সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে মালেকা বানু বলেন, সমগ্র বিশ্বজুড়ে চলমান করোনা মহামারীর কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে আজকের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সম্মেলনে ৫৫ টি জেলা থেকে মোট ৪৮০ জন্য কাউন্সিলর উপস্থিত আছেন। সংগঠনের ৫১ বছরের পথচলায়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেখা যাচ্ছে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হয়েছে। তবে এর পেছনে রয়েছে রুঢ় বা¯তবতা। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর কাজের স্বীকৃতি ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হয়নি। গণতন্ত্র, সুশাসন ও নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতা ফলপ্রসূ তা বলা যাবেনা। করোনাকালীন সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে উদ্বেগজনকভাবে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ৫০ বছরে সংগঠনের আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে, নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে এবং নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সকলের জন্য মানবিক, গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে সকল কাউন্সিলরদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
মাননীয় স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর প্রদানকৃত শুভেচ্ছা বাণী উপস্থাপন করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী। তিনি বলেন মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুভক্ষণে মহিলা পরিষদের এই সম্মেলন বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। পঞ্চাশ বছর ধরে নারীর ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন তথা সমাজ এবং রাষ্ট্রে সম অধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠনের ধারাবাহিকভাবে কাজ করার কথা তুলে বলেন করোনা মহামারীতে নারীর প্রতি তৈরি হওয়া নানামুখী সংকট নিরসনে সরকারের পাশাপাশি মহিলা পরিষদকেও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
বিশেষ অতিথির ধারণকৃত বক্তব্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান ত্রয়োদশ সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হতে যাওয়া নতুন নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে ্বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দেশের একটি বৃহৎ সংগঠন যেখানে সারা দেশের বহু কর্মজীবী এবং পেশাজীবী মানুষ জড়িত। সংগঠনের আন্দোলন কর্মসূচির সাথে গণনারীকে যুক্ত করার লক্ষ্যে অন্যান্য নারী সংগঠনগুলোকে যুক্ত করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পোশাক শিল্পে কর্মরত নারীদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে মহিলা পরিষদকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে; অভিবাসী নারীদের নিরাপত্তা এবং যথাযথ অভিবাসন বিষয়ে এবং জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন চালু করার বিষয়ে সংগঠনকে কাজ করতে হবে।
বিশেষ অতিথির ধারণকৃত বক্তব্যে ক্রিষ্টিন জোহানসন বলেন,১৩ তম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষ্যে সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আমি অত্যন্ত আনন্দিত।তিনি ত্রয়োদশ সম্মেলনের স্লোগানটির উল্লেখ করে বলেন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ , সম-অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এমন সমাজে নারী-পুরুষের মানবাধিকারকে সমানভাবে মর্যাদা দেয়া হয় এবং প্রকৃত উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা,দক্ষতা ও যোগ্যতাকে বিবেচনায় নেয়া হয়। তিনি করোনার কারণে বৃদ্ধি পাওয়া নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সামাজিক রীতিনীতি, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং জেন্ডার বৈষম্যের মূল কারণগুলি চিহ্নিত করে তা নির্মূল করার লক্ষ্যে সংগঠনকে সক্রিয়ভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি এসকল কর্মসূচি সফল করতে তৃণমূল স্তরের অবদানকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে রোজিনা ইসলাম বলেন, আজকের এ মহতি অনুষ্ঠানে দাড়িয়ে আমি বলতে চাই যারা গত আটমাস আমাকে সাহস যুগিয়েছেন, পাশে থেকেছেন, আদালতে আমার জন্যে উপস্থিত থেকেছেন কি’বা আমার জন্যে রাস্তায় নেমে বা সামাজিক মাধ্যম একটি শব্দ উচ্চারণ করেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মহিলা পরিষদ ৫২ বছর ধরে নারীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এই সময়কালে নারীদের অগ্রগতি হয়েছে তবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীরা এখনো পিছিয়ে আছে। যেকোনো সহিংসতার ঘটনায় নারীদের হেনস্থার শিকার হতে হয়, তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তিনি আরো বলেন, নানা ধরণের সহিংসতা পাশাপাশি বেশিরভাগ নারী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে । সহিংসতার ঘটনা মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হলে নারীকে প্রতিবাদী ও সাহসী হতে হবে, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, নানা প্রতিকুলতার মধ্যে সাংবাদিকতা আমাকে আরো মানসিকভাবে সুদৃঢ় করেছে যা আগামী দিনে এদেশের এমনকি উপমহাদেশে নজির হয়ে থাকবে। গণতন্ত্রের প্রহরী যেমন গণমাধ্যম, আমি মনে করি তেমনই সভ্য সমাজের কর্তব্য সকল প্রতিকুলতায় গণমাধ্যমের তথা সাংবাদিতার স্বাধীনতা রক্ষায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন যুগিয়ে যাওয়া। তাই যত বাধাই আসুক আমি সাংবাদিকতা চালিয়ে যাবো।
সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ১৩ তম জাতীয় সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তখন নেতৃত্বের একটা অংশকে আমরা প্রতিমূহূর্তে আমরা স্মরণ করছি। তারা আমাদের মাঝে নেই। তিনি প্রয়াত সকল নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন আমাদের প্রাণের ধারাকে এগিয়ে নিতে হবে। সংগঠনের ৫২ বছরের পথচলায় অনেক অর্জন আছে, অগ্রগতি আছে, চ্যালেঞ্জ আছে। নানা প্রতিক’লতার মাঝেও আত্মশক্তিতে বিকশিত নারী সমাজ যারা আজ নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তারা কৃতি নারী হিসেবে আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস্য হয়ে উঠেছেন। তারাই আগামী দিনে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তবে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবদান থাকলেও নারীর অবদানের স্বীকৃতি এবং অংশীদারিত্বের স্বীকৃতি এখনো আসেনি। নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করে প্রকৃত উন্নয়ন ঘটাতে হলে উন্নয়নের মূলধারায় নারীকে যুক্ত করতে হবে, রাস্ট্রীয় নীতি নারীবান্ধব হতে হবে, বাস্তবায়নকারীদের জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে, সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীদের সমঅধিকার দিতে হবে, সিডও সনদের ধারা ২ এর উপর থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করতে হবে।
বক্তব্য শেষে র্যালী অনুষ্ঠিত হয়। র্যালীটি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউট থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় প্রদক্ষিণ করে পুনরায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউটের সামনে এসে শেষ হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে জাতীয় পরিষদ সভা ও ১ম কর্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কর্ম অধিবেশনে সাংগঠনিক শোক প্রস্তাব (২০১৯-২০২০) পাঠ করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম । কেন্দ্রীয় কমিটির কার্য বিবরণী পেশ করেন সংগঠনের সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম; সাধারণ সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু; কেন্দ্রীয় কমিটি আয় ব্যয়ের হিসাব উপস্থাপন করেন অর্থ সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম। সভা সঞ্চালনা করেন জাতীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক রীনা আহমেদ।
১ম কর্ম অধিবেশন শেষে ২য় কর্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সঞ্চালনায় ছিলেন ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেহানা ইউনূস। উক্ত অধিবেশনে কমিশনভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। করোনার অভিঘাত: নারী আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ ও সংগঠন বিষয়ে আলোচনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, মডারেটর ছিলেন সহ-সভাপতি ফেরদৌস আরা মাহমুদা হেলেন; কো- ফেসিলিটেটর ছিলেন ঢাকা মহানগর কমিটির সংগঠন সম্পাদক কানিজ ফাতেমা টগর; র্যাপোর্টিয়ার ছিলেন প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার উপপরিষদ সদস্য আফরোজা আরমান ও কাজী সিরাজুম মুনিরা। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা ও নারীর মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা করেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম; মডারেটর ছিলেন সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম, কো- ফেসিলিটেটর ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌরী ভট্টাচার্য, র্যাপোর্টিয়ার ছিলেন দীপ্তি রানী সিকদার প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার উপপরিষদ সদস্য এবং কমিশন উপপরিষদ সদস্য কেয়া রায়। নারীর ক্ষমতায়ন ও সুশাসন-গণতন্ত্র, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে আলোচনা করেন সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী; মডারেটর ছিলেন সহ-সভানেত্রী ডা. মাখদুমা নার্গিস রতœা, কো-ফেসিলিটেটর ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনিরা বেগম অনু, র্যাপোর্টিয়ার ছিলেন কমিশন উপপরিষদ সদস্য জনা গোস্বামী ও লিলি আরা পারভীন অতসী। জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ বিষয়ে আলোচনা করেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মী, মডারেটর ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভানেত্রী লক্ষী চক্রবর্তী, কো-ফেসিলিটেটর ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মারুফা বেগম, র্যাপোর্টিয়ার ছিলেন প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার উপপরিষদ সদস্য শাহজাদী শামীমা আফজালী ও কমিশন উপপরিষদ সদস্য সাবিকুন নাহার। নারী আন্দোলনে নেতৃত্ব ও নতুন প্রজন্ম বিষয়ে আলোচনা করেন আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা, মডারেটর ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া, কো-ফেসিলিটেটর ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাথী চৌধুরী, র্যাপোর্টিয়ার ছিলেন প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার উপপরিষদ সদস্য সালেহা বানু সাবা ও কমিশন উপপরিষদ সদস্য নুরুন্নাহার তানিয়া। আলোচনা শেষে দলীয় কাজ অনুষ্ঠিত হয়। দলীয়কাজে কাউন্সিলরবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
সম্মেলনে ৫৫টি জেলা থেকে মোট কাউন্সিলর উপস্থিত ছিলেন ৪৮০ জন। উল্লেখ থাকে যে, করোনা পরিস্থিতির কারণে কাউন্সিলরের সংখ্যা সীমিত রাখা হয়।