ষাটের দশকের শেষের দিকে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসি, তখন ঢাকা শহরে চীনা রেস্তোরাঁ ছিল গোনাগুণতি – মূলতঃ মধ্য ঢাকাতেই। আসলে ঢাকায় আসার আগে ‘চীনা রেস্তোরাঁ’ জিনিষটি কি, সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না, এবং কোন চীনা খাবার আমি চোখেই দেখি নি, শিব্রাম চক্রবর্তীর ভাষায় ‘চেখে’ দেখা তো দূরের কথা।
তাই কোন এক মধ্যাহ্নে যখন ঐচ্ছিক অঙ্কের ক্লাশের শেষে সুরেশদা’র চা’খানায় আমাদের আড্ডায় নাফিস (আমার অর্থনীতির সহপাঠী প্রয়াত নাফিস আহমেদ) যখন প্রস্তাব করলো যে চীনা খাবার খাওয়া যাক্, তখন লাফিয়ে উঠলাম আমরা। আমরা মানে আমরা চারজন – ইফতি (পদার্থবিদ্যার সহপাঠী বর্তমানের ডঃ ইফতেখার আহমেদ) এবং সীজার (অর্থনীতির সহপাঠী বর্তমানে বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে অবসরপ্রাপ্ত ডঃ জাফর আহমেদ)। সেদিনই সবাই বৃত্তির টাকা পেয়েছি – পকেট সবারই ভারী। নাফিসের একটা হালকা নীল ডাটসন গাড়ী ছিল। চারজনা মিলে হৈ হৈ করে রওনা হওয়া গেলো।
এর ক’বছর আগেই নির্মিত হয়েছে বলাকা সিনেমা হল নিউমার্কেটের উল্টোদিকে – ঢাকা কলেজের ছাত্রদের তীর্থক্ষেত্র। সে প্রেক্ষাগৃহের দোতালাতেই আরো নতুনতর চীনা রেস্তোরাঁ ‘বাং চিং’। ঢাকা কলেজের ছাত্র হবার সুবাদে ‘বলাকা’ ও ‘বাং চিং’ মৎ বন্ধুত্রয়ের কাছে সুপরিচিত ও সুপ্রিয়ও বটে। সে রেস্তোঁরায় ঢুকেই আমার যেটা মনে হলো যে তা’তে আলো বেশ কম এবং চারদিকে কেমন একটি অন্ধকার ভাব। পরে শুনেছিলাম যে, বেশ একটা মায়াবী আমেজ আনার জন্যেই চীনা রেস্তোঁয়ায় আঁধার করে রাখা হয়। আমার প্রয়াত বন্ধু নাফিসের অবশ্য এর অন্য একটি ব্যাখ্যা আছে। তবে সেটা হেথায় কহতব্য নয়। বেনুর প্রয়াত পিতামহী অবশ্য বলতেন যে, বাসি ও পচা খাবার চালিয়ে দে’য়ার জন্যেই আলোর এই খামতি।
খাদ্যতালিকা দেখে খাবার বাছাই পর্ব। কোন কোন খাবারের নাম দেখে অর্থ বুঝতে পারি, কিন্তু সেগুলো চিনি না। কি করে খেতে হয়, তা’ও জানি না। সারাজীবন বরিশাল শহরে থেকেছি, চীনা খাবার আমার অচেনা। কিন্তু জীবনে ‘কেউ কেউ ঠেকে শেখে, কেউ কেউ দেখে শেখে’। আমার শিক্ষা সর্বদাই ‘দেখে শেখার’। বন্ধুদের কথা শুনে শুনে শিখলাম, কোন কোন খাবারটা ভালো, তাদের দিকে তাকিয়ে দেখে দেখে শিখলাম ‘চিকেন কর্নস্টার্চ
স্যুপের’ সঙ্গে কি কি মেশাতে হয়। ‘ফান্টার’ জন্যে কারো সাহায্যের প্রয়োজন হলো না – ও আমার দেখা, চেনা ও জানা।
চারজনে খাওয়া আর গল্প কোথা দিয়ে যে ঘন্টা তিনেক কেটে গেলো। খাওয়ার শেষে দেখা গেলো, আমাদের কাছে বাং চিনের প্রাপ্য হয়েছে মোট ১৫ টাকা – আজকের দিনে অভাবিত। পনেরো টাকার সঙ্গে খুব হাতখোলা মানুষের মতো ইফতি একটি টাকা রাখলো সেবাইতের জন্যে। অবশ্য তার ব্যাখ্যা হলো যে, ১৬ টাকা হলে ৪ জনের মধ্য ভাগ করতে সুবিধে – সবার ভাগে ৪ টাকা করে পড়বে।
তার কিছুদিন পরেই এক রোববারের সকালে ‘নাজে’ ছবি দেখতে যাই। ছবির নাম সম্ভবতঃ ‘Summer Holiday’. তখন প্রায়শঃই রোববারে সকাল ১০.৩০ মিনিটে একা একা ‘নাজে’ ইংরেজী ছবি দেখতে যেতাম। সেই প্রদর্শনকে বলা হতো ‘মর্ণিং শো’। অবিস্মরণীয় সব দেখেছি সেখানে – The Great Race (Jack Lemmon এবং Tony Curtis), The BlackBeard Ghost (Sir Peter Ustinov), In Search of Castaways (Maurice Chevalier এবং Hayley Mills), Genghis Khan (Omar Sharif এবং Stephen Boyd). আর কতো বলবো?
সাড়ে বারোটায় ছবি শেষ হলো। ছবি দেখার পরে মনে হলো, ছবিঘরের পাশেই তো ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো চীনা রেস্তোঁরা ‘চৌ চিং চু’। ঢুঁ মারা গেলো সেখানে। জুত হয়ে বসে বেশ ক’টি সুস্বাদু চীনা খাবারের ফরমাশ করা গেলো। কিন্তু অনভিজ্ঞতার খেরাসত তো দিতেই হবে। প্রতিটি খাবারের পরিমান সম্পর্কে তো কোন ধারণাই নেই। খাবার আনলে দেখা গেলো, সে পরিমান খাবার খাওয়া আমার একার কম্মো নয়। সুতরাং খাবারের অপচয় এবং পয়সা গচ্চা।
ছবিঘর থেকে বার হতেই দেখা শওকত ভাইয়ের (তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের সাংবাদিক প্রয়াত শওকত আনোয়ার) সঙ্গে। তিনিও ছবি দেখে বেরিয়েছেন নাজ থেকে। তিনি ধরে নিয়ে গেলেন গুলিস্তানের ঊল্টোদিকের ‘লা সানি’ তে। জম জমাট ভেতরটা – শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের ভীড়। হৈ চৈ, তর্ক-বিতর্ক, সিগারেটের ধোঁয়ায় একাকার চারদিক। সেদিনের চা আর কেকের সোয়াদ আজও ভুলবো না। চোখে পড়লো ‘কশবা’। একটু দূরে চোখে পড়লো তৎকালীন জিন্নাহ্ এভিনিউর ওপরে বিখ্যাত অষুধের দোকান ‘ভাম’। ‘রেক্সে’ও খেতে গেছি ক’জন মিলে
সত্তুরের দশকের দিকে ঢাকার একাধিক চীনা রেস্তোরাঁয় খেয়েছি। বেনু আর আমি গেছি, এই যেমন, ধানমন্ডি ২ নম্বর রাস্তার মুখের কাছাকাছি মীরপুর রোডের ওপরে এ্যালিয়ঁস ফ্রাসেঁর কাছে ‘সাংহাই’ রেস্তোরাঁ, তোপখানা রোডের ওপরে ‘ক্যান্টন রেস্তোরাঁ’। সাংহাই ভবনে একটি রূপসজ্জার বিপনীও ছিল। তোপখানা রোডে ছিল ‘নানকিং’ও। ততদিনে নানান চীনা খাবারের সঙ্গে চেনা পরিচয় হয়েছে আমার – ম্যান্ডারিন’ আর ‘ক্যান্টনীজ’ পদ্ধতির রান্নার তফাৎ বুঝতে পারি, সয়া সস্ কতটুকু দিলে খাবারের সোয়াদ বাড়বে তা আন্দাজ করতে পারি। কাঠি দিয়ে খাবারও খেতে শিখে গেছি মোটামুটি।
উচ্চশিক্ষা শেষে আশির দশকে দেশে ফিরে আসার পর চীনা রেস্তোরাঁয় পরিভ্রমনের পরিধি বেড়ে গেলো। কতকটা ঢাকা শহরে তেমন রেস্তোরাঁর সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে কতকটা আমাদের কন্যাদ্বয়ের জন্যে। আমাদের চীনা রেস্তোরাঁ তালিকায় ‘টুংকিং,’, ‘চাংপাই’, ‘জিয়ান’ যুক্ত হলো। গেছি পুরানা পল্টনের ‘ম্যান্ডারিনেও’। আমাদের কন্যারাও নানান চীনা খাবারেরে ভক্ত হয়ে উঠলো। ১৯৯৩ সালে বাইরে চলে গেলে ঢাকার চীনা রেস্তোরাঁগুলোর সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।
তারপর দেশে-বিদেশে, নামা-অনামা, বিখ্যাত-অখ্যাত কত জায়গায় চীনা খাবার খেয়েছি। সাংহাই কিংবা বেইজিং এর পৃথিবী-বিখ্যাত রেস্তোরাঁয় চীনা খাবার খেয়েছি; খেয়েছি সানফ্রান্সিসকো কিংবা নিউইয়র্কের চীনা টাউনে ; নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়েছি পিপলস্ হলের রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় চীনা প্রধানমন্ত্রীর সান্নিধ্যে। ঢাকাতেও ইদানীং সময়েও প্রিয়জনেরা নিয়ে গেছে প্রথম শ্রেনীর চীনা রেস্তোরাঁয়, কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে, ষাটের দশকের ঢাকার চীনা রেস্তোরাঁর খাবারের সোয়াদ আর কোথাও পাই নি। এটা কি সময় বদলের কারনে কিংবা বয়সটা তেমনই ছিল বলে কি না – কে জানে!