বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের উন্নত দেশ ব্রিটেনে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের অনেকেই সে দেশের খ্যাতিমানদের তালিকায় নিজেদের নাম সংযোজিত করতে সক্ষম হয়েছেন – তাঁদেরই একজন এনাম আলী এমবিই। তিনি ব্রিটেনের কারি শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোক্তা এবং ইতোমধ্যেই তিনি নিজ কর্মদক্ষতায় লাভ করেছেন সেদেশের অন্যতম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এমবিই।
১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণকারী এনাম আলী ১৯৭৫ সালে আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্যে লন্ডন যান। কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়াশোনায় ব্র্রতী হন।
তিনি সেখানকারBournemouth College থেকে হসপিটালিটি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনাকালীন এনাম আলী শুধুমাত্র হাত খরচের জন্যে এক আত্মীয়ের রেস্টুরেন্টে ছুটির দিনে কাজ শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের কথা, সপ্তাহে দুই দিন কাজ, বিশেষ করে শনিবারেই মূূল কাজ। আসলে পকেট মানির জন্যে কাজ করতাম। তখন ঘৃণাক্ষরেও ভাবিনি কোনো দিন রেস্টুরেন্টের মালিক অথবা এই ব্যবসায় সম্পৃক্ত হবো। ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরবো। কিন্তু পরে দেখলাম এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে মন্দ হবে না। কারি শিল্পের এই স্বনামধন্য উদ্যোক্তা ব্যক্তিত্ব তাঁর নিজ দক্ষতা ও ব্যবসায়িক বিস্তৃতির স্বীকৃতিতে ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড-২০১৪ অর্জন করেছেন।
আলো ঝলমলে জাঁকজমকপূর্ণ এই অনুষ্ঠানে তিনি শুধু নিজেই আলোকিত হননি, বাংলাদেশকেও আলোকিত করেছেন, আলোকিত হবার সুযোগ এনে দিয়েছেন ১৬ কোটি মানুষকে। তাঁর হাতে যেন যাদু আছে, তিনি যখন যে কাজেই হাত দিয়েছেন সেটাই পত্রল্লাবে পল্লবিত হয়েছে- যা তাঁর কাজের অনুপ্রেরণাকে বাড়িয়ে দিয়েছে শতভাগ। পড়াশোনা শেষে ১৯৮৯ সালে এনাম আলী Epsom Surrey তে Le Raj Restaurant প্রতিষ্ঠা করেন। এই রেস্টুরেন্টটিকে তিনি অত্যন্ত আধুনিকভাবে সাজান। যে কোনো বিদেশি মানুষ এই রেস্টুরেন্ট দেখেই এতে খাবার ইচ্ছে পোষণ করেন। ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের একমাত্র অফিসিয়াল খাদ্য সরবরাহকারী লি রাজ রেস্টুরেন্ট সারা বিশ্ব থেকে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাষ্ট্র্র এবং ক্রীড়াবিদদের কাছ থেকে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এরপর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই এটি ব্রিটেনের অন্যতম কারি রেস্টুরেন্ট হিসেবে সুনাম অর্জনে সক্ষম হয়। এমনকি সে বছরই Michelin rating-এ সারা বছর শীর্ষ পর্যায়ে থাকে। তার এই রেস্টুরেন্টে নামি-দামি সেলিব্রেটিস, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং দেশ-বিদেশের তারকারা খেতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। এতে এই রেস্টুরেন্টের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বের নামী-দামি খেলোয়াড় এবং তারকারা ভিড় জমায়। তিনিও এই কারি শিল্প জগতে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। তিনি বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন তাঁর বিখ্যাত খব Le Raj Restaurant – এর সাফল্যের জন্যে। তিনি আরও রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটেনের প্রেস্টিজিয়াস রেস্টুরেন্ট-এর কারণে Confrerie de la Chaine des Rotisseurs এর স্বীকৃতি তাঁকে এনে দেয় আরও সুখ্যাতি, তিনি হয়ে ওঠেন কারি শিল্পের অন্যতম তারকা। এশিয়ান রেস্টুরেন্টের মধ্যে এই স্বীকৃতি তিনিই প্রথম লাভ করেন। তাঁর রেস্টুরেন্ট এবং তাঁর ওপর ব্রিটেনের অনেক উল্লেখযোগ্য মিডিয়া কভারেজ নিয়ে আসে। এশিয়ান কমিউিনিটিতে এই ইতিবাচক সাফল্যের কার্যক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য একজন। কারণ, এসব মিডিয়ার কোনো কোনোটির পাঠক এক লাখেরও ওপরে যারা তার রেস্টুরেন্টের খোঁজ জানতে পারেন। এবং অনেকেই মন্তব্যও করেন।
সারা বছরই তাঁর রেস্টুরেন্টের হাইলাইটস হতে থাকে এবং কারি শিল্পে তাঁর ভূমিকা ও সাফল্য হয়ে ওঠে ঈর্ষণীয়। তাঁকে ঘিরে এই সাফল্যের প্রচারণায় বাংলাদেশও স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশের ইমেজও বৃদ্ধি পায়। এটি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে,spice restaurants হিসেবে ব্র্রিটিশ বাংলাদেশিরা ইন্ডিয়ানদের চেয়েও এগিয়ে যেতে থাকে। এর পেছনে এনাম আলি এমবিই এর অবদান অনেক। কারণ, এই মানুষটি এই কারি শিল্পকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষ শুধু ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্যে খায় না, খাদ্য যদি সুস্বাদ হয়, পরিবেশনা যদি স্ট্যান্ডার্ড হয় তবে খাবারও যে একটি শিল্প সে বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এখন মানুষ এখানে খাবার একটা টান অনুভব করে এবং অন্যদেরকেও সেখানে নিয়ে আতিথ্য করার ইচ্ছা পোষণ করে। সে ক্ষেত্রে এনাম আলী তাঁর Raj এবং Spice Business এর ক্ষেত্রে ব্রিটেনে একটি বড় জায়গা দখল করতে সক্ষম হয়েছেন- যা তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যকেও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছে। ইতোমধ্যে তাঁর ব্যবসায়িক বিস্তৃতির সাফল্য তাঁকে এখাতে ১.৩ মিলিয়ন পাউন্ডের ব্যবসার সুযোগ এনে দিয়েছেÑ যা কারি শিল্পের জন্যে নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি।
জনাব এনাম আলী ব্যবসায়িকভাবে যেমন সফলতা অর্জন করেছেন তেমনি সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অবদান ও ভূমিকা রেখে চলেছেন। তিনি বাংলাদেশে বিভিন্ন দুর্যোগময় মুহূর্তে যেমন বাংলাদেশে বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় ফান্ড গঠন করেছেন এবং তা বিতরণ করে দুর্গত মানুষের উপকার করেছেন। তিনি ব্রিটেনেও Anthony Nolan Trust, the Victims of Typhoon Haiyan, BBC Children In Need and the Weir Archer Academy সহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনকে সহায়তা প্রদান করে থাকেন।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে এনাম আলী ব্রিটেনের রানি কর্তৃক হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিতে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ MBE পদক লাভ করেন, ২০১১-তে লন্ডন অব সিটি কর্তৃক ফ্রিডম পদক লাভ করেন। একজন মুসলিম হিসেবে তিনিই প্রথম এই ঐতিহাসিক সম্মাননা লাভ করেছেন- যা ১২৩৭ সাল থেকে সূচনা হয়েছে।
এই মহতী উদ্যোক্তা ব্যক্তিত্ব এনাম আলী মনে করেন, তাঁর এই স্বীকৃতি তাঁকে কাজের ক্ষেত্রে আরও অনুপ্রাণিত করছে। মনের দিক থেকে অত্যন্ত উদার এবং কাজের ক্ষেত্রে গতিশীল এই মানুষটির সকল চিন্তা-চেতনা জুড়ে কারি শিল্পের উন্নয়ন বিষয়টি প্রধান্য পায়। তিনি মনে করেন, বিশ্বের উন্নত এই দেশটিতে বাংলাদেশিদের কারি শিল্প এবং স্পাইস বিজনেস এর প্রাধান্য যতো বেশি হবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ততো উন্নত হবে। তিনি বিনয়ের সাথে বলেন, ব্রিটিশরাসহ বিদেশিরাও এখন বাংলাদেশের খাবার পছন্দ করেন। রাষ্ট্রীয় অনেক অনুষ্ঠানেও বাংলাদেশি খাবার তারা নিয়ে যান এবং অতিথি আপ্যায়ন করেন। আবার কখনো কখনো খব জধল Le Raj Restaurant-এ ছুটে আসেন, লাইনে দাঁড়িয়ে পর্যন্ত এখানে খেতে তৃপ্ত হোন। একজন এনাম আলী এমবিই এখন শুধুমাত্র ব্যক্তি এনাম আলী নন, তিনি এখন বাংলাদেশের গর্ব, এদেশের কৃত্রি সন্তানদের তালিকায় তাঁর অবস্থান স্বীকৃত হয়েছে।
২০১৪ সালে তিনি এনআরবি পার্সন অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হয়েছেন। মূলত ২০০৫ সালেই তিনি যোগ্যতা অর্জন করে নিয়েছেন এবং বছর বছর তাঁর উন্নয়নের সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার প্রবণতায় তিনি নিজেকেই নিজে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন, সৃষ্টি করছেন নতুন নতুন অগ্রযাত্রার ইতিহাস। তিনি কারি ব্যবসাকে কারি শিল্পে পরিণত করার অন্যতম রূপকার। এনাম আলী এমবিই এর আরেকটি বড় পরিচয় তিনি কারি অস্কার খ্যাত ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড-এর জনক। তিনি ২০০৫ সালে এই অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করেন। কারি অ্যাওয়ার্ড-এর এক অনুষ্ঠানে সাবেক ব্র্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন জানান, দক্ষিণ এশিয়ার এই শিল্পের অভ্যুদয় ঘটলেও বিকাশের গুণে এ মুহূর্তে তাদের ছাড়িয়ে অনেক দূর পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছে ব্রিটেনের কারি শিল্প। তিনি আরও মন্তব্য করেন, এটি এখন ব্রিটেনের জাতীয় ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতীয় অগ্রগতির পথে সাফল্যের মাইলফলক স্থাপনে ব্র্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডের অনবদ্য কৃতিত্বের জন্যে বার্ষিক এ আসরকে কারি অস্কার অভিধায় ভূষিত করেন ডেভিড ক্যামেরুন।
ব্রিটেনে পৃথিবীর বহু দেশের বহু জাতির লোকের বাস। তবে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাঙালি বিশেষ করে বাংলাদেশি মন্ডলীদের পরিমাণ ৫ লাখেরও বেশি। এক সময় ব্রিটেনের বাংলাদেশিদের বলা হতো বাংলাদেশি ব্রিটেন। কারণ, তাদের জন্মস্থান ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। এখন অসংখ্য বাঙালি ব্রিটিশ রয়েছেন যাদের জন্মটা ব্রিটেনেই। সে ক্ষেত্রে তাদের বলা হয়, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্র্রিটিশ। তারা ব্র্রিটেনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে একটি ব্যবসা যে একটি কমিউনিটিকে স্বতন্ত্র পরিচয় এনে দেয় সেটি প্রমাণ করেছেন ব্র্রিটিশ বাংলাদেশিরা। নীরব বিপ্লবের মাধ্যমে তারা পাল্টে দিয়েছেন ইংরেজ জাতির খাদ্যাভ্যাসকে। কারি শিল্প ব্রিটেনের এক বিশাল স্থান দখল করে নিয়েছে। আগে যেমন সামর্থ্যবান বাঙালিরা খুঁজে ফিরতেন অনেক দেশের বড় বড় রেস্টুরেন্ট এখন যেন ব্রিটেনের রাজপরিবার থেকে শুরু করে পার্লামেন্টিরিয়ান এবং বিভিন্ন দেশের বৃটেনে অবস্থানকারী নাগরিকরা খুঁজে নেন কারি রেস্টুরেন্ট। অনেক এমপি তাদের অনুষ্ঠানকে আরো রঙময় করার লক্ষ্যে তাদের অনুষ্ঠানের মেনুতে খাবার হিসেবে কারি রাখেন। ব্রিটেনের আনাচে-কানাচে এখন চিকেন টিক্কা মাসালার জয় জয়াকার।
ব্র্রিটেনের বিভিন্ন এলাকায় এখন প্রায় ১২ হাজার ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট রয়েছে যার অধিকাংশেরই মালিক ব্র্রিটিশ বাংলাদেশিরা। বাঙালির তৈরি চিকেন কারি এখন ব্রিটেনের জাতীয় পদ ব্র্রিটেনের অর্থনীতিতে বছরে ৪.২ বিলিয়ন পাউন্ড বিজনেস এখন কারি শিল্পকে ঘিরে। আর ব্র্রিটিশ কারির নাম বললেই একজন এনাম আলীর নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় তাঁর অবদানকে, যিনি কারি শিল্পকে মেধা ও মনন দিয়ে এই উচ্চ মাত্রায় তুলে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। অনেকেই তাঁকে ‘কারি শিল্পের যুবরাজ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কারণ, এক সময় তাঁর নেতৃৃত্বেই বাংলাদেশি মালিকেরা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট না লিখে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট হিসেবে নিজেদের পরিচিতিকে স্বীকৃত করেন। এ ক্ষেত্রে ডাইন বাংলাদেশ ক্যাম্পেইনের কার্যক্রমকে তিনি গতিশীল করেছেন। গিল্ড অব বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এই শিল্পকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছেন। জনাব এনাম আলী টেরাক লিমিটেডের প্রধান উপদেষ্টাদের একজন। প্রতিষ্ঠানটি জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করছে।
জনাব এনাম আলী ২০০৬ সালে সিলেটে গড়ে তুলেছেন সিলেট মহিলা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। ১৯৯১ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত ব্র্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স (বিবিসিসি) এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি। সময়ের আলোকিত ব্যক্তিত্ব এনাম আলী একজন দূরদর্শী মানুষ, যিনি তাঁর কর্ম সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আজ বিশ্ব দরবারে আলোকিত হবার সুযোগ এনে দিয়েছেন। অর্থকণ্ঠ প্রতিবেদক