পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের বহুল প্রত্যাশিত স্বপ্নের প্রকল্প বলে আখ্যা দিয়েছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম। দেশটির বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘ডেইলি টাইমসে’ লিখিত এক নিবন্ধে দেশটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. মালিকা-ই-আবিদা খাত্তাক এই আখ্যা দেন।
গত ২ জুন প্রকাশিত ওই নিবন্ধে ড. মালিকা লিখেছেন, ‘পদ্মা সেতু বাংলাদেশের বহুল প্রত্যাশিত এক স্বপ্নের প্রকল্প। চলতি বছরের ২৫ জুুন সকাল ১০টায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সেতুটির উদ্বোধন করবেন।’
ড. মালিকা তার নিবন্ধে লিখেন, ‘দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যাত্রীরা দেশের বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটে ফেরিযোগে পারাপার হয়ে চলাচল করেন। ফলে দীর্ঘ যানজটে ভোগান্তিতে পড়তে হতো যাত্রী ও চালকদের। চালু হলে, এটি হবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেতু এবং সড়ক চলাচলের জন্য প্রথম নির্দিষ্ট নদী পারাপার। দ্বি-তলবিশিষ্ট ইস্পাত কাঠামোর সেতুটির ওপরের স্তরে চার লেনের মহাসড়ক এবং নিচে সিঙ্গেল-ট্র্র্র্যাক রেলপথ থাকবে।’
মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্ট ও শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের সঙ্গে সংযোগকারী এই সেতু যাত্রী ও মালামাল পরিবহন সহজ মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে দেশের জিডিপি ১.৩-২ শতাংশ বৃৃদ্ধি করবে বলেও নিবন্ধে উল্লেখ করেন ড. মালিকা।
ড. মালিকা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের মূর্ত প্রতীক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামো সৃষ্টি করে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপনের পাশাপাশি আত্মবিশ্বাস ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। সেতুর নির্মাণের সময় যে ষড়যন্ত্র ছড়িয়ে পড়েছিল তিনি তা দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বাক্ষর বহন করছে। তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশের সক্ষমতা আরও একবার জানার সুযোগ পেল বিশ্ব। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যারা বারবার তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে।’
ডেইলি টাইমসের ওই নিবন্ধে আরও বলা হয়, পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষের দিকে। বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অন্য দাতারাও একই পথ অনুসরণ করেছে। এক সময় পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ ও সেতুর নির্মাণকাজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাংক ও দাতারা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায়। তখন সমালোচকেরা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছিল। শেখ হাসিনার পক্ষে পদ্মা সেতু করা সম্ভব হবে না বলেও বিরূপ মন্তব্যের ঝড় তুলেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা।
ড. মালিকা আরও লিখেন, করোনা মহামারি মধ্যেও সেতুর নির্মাণকাজ পুরোদমে চলেছে। শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণেই সেতুর কাজ একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। সেসময় গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে- সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগবে। সরকার সেই গুজবও দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে।
ওই নিবন্ধে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে শুধু পদ্মা সেতুই নয়, মেট্রোরেল ও দেশের বৃহত্তম বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজও প্রায় শেষের দিকে। সেগুলো এ বছর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। দেশটিতে একই সঙ্গে চলছে অনেকগুলো মেগা প্রকল্পের কাজ; এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি প্রকল্প, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ, পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী নির্মাণ প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণই ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়; এটা দেশের একটি বড় সম্পদ।
প্রাথমিকভাবে, নির্মাণ খরচ কম ছিল উল্লেখ করে ওই নিবন্ধে বলা হয়, কয়েক দফা বৃদ্ধি হওয়া শেষ পর্যন্ত নির্মাণ ব্যয় ৩ দশমিক ৮৬৮ বিলিয়ন (৩৮৬ দশমিক ৮ কোটি) ইউএস ডলারে দাঁড়ায়। নির্মাণের সময় এবং নির্মাণ খরচ উভয় বৃদ্ধি হওয়া নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও আশার বিষয় হলো- সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং জুন মাসেই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
সেতুটি বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত উল্লেখ করে নিবন্ধে ড. মালিকা লিখেন, ‘সেতুটি নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল। সেতুটি চালু হলে দেশের অর্থনীতি চাঙা হবে। দেশের অর্থনীতির কাঠামো বদলে যাবে। কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন হবে। সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটবে।’
ওই নিবন্ধে আরও বলা হয়, ‘পদ্মা সেতু হয়ে উঠতে পারে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একটি অংশ। এই সেতুর কারণে যোগাযোগ ও পরিবহন ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটবে। উন্নয়ন হবে পর্যটন শিল্পের। সেতুর কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে মুন্সীগঞ্জ- শরীয়তপুর সেকশনে ৬ লেনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হয়েছে।’ তিনি লিখেন, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অনন্য ভূমিকা রাখবে এই সেতু। সেতুর চারপাশে গড়ে তোলা হবে রিসোর্ট, হোটেল ও রেস্তোরাঁ। যেখানে বাঙালি খাবার পরিবেশন করা হবে, যা বিদেশিদের কাছে বাঙালি সংস্কৃতিকে আরও পরিচিত করে তুলবে।
পদ্মা সেতুর নাম উচ্চারণ করলে শেখ হাসিনার নাম উচ্চারণ করতে হবে উল্লেখ করে ওই নিবন্ধে বলা হয়, ‘শেখ হাসিনা এবং পদ্মা সেতু একে অপরের পরিপূরক। তাদের আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনার নামে না হলেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জানবে শেখ হাসিনার কারণেই এই সেতু সম্ভব হয়েছে।’
নিবন্ধের শেষে ড. মালিকা লিখেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা আগামী ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার মাধ্যমেই প্রমাণিত হবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে এবং জাতির আস্থাকেও ত্বরান্বিত করেছে।’অর্থকণ্ঠ ডেস্ক