–-আফজাল হোসেন
তিরিশ বছর হয়ে গেলো একসাথে আছি। যথার্থ শোনায়, তার সংসারে তার সাথে বাস করি বললে।
তিরিশ বছর কেটেছে। আমাদের সন্তানদের জন্মতারিখ বলতে পারবো- কার কত বয়স হলো বলতে গেলে হিসাবে বসতে হবে। তার চেয়ে সহজ মনাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়া।
আরাফ ও বউ দেশের বাইরে থাকে- মনা তাদের প্রায় রোজকার খবর বলতে পারবে। ঈমানের স্কুলের বেতন কতো, আমার জানা নেই।
আমি জানিনা মাসের বাজার খরচ, চালের দাম, লবন কতটাকা কেজি। জানা নেই রান্নাঘরের চুলো জ্বলছেনা, বেসিনে পানি আটকে গেছে বা ঘরে বৈদ্যুতিক কোনও সমস্যা হলে কোনটার জন্য কাকে ফোন করতে হবে।
এখন আমার ব্লাডপ্রেসার কত থাকে। সকালে কিকি অষুধ খেতে হয় বা রাতে কি কি খাই, সবই জানে সে। আমি জানিনা, আম্মাকেও এখন প্রতিদিন কতগুলো অষুধ খেতে হয়, ডাক্তার কোনটা নতুন যোগ করেছে।কোন কোনটা শেষ হওয়ার পথে।
মাসে গ্যাস, বিদ্যুতবিল কত আসে, গাড়ির সার্ভিসিং কবে, কবে আজিমপুর গোরস্থানে পাপা, মা র কবরের দেখভাল করার মানুষটাকে টাকা পাঠাতে হবে, সবই তার মনে মাথায় সাজানো।
আব্বার মৃত্যুবার্ষিকী অমুক তারিখে, পারুলিয়ায় কিছু করা হবে নাকি মিরপুরের এতিমখানায়- মাথায় থাকে।
শিশুকালে আরাফকে কোলে নিয়ে ঘুরতো বা তার সাথে খেলতো যে মেয়েটা, তার এখন দুটো বাচ্চা। থাকে সিলেটে। একদিন হয়তো তার সংসারের এক অসুবিধার কথা বলেছিল- মনার মাথায় আছে। সমস্যা আছে না গেছে খোঁজ নেয়। যা করতে পারে করে।
অবাক হই, এতকিছু একটা মাথায় থাকে কিভাবে!
দুপুরে ইমান খেতে চেয়েছে কাও পাট খাই, তার রেসিপি পড়তে পড়তে মনার মনে হয়ে যায় আরিমা, পরিবারের সবচেয়ে ছোটজন ( বোনের মেয়ে ) খানিক আগে একটা ছবি এঁকে পাঠিয়েছে- মামনা দিস ইজ ফর ইউ। কেমন হয়েছে বা খুশী হয়েছি, জানানো হয়নি তাকে।
নির্ভানা, আমাদের আম্মু ( ছোটো ভাইয়ের মেয়ে ) ঈদানীং খুব আগ্রহে উৎসাহে কেক পেস্ট্রি বানায়, তার এক দুশ্চিন্তা- কেকের ভিতরটা কেন তত নরম থাকছেনা। তা নিয়ে আম্মুর সঙ্গে কথা হওয়া দরকার।
শীলা, ছোটো ভাইয়ের স্ত্রীর শরীর ভালো নেই। এটাও জানে, একজনও সাহায্যকারী নেই রুমার বাসায়। এরকম অজস্র দুশ্চিন্তা, সমস্যা ও সমাধানের চেষ্টা মগজে বয়ে সে হাসিমুখে ঠান্ডা মাথায় চলতে ফিরতে পারে।
এমন বলেই সাহায্যকর্মী সরবরাহকারী, ইন্টারনেট ও পেস্টকন্ট্রোল কর্মী, ট্রেডমিল মেকানিক, দর্জি, মাংস বিক্রেতা, মুদি দোকানী, সোফা মিস্ত্রি, রং মিস্ত্রি ইত্যাদি নানা পরিচয়ের মানুষেরা পছন্দ করে ম্যাডাম, আপাকে।
এতকিছু বলার পর মনে হতেই পারে, আমি তাহলে একটা অযথা লোক।
যুক্তি খাটালে অন্য মানেও পাওয়া যেতে পারে। জীবনে ভালো কিছু করেছি। মনা, সেই পূন্যেরই ফল।
অনেক বছর ছবি আঁকিনি। আঁকাআঁকিতে আবার ফিরতে পারবো, মনে হতোনা। মনার বিশ্বাস অটুট ছিল। পারবো। বছরের পর বছর আমাদের পুরো বাড়ির সব ঘরের দেয়াল সে ফাঁকা রেখে দেয়। বলেছিল, ফাঁকাই থাকুক। নিজের আঁকা ছবি ঝোলানোর আগে কারও ছবি দিয়ে ঘর সাজানো যাবেনা।
সেই নিশব্দ জোর খাটোনোর ফলাফল, এখন ঘরের দেয়াল ফাঁকা নেই।
জগৎ ও জীবন শেখার জন্য। রোজ আমি তার কাছ থেকে শিখি। ঘরের ধুলো পরিষ্কার আর জলরঙে ছবি আঁকা- দুটোতেই নিবেদন লাগে।একইরকম মনোযোগ, নিষ্ঠা লাগে।
একশোরকম ঘটনার মধ্যে থেকেও নিজের জলরংয়ের ছবি কিভাবে আরও ভালো করা যায়- সে জন্য মনা যখন ইউটিউবে বিশ্বখ্যাত জলরং শিল্পীদের অনুশীলন দেখে, যেভাবে দেখে অবাক হই। ভাবি, নিজে শিল্পী হতে চেয়েছি, তবে এতটা মনোযোগী কি কখনও হতে পেরেছি?
সৃষ্টিকর্তা আমাদের ভালো রেখেছেন, রাখবেন- এই আশা। আরও আশা, আমরা উভয়ের জন্য উভয়েই যেনো আরও কিছুকাল সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে পারি।
শুভ বিবাহবার্ষিকী মনা।