আকবর হায়দার কিরন
দু’দিন আগেও টেলিফোনে রোকেয়া হায়দার আপা বলছিলেন দিলারা আপার শরীরটা তেমন ভালো নেই। তিনদিন আগে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন ।
রোকেয়া আপার সাথে যখনই কথা হয় তখন দিলারা আপার নাম আসতো। আজ ( ১৯ মার্চ) বেড়াতে গিয়েছিলাম নিউ ইয়র্ক প্রবাসী সবচেয়ে বয়োজেস্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ ভাইজানের বাসায়। কথা প্রসংগে রোকেয়া আপা ও দিলারা আপাকে নিয়ে অনেক স্মৃতির পাতায় ওঠে আসে তাঁর মনে।
আনুমানিক তিরিশ মিনিট পর রোকেয়া আপার ফোন এলো । তাঁর কন্ঠ শুনেই আমার হৃদয়টা যেন ধ্বক করে উঠলো, যেন কোন খারাপ খবর। আপা অত্যন্ত ভারাক্রান্ত কন্ঠে বললেন দিলারা আপা আর নেই। ম্যারিল্যান্ডে তিনি দুই মেয়ের সাথে থাকছিলেন এবং সম্প্রতি শরীরটা কেমন ভালো যাচ্ছিলোনা।
দিলারা হাশেম আপার সাথে আমার সম্পর্ক চার দশকেরও বেশী। আমি তখন ছাত্র ছিলাম এবং ভয়েস অব আমেরিকা ফ্যান ক্লাব করতাম। দিলারা আপাকে নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাব ভিআইপি লাউন্জ, আমেরিকান বাইসেন্টেনিয়াল হল ইত্যাদি জায়গায় আমাদের অনেক বিশেষ ও জমজমাট সম্মিলন।
একবার আপা ও তাঁর স্বামী হাশেম ভাই থাকছিলেন হোটেল সোনারগাঁয় । আমাকে সাথে নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে একটি বেবীট্যাক্সী নিলেন এবং দু’জনের মাঝখানে আমাকে বসালেন। যেন মাঝে বসালেন একটা বিগ বেবিকে ! ঠিক এই সময়টায় ভয়েস অব আমেরিকার দক্ষিন এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের পরিচালক স্টেনলি স্রেগার ঢাকা সফরে ছিলেন । তোপখানা রোড়ে আমাদের সামনে কিছুক্ষনের জন্য রিক্সায় চড়ে বেড়ালেন স্রেগার ও দিলারা আপা। আমাদের স্মৃতিতে এখনো অম্লান।
আমার প্রায়ই আড়াই যুগের প্রবাস জীবন নিউ ইয়র্ক সিটিতে। দিলারা আপার সাথে এখানে কতোবার দেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মুক্তধারার বইমেলায় তিনি এসেছেন বেশ কয়েকবার । এবং আমার সবসময় দেখাসাক্ষাত হয়েছে। আমার জীবনের অত্যন্ত স্মৃতিময় দু’টি ছবি দিলারা আপা ও রোকেয়া আপার সাথে। প্রায় দুই দশক আগে ও ২০১৯ সালে এই ছবিতে আমি বসে আছি তাঁদের মাঝখানে। অবশ্যই বইমেলায় এবং ছবি তুলেছেন প্রিয় নিহার সিদ্দিকী ভাই।
দিলারা আপা অবসর নেয়ার পর বছর চারেক আগে তাঁর একটি বিশেষ সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। ফোবানার একটি সম্মেলন হয় ভার্জিনিয়ায়। রোকেয়া আপা অনেক কস্ট করে তাঁকে নিয়ে আসেন বিশেষ সেই হোটেল রুমে। নিহার ভাইয়ের ক্যামেরার সামনে আপাকে নিয়ে গল্প করেছিলাম।
সেই বিশেষ আলাপচারিতায় রোকেয়া আপাও এক পর্যায়ে যোগ দেন। আমার সেই হোটেল রুমে এই সময় আরও ছিলেন কাজী শামসুল হক ভাই ও তাহিরা কিবরিয়া অনু। একই দিন আমি ইন্টারভিউ করেছিলাম ইকবাল বাহার চৌধুরী ভাইকে। সেদিন ফোবানার অনুস্ঠানের সময় লবীতে বিশ্বজিত সাহার বুকস্টলে গিয়েছিলাম দুই আপাকে নিয়ে।
দিলারা আপার সাথে শেষ টেলিফোনে গল্প করা গেলো অগাস্ট মাসে। তাঁর জন্মদিন নিয়ে একটি কিছুটা দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় ফোনের রেকর্ডিংএ। এটি যথাযথ ফর্মেট করে ইউটিউবে আপলোড করে আমার ভাগনে সাগর লন্ডনে।
নিউ ইয়র্ক প্রবাসী একজন পুরনো দিনের বাংলা গানের মহাভক্ত আতিক রহমান। সেই সাদাকালোর দিনগুলোতে দিলারা আপার মধুর কন্ঠে করাচি ও ঢাকায় রেকর্ড করা অনেক গানের ডিস্ক সংগ্রহ করেন আতিক ভাই এবং ইউটিউবে আপলোড করেন। দিলারা আপা আমার কাছ থেকে শুনে এবং লিংক পেয়ে শুনে বিস্মিত ও আনন্দিত হন।
‘মাটির গান মানুষের গান’ বিশেষ অনুস্ঠান করতেন আমেরিকান কান্ট্রি সং নিয়ে। কোন অনুস্ঠান এর চেয়ে আকর্ষনীয় হতে পারে ! ন্যাশভিল এ গিয়ে বিখ্যাত শিল্পীদের সাক্ষাত্কার নিয়েছেন। প্রতিটি গানের অর্থ বলতে গিয়ে ছন্দে ছন্দে বলতেন । এই অনুস্ঠান শোনার জন্য গান পাগল শ্রোতারা যেন অস্থির হয়ে থাকতেন। একজন মানুষ এতো গুনের সমাহার হতে হয় ভাবলেই অবাক লাগতো।
দিলারা আপার লেখালেখির জায়গা ছিলো লাইব্রেবী অব কংগ্রেস। সেখানে বসে লিখেছেন ঐতিহাসিক রচনা। ভিওএ বাংলা বিভাগের ৫০ বছর পুর্তি উত্সবে সেদিন বিরাট মিলনায়তনে শ্রোতা দর্শক হিসেবে আমি, সাঈদুর রব, হোসেন সৈয়দ, নিহার সিদ্দিকী ও আবীর আলমগীর ও ছিলাম। ভিওএ’র ৭৫ বর্ষপুর্তি উত্সবে আবার সৌভাগ্য হলো আমার। সাথে ছিলেন নিহার সিদ্দিকী, মিনহাজ আহমেদ, পুলক মাহমুদ ও শিব্বীর আহমেদ।
রোকেয়া আপার গভীর আন্তরিকতার কারনে বাংলা বিভাগের যেন এক ঐতিহাসিক মিলনমেলা হয়ে গেলো। যোগ দিলেন কাফি খান, ইকবাল আহমেদ, সৈয়দ জিয়াউর রহমান, দিলারা হাশেম, ইকবাল বাহার চৌধুরী, মাসুমা খাতুন ও ওয়াহেদ আল হোসেনী। সরকার কবীর ভাই যেন সবার মাঝে অত্যন্ত হৃদয়ভরা অবস্থান।
ভিওএ’র ৭৫ বছরপুর্তি হলেও আমাদের কাছে যেন বাংলা বিভাগের একটি যেন লাইফটাইম এচিভমেন্ট অনুস্ঠান। সেই বিশাল মিলনায়তনে দিলারা আপা সহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। মন্চ থেকে একমাত্র ভিওএ ফ্যান ক্লাবের অন্যতম সংগঠক হিসেবে আমার নাম উচ্চারিত হলে আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও বিস্ময়ের। রোকেয়া আপা কাফি খান ভাইকে নিয়ে মন্চে দাঁড়ালেন যেন অসাধারন মুহুর্ত।
দিলারা আপার সাথে আমার জীবনে শেষ দেখা সেই দিন। আমার সাথে তাঁর সংক্ষিপ্ত সাক্ষাত্কার বিশেষ দিনটিতে। তিনি যেন মধ্যমনি হয়ে বলেছিলেন আমাদের সামনে। রোকেয়া আপা একটি বিশেষ লাইভ করেছিলেন সেদিন। এবং আমি নিহার ভাই সহ সবার সাথে কথা বলে রেকর্ড করেছিলাম এখন যেন অনন্য ইতিহাস । যাঁরা আমার সাথে কথা বললেন তাঁদের ভেতর চারজন একে একে আমাদের জগতকে যেন অন্ধকার করে চলে গেলেন যথাক্রমে সৈয়দ জিয়াউর রহমান, ইকবাল আহমেদ, কাফি খান ও সবশেষে দিলারা হাশেম।
আমাদের জীবন ও জগত থেকে চলে গেলেন পরম শ্রদ্ধেয় দিলারা আপা। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন অ নে ক কিছু। আমার জন্য প্রচন্ড বিস্ময় ছিলো দিলারা আপার ওয়েবসাইটে। যাঁর সাথে বিশিস্ট ও খ্যাতিমানদের অত্যন্ত নির্বাচিত কিছু ছবি রয়েছে সেখানে। যেমন উত্তম ও সুপ্রিয়া, সত্যজিৎ রায়, শাবানা আজমী, বুলবুল আহমেদ, ববিতা, নওশাদ, সৈয়দ শামসুল হক, জনি ক্যাশ , জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও সেলিনা হোসেন, রোকেয়া আপা, মাসুমা খাতুন সহ আরও অনেক। সবচেয়ে আমার পরম সৌভাগ্য তাঁর বিশেষ ফটো গ্যালারিতে আমিও স্থান পেয়েছি । এক যুগ আগে থেকেই তাঁর সাথে আমার ছবি। আমার জীবনে যেন অনেক বড় পাওয়া।
দিলারা আপা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন অন্য জগতে। সেই ৭৬ সালে বাংলা একাডেমী তিনি এওয়ার্ড পেলেন কিন্তু তাঁর জন্য অবশ্যই পাওয়া ছিলো একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক। তাঁর মতো শক্তিমান লেখক একজন অবশ্যই তুলনাহীন। তিনি যেন আমাদের হৃদয়ে অনন্তকাল থাকবেন, বেঁচে থাকবেন। প্রিয় দিলারা আপা , আপনি যেখানেই খাকুননা কেন ভালো থাকবেন, শান্তিতে থাকবেন।
## এই সবগুলো ছবি তাঁর ওয়েবসাইট থেকে !