দখল ও দূষণসহ নানা কারণে দেশের নদ-নদী গুলো অস্তিত্ব সংকটে। দখল-দূষণ থেকে বাদ যায়নি গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ ও সুন্দর পানির জন্য বিখ্যাত শীতলক্ষ্যা নদীও।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কালীগঞ্জ উপজেলার মূলগাঁও এলাকার শীতলক্ষ্যা নদী তীরবর্তী দেশের খ্যাতনামা শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য কাঁচামাল বহনকারী অসংখ্য মালবাহী জাহাজ নদীতে যত্রতত্র নোঙ্গর করে রাখা হয়েছে। দেখে যে কারো মনে হতে পারে নদীটি শিল্প প্রতিষ্ঠানটির ব্যক্তিগত সম্পদ। আর এমন দৃশ্য দেখলেই বুঝা যায় শীতলক্ষ্যা নদী কতটা অসহায়। শুধু যে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদনহীন জেটি ব্যবহার তা নয়, তারা প্রতিযোগিতা করে এ নদীকে দূষণও করছে সমানভাবে। কারো কারো ইটিপি থাকলেও বেশি মুনাফার আশায় তা বেশির ভাগ সময় বন্ধ রাখে।
তবে প্রশাসনের অভিযানের খবরে সচল হয় তাদের সেই ইটিপি। শীতলক্ষ্যা দূষণে পিছিয়ে নেই নদী পাড়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা গ্রামগুলোও। ব্যবহার, দূষণ ছাড়াও শীতলক্ষ্যা নদীটি ব্যাপকভাবে দখল হচ্ছে। স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যক্তিরাও নদী দখল করছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ২০২১ সালের এক জরিপে জানা গেছে, সারাদেশে ৬৫ হাজার ১২৭ জন নদী দখলদার রয়েছে। তবে এর মধ্যে ১৯ হাজার ৮৭৪ জন অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে।
শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের বাসিন্দা কালীগঞ্জ পৌর এলাকার বালিগাঁও গ্রামের মৃত সুবানি মণ্ডলের ছেলে বিষ্ণু মণ্ডল (৪৫) জানান, শীতলক্ষ্যায় মাছ ধরে আমার বাপ-দাদারা জীবিকা নির্বাহ করতো। বংশ পরম্পরায় সেই পেশাকে এখন আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। কারণ নদী পাড়ের শিল্পকারখানার বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে গেছে। তাই আগের মতো আর শীতলক্ষ্যায় আর মাছ পাওয়া যায় না।
কালীগঞ্জ খেয়া ঘাটের মাঝি, নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের ইসলামপাড়া গ্রামের মো. বাচ্চু মিয়ার ছেলে মো. বকুল মিয়া (৪৬) বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে শিশু বয়সের এই শীতলক্ষ্যার বুক চড়ে বেড়াচ্ছি। এক সময় শীতলক্ষ্যা নদী অনেক বড় ছিল। কিন্তু দিনে দিনে নদীর দৃইপাড়ের শিল্প-কারখানাগুলো অবৈধভাবে দখল করার ফলে নদীটি ছোট হয়ে গেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে একদিন হয়তো শীতলক্ষ্যা নদীর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
স্থানীয় নদীপ্রেমিরা বলেন, নিজেদের অর্থনৈতিক প্রয়োজনে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নদী ও নদীর পানিকে ব্যবহার করলেও নদীর প্রতি তারা কোনো দায়িত্ব পালন করছে না। তাই নদী তীরবর্তী শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর ইটিপি নিশ্চিত করার পাশাপাশি অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে নদী পাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করতে হবে।
বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন বলেন, জেলা প্রশাসক জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি একই সাথে তিনি জেলা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক। জেলা প্রশাসক পরিবেশ অধিদপ্তর, মৎস্য অফিস, কৃষি অফিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআরডিবি, পরিবেশবাদী, জনপ্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়ার প্রতিনিধির সমন্বয়ে নদী রক্ষার কাজকে এগিয়ে নিতে হবে। তাছাড়া, জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০, পানি আইন ২০১৩, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র আইন ২০১৭, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ কঠোর প্রয়োগে সুফল আসতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি মো. আসসাদিক জামান বলেন, বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। সরকার সারাদেশে নদীর যে স্বাভাবিক প্রবাহ, তা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এর মধ্যে নদী খননের কার্যক্রমও রয়েছে। এছাড়াও নদী রক্ষায় আলাদা করে নদী রক্ষা কমিশন ও বিআইডব্লিউটিএ আলাদাভাবে নদী নিয়ে কাজ করছে। আমরা জানি কালীগঞ্জ কিন্তু শীতলক্ষ্যা ঘিরেই। নদী কিন্তু মানবজাতির শুরু থেকেই মানব সভ্যতার যে বসবাস সেটা নদী ঘিরেই রয়েছে। তাই নদী আমাদের অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শীতলক্ষ্যা নদী তীরবর্তী শিল্প-কারখানাগুলোর ইটিপি নিশ্চিত করতে কাজ করছি। এটা নিয়ে পরিবেশ অধিদফতরও কাজ করছে। ইটিপির বাইরে যদি কেউ ময়লা পানি বর্জ্য নিঃসরণ করে, তাহলে তাদেরকে আমরা অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসবো এবং প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত করবো। আর নদীর কিন্তু সীমানা হচ্ছে সিএস নকশা। সুতরাং যদি এই সিএস নকশায় স্থায়ী কোনো নির্মাণ স্থাপনা হয়, তাহলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শুধু একটি দিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়, শীতলক্ষ্যা রক্ষায় এর দখল-দূষণ রোধে স্থানীয় প্রশাসনকে যেমন ভূমিকা রাখতে হবে, তেমনি সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে নদীর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই শীতলক্ষ্যা নদী বাঁচবে। আর নদী বাচঁলে, বাঁচবে দেশ, বাঁচবো আমরা।