁরা বৈশ্বিক মানের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। শিক্ষার উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। দিন যত যাবে এর আধুনিকায়ন তত হবে।
অর্থকণ্ঠ : আগামী দিনে শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে আপনার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন আরা লেখা : শিক্ষার মানোন্নয়ন, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, বৈষম্য কমানো এবং গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ইউনেস্কোর প্রস্তাবিত জিডিপির ৪%-৬ % ব্যয় বরাদ্দের বিপরীতে বাংলাদেশের শিক্ষায় ব্যয় জিডিপির ২.১% যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় কম।
আমাদের সুদূরপ্রসারী ভাবনা, পরিকল্পনা, পদক্ষেপ ও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হতে হবে শিক্ষা খাতে। এ কথা স্বীকার করেই আমাদের এগোতে হবে যে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের চলমান যুগে যে পরিমাণ দক্ষ ও সৃজনশীল জনবল প্রয়োজন, তা আমরা এখনো গড়ে তুলতে পারিনি। অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমন মানবসম্পদ সৃষ্টি করা, যারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে নিজ নিজ দেশের জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারবে। টেকসই উন্নয়ন অর্জনে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ, গবেষণা ও নীতি প্রণয়ন জরুরি।
অর্থকণ্ঠ : বাংলাদেশের বড় সম্পদ তারুণ্যনির্ভর শিক্ষার্থী। তাদের কর্মমুখী নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার প্রসারে আরও কি কি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন আরা লেখা : একটি দেশের তরুণ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়ানো, স্টার্টআপ কালচার গড়ে তোলা, ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা এবং শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। সেই ধারাবাহিকতায় ইন্ডাস্ট্রি ও অ্যাকাডেমিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে কাজ করছে উত্তরা ইউনিভার্সিটি। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক জ্ঞানকে ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে দক্ষতায় রূপান্তর করতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে এ বিষয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (MoU) স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিংয়ের সুযোগ তৈরি করেছে। আমাদের এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স অফিস শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশীপ ও জব করার সুযোগ করে দেয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এক্সপার্ট ব্যক্তিবর্গ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। সম্প্রতি আমরা এইচআর সামিট আয়োজন করেছি, যেখানে বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের এইচআর বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণ করেছেন। ইন্ডাস্ট্রি ও অ্যাকাডেমিয়ার মধ্যে সরাসরি সংযোগের মাধ্যমে আমরা ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা জেনে কারিকুলাম ডেভেলপের চেষ্টা করছি।
অর্থকণ্ঠ : শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কতখানি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন?
অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন আরা লেখা : আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে, উদ্যোক্তা তৈরি হবে এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সহজ হবে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রদানে দ্রুত বিকাশমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিকাশের সূত্র ধরে উচ্চশিক্ষার্থে শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাওয়ার হার কমে আসছে। এখন বাইরের দেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশে পড়তে আসছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে এবং অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এদের মধ্যে ১৬ শতাধিক বিদেশি শিক্ষার্থী। তুলনামূলকভাবে এ সংখ্যা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেশি। গত তিন দশকে উল্লেখযোগ্য হারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে। ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। এর মধ্যে শিক্ষক রয়েছেন ১৫ হাজার। ৭৭ শতাংশ শিক্ষক পূর্ণকালীন দায়িত্ব পালন করছেন। অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার পরিবর্তে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ফলে মেধা পাচারও কমেছে।
অর্থকণ্ঠ : আগামীর বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা কেমন হবে প্রত্যাশা করেন?
অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন আরা লেখা : একটি প্রযুক্তিনির্ভর, গবেষণামুখী, দক্ষ ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে শিক্ষার্থীরা গ্লোবাল মার্কেটে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে। সরকার যদি গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং শিক্ষার আধুনিকায়নে কাজ করে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও দক্ষ হয়ে উঠবে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জান্নাতী ফেরদৌসি মীম