• বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ০৬:৪৬ অপরাহ্ন
Headline
BAMGLADESHI AMERICAN COMMUNITY CHANGEMAKERS দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা পুনরুজ্জীবিত করতে একমত ড. ইউনূস ও শাহবাজ শরিফ ইউনূস-বাইডেন বৈঠক নিয়ে যা বলেছে হোয়াইট হাউস ‘রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের বিমানবন্দরে ভিআইপি সার্ভিস দেব’ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা জরুরি : ড. যশোদা জীবন দেবনাথ মাহবুব সিরাজ তুহিন সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালি ছাত্র ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের অভিভাবক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য সুশাসন, শিক্ষার প্রসার ও প্রযুক্তির উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে : প্রীতি চক্রবর্তী গেঁটেবাত (Rheumatoid Arthritis) ডা. মন্জুর এ খোদা ষড়যন্ত্র-অরাজকতা কঠোর হাতে দমন করব : ড. ইউনূস ইসলামী ব্যাংকে নতুন পর্ষদ, চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ

স্ট্যাগফ্লেশন : বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে?

Reporter Name / ১২০ Time View
Update : বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২২

নীলাঞ্জন কুমার সাহা

নিশ্চলতা-স্ফীতিকে ইংরেজিতে স্ট্যাগফ্লেশন (ঝঃধমভষধঃরড়হ) বলা হয়। অর্থনীতির পরিভাষায় স্ট্যাগফ্লেশন হলো একটি বিরল অর্থনৈতিক অবস্থা যা উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং উচ্চ বেকারত্বের সাথে স্থবির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একত্রিত করে।
স্ট্যাগফ্লেশন শব্দটি- ‘স্থবিরতা’ এবং ‘মুদ্রাস্ফীতির’ একটি মিশ্রণ। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং উচ্চ বেকারত্বের সাথে একত্রিত স্থবির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময়কাল নির্ধারণের জন্য সাধারণত স্ট্যাগফ্লেশন শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
১৯৬৫ সালে যুক্তরাজ্যে তখনকার অর্থনৈতিক অবস্থা বোঝানোর জন্য এই শব্দের উৎপত্তি হয়েছিল। ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অব্যাহত অর্থনৈতিক স্থবিরতার সময় এটা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
১৯৭০-এর দশকের বেশিরভাগ সময় জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্ট্যাগফ্লেশন অব্যাহত ছিল, যা ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে শেষ হয়েছিল। স্ট্যাগফ্লেশন বিরল হলেও এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী যা নির্মূল করা কঠিন। অর্থনীতিতে এটার দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি অনেক ব্যবসা এবং ভোক্তাদের জন্য দুর্বিষহ হতে পারে!
অর্থনীতিবিদেরা ঠিক কী কারণে স্ট্যাগফ্লেশন ঘটে তা নিয়ে একমত নন। যদিও তারা সাধারণত দুটি কারণ উল্লেখ করেন, যেমন বহুল ব্যবহৃত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং রাজস্ব নীতি যা অর্থ সরবরাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে।
১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯৮০ সালে ১৪ শতাংশেরও বেশি হয়ে যায়। তাছাড়া, ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে জ্বালানি তেলের দামের চারগুণ বৃদ্ধি সেই সময়ের অর্থনৈতিক স্ট্যাগফ্লেশন সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
২৪ আগস্ট ২০২২। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্থিক সংবাদ মাধ্যম ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ সতর্ক করছে যে, অব্যাহত ক্রমহ্রাসমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে ১৯৭০-এর দশকের একটি ভয়াবহ শব্দের অর্থাৎ স্ট্যাগফ্লেশনের প্রত্যাবর্তন হতে পারে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইউরোপের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্ট্যাগফ্লেশনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, করোনা মহামারি এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি মন্থর করে দিবে। যার ফলে, দুর্বল প্রবৃদ্ধি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো মজবুত অর্থনীতিতে যদি স্ট্যাগফ্লেশন বিরাজ করে, তাহলে আমাদের অর্থনীতির অবস্থা কী হবে? আমরাও কি স্ট্যাগফ্লেশন-এর দিকে যাচ্ছি? বিষয়টি খুবই চিন্তার!
স্ট্যাগফ্লেশনের প্রধান নিয়ামক হচ্ছে অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই ২০২২ মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৭.৪৮ শতাংশ। জুলাই ২০২১ সালে তা ছিল ৫.৩৬ শতাংশ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর মার্চ ২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ১২.৪৭ শতাংশ। আর গ্রামে এই হার ১২.১০ শতাংশ। আগস্ট ২০২২ সালে জ¦ালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে এটা এখন আকাশচুম্বী।
জ¦ালানি তেলের বাড়ানো করা হয়েছে ৫২ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় দেড় গুণ। জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি স্ট্যাগফ্লেশন তৈরির আর একটি বড় হাতিয়ার।
স্ট্যাগফ্লেশনের সময় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি গড়ে হ্রাস পায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের নমিনাল জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে নমিনাল জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৯৪ শতাংশ।
১৩ বছরে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৬ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষে মুদ্রাস্ফীতির গড় হার দাঁড়িয়েছে ৬.১৫ শতাংশ। যদি মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয় করা হয় তবে, অর্জিত প্রকৃত জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয় খুবই কম। দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য যে রকম লাগামহীনভাবে বাড়ছে তাতে মনে হয়, অচিরেই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যাবে। এই অবস্থা যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে, স্ট্যাগফ্লেশনের সম্ভাবনা উঁকি দিতেই পারে!
উচ্চ বেকারত্ব হলো স্ট্যাগফ্লেশনের একটি সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য। ২০২১ সালের জন্য বাংলাদেশের বেকারত্বের হার ছিল ৫.২৩ শতাংশ। আর ২০২০-এর জন্য ছিল ৫.৪১ শতাংশ যা ২০১৯ থেকে ০.৯৮ শতাংশ বেশি।
‘গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ-২০২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে আইএলও এর তথ্যানুসারে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশি তরুণদের বেকারত্বের হার ১০.৬ শতাংশ। করোনা মহামারির সময় তরুণদের বেকারত্ব উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বেকারত্ব বাড়ার সাথে সাথে মূল্যস্ফীতি সাধারণত কমার কথা। কিন্তু, এক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে স্ট্যাগফ্লেশনেরই ইঙ্গিত দেয়।
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও স্ট্যাগফ্লেশনকে উসকে দেওয়ার মতো বেশকিছু ক্ষতিকারক দিক অর্থনীতিতে বিদ্যমান। যেমন- অর্থপাচার : গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারের মাধ্যমে পুরো দেশকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে।
২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার তথ্য প্রকাশ করেছে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক’। টাকা পাচার রোধে তেমন কোনো কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাস : জুলাই মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল ৩৯,৫৯৯.৯ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪৮,০৬০ মিলিয়ন ডলার। সরকারি হিসাবে আমাদের মজুদ ৩৯ বিলিয়ন ডলার হলেও, আইএমএফের মতে সেটা ৩২ বিলিয়নের বেশি নয়।
রপ্তানির তুলনায় আমদানি বৃদ্ধি : বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৩৩.২৪ বিলিয়ন ডলার। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ২৩.৭৭ বিলিয়ন ডলার।
টাকার মান হ্রাস : ১০ বছরে, মে ২০১২ থেকে মে ২০২২ পর্যন্ত, ডলারের বিপরীতে দেশের টাকা মূল্য হারিয়েছে ৬৩ শতাংশেরও বেশি। শেষ তিন মাসে তা আরও বেশি অবমূল্যায়িত হয়েছে।
সরকারি ঋণ বৃদ্ধি : আমাদের মোট ঋণের পরিমাণ ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৩ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩৩. ৯৭ শতাংশ। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৭ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরের ব্যাংক বহির্ভূত ঋণের মধ্যে শুধু সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে যা ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। ঋণ বৃদ্ধি পেলে ভবিষ্যতে তা পরিশোধের ধাক্কা সামলানো কঠিন হবে।
পরিশেষে, আমাদের অর্থনীতিতে স্ট্যাগফ্লেশন ঘটার সম্ভাবনা শুধুমাত্রই অনুমেয়। সরকারের নীতি নির্ধারকেরাও হয়তো ব্যাপারটি নিয়ে ভাবছেন এবং এটা যাতে আমাদের গ্রাস করতে না পারে তার পাল্টা চক্রেরও ব্যবস্থা করছেন।
স্ট্যাগফ্লেশনের নিয়ামকসমূহ অতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করাই হবে মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে, যা করাই হোক না কেন, তা ভেবে-চিন্তে করতে হবে। কেননা, মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য বেশিরভাগ পদক্ষেপ বেকারত্বের মাত্রা বাড়াতে পারে এবং বেকারত্ব হ্রাস করার জন্য গৃহীত নীতিগুলো মুদ্রাস্ফীতি আরও খারাপ করে দিতে পারে।৩
লেখক : ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category