রোববার বেলা ১১টায় অ্যাম্বুলেন্সে করে তার কফিন জাতীয় প্রেসক্লাবের টেনিস কোর্টে আনার পর কালো কাপড়ে ঘেরা একটি অস্থায়ী মঞ্চে রাখা হয়।
সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকরা তার কফিনে শ্রদ্ধা জানান পুষ্পস্তবক দিয়ে। কেবল সাংবাদিক নয়, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিদের শ্রদ্ধার ফুলে ভরে যায় কফিনের চারপাশ।
কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার দুপুরে মারা যান রিয়াজ উদ্দিন।
অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ কয়েকবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। নানা সংকটে সাংবাদিকরা তার কাছে ছুটে যেতেন সমাধানের পথ খুঁজতে।
শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি জাতীয় প্রেসক্লাবে রিয়াজ উদ্দিনের জানাজায় অংশ নেন শিল্প মন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, আকরামুল হাসান, শামসুদ্দিন দিদার, ন্যাপের গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম, এডিটরস গিন্ডের সভাপতি মোজাম্মেল বাবু, নোয়াব সভাপতি একে আজাদ, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেলন হোসেন, নিউ এজের প্রকাশক এসএসএম শহিদুল্লাহ খান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, শওকত মাহমুদ ও সাইফুল আলম এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে।
এছাড়া সাংবাদিক শাহজাহান মিয়া, স্বপন সাহা, আজিজুল ইসলাম ভুঁইয়া, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, এম এ আজিজ, বদিউল আলম, গোলাম মহিউদ্দিন খান, আবদুল হাই শিকদার, রফিকুর রহমান, এলাহী নেওয়াজ খান, কামরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল হাই সিদ্দিকী, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের এম আবদুল্লাহ, নুরুল আমিন রোকন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের কাদের গনি চৌধুরী, শহীদুল ইসলাম, জাতীয় প্রেসক্লাবের শাহেদ চৌধুরী, মাইনুল আলম, আশরাফ আলী, কাজী রওনক হোসেন, বখতিয়ার রানা, কাদির কল্লোল, লোটন একরাম শ্রদ্ধা জানান জ্যেষ্ঠ এ সহকর্মীর প্রতি।
ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে রোববার সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের জানাজা শেষে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়।
জানাজার আগে ক্লাবের টেনিস কোর্ট প্রাঙ্গণে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের কফিন সামনে রেখে সংক্ষিপ্ত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠান হয়। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ শাহেদ চৌধুরীর পরিচালনায় ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খানসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রিয়াজ উদ্দিনের ভাই অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জয়নাল আবেদীন এবং একমাত্র ছেলে মাশরুর রিয়াজও উপস্থিত ছিলেন এ সময়।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, “তার এই মৃত্যুতে অভাবনীয় ক্ষতি হয়েছে সাংবাদিকতা পেশায়। পৃথিবীতে কোনো শূন্যতা থাকে না। তবে হয়ত উনাকে হারানোয় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা এখনোই পূরণ হবে না। উনার ভালো গুণগুলো আমাদের সকলের স্মরণ রাখা দরকার। তার সাহস, দেশপ্রেম, বস্তুনিষ্ঠতা, সাংবাদিক শ্রেণির জন্য তার দরদ-অবদানকে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।”
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “রিয়াজ ভাইয়ের চলে যাওয়া আমাদের সকলের জন্যই বেদনার, কষ্টের। উনি সেই সাংবাদিক, যিনি গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দিয়ে, তার মেধা দিয়ে সাংবাদিকতাকে সবসময় সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।
“আমি মনে করি, এই সময়ে যখন গণতন্ত্রের একটা সংকট চলছে, তখন তার মত সাংবাদিকের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে তার একটা বড় শূন্যতা অনুভব করছি। তার বিদাহী আত্মার আমি শান্তি কামনা করছি।”
ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, সাংবাদিকদের অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির অনেক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সম্পাদক পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ।
“সবার সঙ্গে মিলে-মিশে কাজ করার একটা স্বভাবসুলভ গুণ ছিল রিয়াজ ভাইয়ের, আমরা যেন সেই গুণ আমাদের মধ্যে আনতে পারি। উনার সাংবাদিকতার মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা যেন আরো উন্নত স্তরের সাংবাদিক হতে পারি, এই প্রত্যাশা রইল।”
নিউজ পেপারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-নোয়াবের সভাপতি একে আজাদ বলেন, “একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে যতগুলো গুণ থাকা দরকার আন্তর্জাতিক লেভেলে এবং দেশীয় লেভেলে, প্রত্যেকটা গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরে নোয়াবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
“আমি বলব, রিয়াজ সাহেবের জীবনের যে উল্লেখযোগ্য অবদান এই প্রেসক্লাবের জন্য, সাংবাদিকদের জন্যে, সাংবাদিক ইউনিয়নের জন্যে, নতুন প্রজন্ম যেন তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি, রিয়াজ ভাইয়ের আদর্শকে যেন আমরা ধারণ করতে পারি। তিনি আমাদের মাঝে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।”
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সম্পাদক শওকত মাহমুদ বলেন, “রিয়াজ ভাই তার সাংবাদিকতার চৈতন্যবোধ দিয়ে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবে যখন তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন আমি তার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমি লক্ষ্য করেছি, সাংবাদিকতার প্রতি তার যে মর্মত্ববোধ, সাংবাদিকতার প্রতি তার যে দায়িত্ববোধ, সর্বোপরি গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা জন্য তার যে ভূমিকা, তিনি তা নিষ্ঠার সাথে পালন করে গেছেন। আজকে আমরা অভিভাবকশূন্য হয়ে গেছি।”
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, “রিয়াজ ভাই একজন ভালো সংগঠক ছিলেন, ভালো অভিভাবক ছিলেন। পেশার প্রতি তার যে আত্মনিবেদন, তার কোনো তুলনা নেই। সাংবাদিকতার পেশার সঙ্গে কখনো তিনি আপস করেন নাই।”
একাত্তর টেলিভিশন আয়োজিত ‘উন্নয়নশীল বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজ উদ্দীন আহমেদ। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
“সাংবাদিক-কর্মচারীর স্বার্থের প্রতি তিনি সবসময়ে অবিচল ছিলেন। একটা বিষয় স্পষ্ট যে, মতানৈক্য কখনোই মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে না, এটা আমরা রিয়াজ ভাইয়ের কাছে থেকে শিখেছি। মতানৈক্য থাকতেই পারে, কিন্তু সেখানে দূরত্ব নাই। সেই মতানৈক্য গ্রহণ করা, মতানৈক্য নিয়ে আলোচনা করার মানসিকতায় তিনি আমাদেরকে উদ্ধুদ্ধ করেছেন সারাজীবন।”
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, “রিয়াজ ভাইকে নিস্তব্ধ নিথর রেখে আজকে আমরা কথা বলছি, এটা আমরা কয়েকদিন আগেও ভাবতে পারিনি। কয়েক দিন আগেও উনি এসে রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচন পরিচালনা করেছেন, জাতীয় প্রেসক্লাবের মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন।”
“আমাদের যে কোনো সংকটে আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করতাম, তিনি আমাদেরকে পরামর্শ দিতেন, তেমন একজনকে আমরা হারিয়েছি।… আমরা আমাদের অভিভাবককে মিস করব। সাংবাদিকতা জগতে তার যে অভাব, সেটি পূরণ হবার নয়।”
গতবছর মহামারী শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ক্লাবের সাবেক সভাপতি হাসান শাহরিয়ারসহ ৪০ জন সদস্যের মৃত্যুর কথা তুলে ধরে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন ফরিদা ইয়াসমিন।
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের ছেলে মাশরুর রিয়াজ জানান, শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তার বাবার মরদেহ হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয় নরসিংদীর নারান্দীতে তাদের গ্রামের বাড়িতে।
সেখানে জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে হেলিকপ্টারে করে কফিন আবার ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। আসরের পর বারিধারা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আরেক দফা জানাজা শেষে বিকালে বনানীতে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয় রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে।
অর্ধ শতকের সাংবাদিকতা জীবনে তিনি ডেইলি স্টারের উপ-সম্পাদক, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রধান সম্পাদক, ডেইলি টেলিগ্রাফের সম্পাদক ও নিউজ টুডের সম্পাদক ও প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ তিনি ফিন্যান্সিয়াল হেরাল্ড পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন।
সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আগে কিছুদিন তিনি ঢাকার হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ ও টাঙ্গাইলে কাপাসিয়া কলেজে অধ্যাপনাও করেন।
১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্য্করী সদস্য হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হন রিয়াজ উদ্দিন। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব এবং ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন তিনি।
একাত্তরের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ পাকিস্তান অবজারভারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতা করেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশ অবজারভারে যোগ দেন।১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে প্রধান প্রতিবেদক ও বিশেষ প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ সার্কভুক্ত দেশগুলোর সাংবাদিকদের ফেডারেশন সমন্বয়ে গঠিত দক্ষিণ এশিয়া সাংবাদিক সমন্বয় পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সাউথ এশিয়ান ফ্রি মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের (সাফমা) সভাপতি ছিলেন।
১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। এরপর ২০০২ থেকে আবার দুই দফা প্রেসক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন।
ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন। প্রথমে ছাত্রলীগ এবং পরে বাংলা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন। ২০০০ সালে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তথ্য উপদেষ্টাও ছিলেন কিছু দিন।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ১৯৯৩ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।
courtesy bdnews24.com