চাকমা ভাষায় সাবাংগী শব্দের অর্থ এক ছায়াতলের কর্মসঙ্গী। সেই শব্দটির যথার্থতা পাওয়া যায় রাঙামাটির ‘সাবাংগী নেটওয়ার্ক’ নামের প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে রচিত হয়েছে পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের জয়গাথা। স্বাবলম্বী হওয়ার পথ বাতলে দিয়েছে সাবাংগী। কেউ পোশাক-গয়না, কেউবা টি-শার্ট তৈরি করে হয়েছেন সফল নারী উদ্যোক্তা।
সাবাংগী মূলত অনলাইন গ্রুপ। এই গ্রুপের সব সদস্য নারী। সাবাংগীর দুটি ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। একটি ১৭৬ জন নারী উদ্যোক্তার ক্লোজ বা প্রাইভেট গ্রুপ। এই গ্রুপে তারা নিজেদের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে থাকেন। সাবাংগীর অপর একটি গ্রুপ পাবলিক বা সবার জন্য। ওখানে তাদের উৎপাদিত পণ্য প্রদর্শন করা হয়। ওই গ্রুপের ফলোয়ার এখন ৩২ হাজার।
সাবাংগীর মূল সদস্য ১৭৬ জন হলেও তাদের সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তার সংখ্যা তিন শতাধিক। সব উদ্যোক্তা এই গ্রুপে নিজেদের পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রিতে অংশ নেন। অনলাইনে যাত্রা শুরু করা সাবাংগী নেটওয়ার্ক ৮ মার্চ রাঙামাটি শহরের নিউ কোর্ট হিল রোডের পাশে একটি বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছে। সাবাংগীর সাত সদস্য মিলে এটি দিয়েছেন। তবে সেখানে অন্য উদ্যোক্তাদের পোশাকও রাখা হয়েছে। সাবাংগীর মূল উদ্যোক্তা ত্রিশিলা চাকমা। তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস বিষয়ে ¯œœাতক করেছেন। একসময় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। কিন্তু সব সময় নিজে কিছুু করার কথা ভাবতেন তিনি। পাশাপাশি ভাবতেন পাহাড়ের নারীদের নিয়েও। সেই ভাবনা থেকে ২০১৭ সালে ৩৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি টি-শার্ট ডিজাইন শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে সাবাংগী নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয় তার হাত ধরে। সঙ্গে ছিলেন আরও পাঁচ নারী উদ্যোক্তা।
ত্রিশিলা বলেন, ‘ঢাকায় থাকার সময় বিপলী চাকমা নামে এক বড় বোনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি একটি রেস্তোরাঁ চালাতেন কাজীপাড়ায়। টি-শার্ট ডিজাইন করি শুনে তিনি একদিন তার দোকানের ওপর শোরুম করার প্রস্তাব দেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আরও পাঁচ পাহাড়ি তরুণীসহ সাবাংগী নামে শোরুম শুরু করি। ছয়জনই ভিন্ন ভিন্ন পণ্য নিয়ে কাজ করতাম। তবে করোনার কারণে সেটা কয়েক মাসের মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়।’
করোনার বন্ধ দুয়ার থেকে সাবাংগীর অনলাইন যাত্রা শুরু। ২০১৯ সালেই চালু হয় ফেসবুক নেটওয়ার্ক। ধীরে ধীরে উদ্যোক্তা বাড়তে থাকে। মূলত রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়ি নারীরাই সাবাংগী গ্রুপে রয়েছেন। তারা প্রতিনিয়ত অনলাইন মেলা, লাইভসহ নানা ইভেন্টের আয়োজন করে থাকেন।
স¤প্রতি নিউ কোর্ট হিল এলাকায় সাবাংগীর শোরুমে গেলে কথা হয় ত্রিশিলা, রেনেসাঁ ও অন্বেষা চাকমার সঙ্গে। রাঙামাটির রেনেসাঁ চাকমা উদ্ভিদবিদ্যায় ¯œœাতক করছেন। তিনি আগে টিউশনি করতেন। কিন্তু করোনায় টিউশনি চলে গেলে ভেষজ পণ্য তৈরিতে ঝুঁকেছেন। তিনি এখন তুলসী সাবান, ফেসওয়াশ ও বুটিকের পোশাক তৈরি করছেন।
রেনেসাঁ বলেন, ‘এখন টিউশনির চেয়েও ভালো আয় হয়। অনলাইন-অফলাইন দুটিতেই মানুষ আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আমাদের দেখে অনেকে এখন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।’
গৃহবধূ অন্বেষা চাকমা থ্রিপিস ও ছোটদের পোশাক নিজে নকশা করে তৈরি করেন। তার প্রতিষ্ঠানের নাম সমাদৃতার স্বপ্ন। কিন্তু তিনি সাবাংগীর মাধ্যমেই বেশি পরিচিত বলে জানান। স্বামী ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। এখন নিজেই স্বনির্ভর বলে জানালেন।
শোরুমটিতে রয়েছে বাদাম, তেল, সাবান থেকে শুরু করে বুটিকের থ্রিপিস, টি-শার্ট, পাহাড়ি বেইন কাপড়ের থামি, শার্ট, লুঙ্গি ও গামছা। বিজু উপলক্ষে পাহাড়ি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সামনে রেখে নতুন পোশাক তোলা হয়েছে।
ত্রিশিলা জানান, তাদের অনলাইন-অফলাইন মিলে কমপক্ষে মাসে বিক্রি এখন ২৫ লাখ টাকা। মূল ক্রেতা পাহাড়িরা। পাশাপাশি বাঙালিরাও কেনেন তাদের পোশাক। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকেও পণ্যের ফরমায়েশ পান তারা।
শুধু সদরের নয়, তিন পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত উপজেলার অনেকেই উদ্যোক্তা হয়েছেন সাবাংগীর মাধ্যমে। মারিশ্যা উপজেলার চেতনা চাকমা শুঁটকি পণ্য তৈরি করেন। দুর্গম এলাকার এই তরুণী এখন নিজের পেশা নিয়েই বেশ খুশি। শোরুমে আসা ক্রেতা মায়া চাকমা বলেন, ‘সাবাংগীর অনলাইনে তাদের পণ্যগুলো দেখি। অনলাইন-অফলাইন সব জায়গা থেকে কিনি। ভালোই লাগে।’
ত্রিশিলা স্বপ্ন দেখেন, সাবাংগীর নারী উদ্যোক্তা একদিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘দিন শেষে পাহাড়ি নারীদের হাসিমুখ আমাকে আনন্দ দেয়।’
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) সহকারী ব্যবস্থাপক মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, সাবাংগী খুব দ্রুত তাদের প্রসার ও ব্যপ্তি বাড়িয়েছে। তারা বিসিকের বিভিন্নœ প্রশিক্ষণও নেন। স্বাধীনতা দিবসে বিসিকের যে মেলা হবে, তাতে সাবাংগী একাই ছয়টি দোকান নিয়েছে। এতেই বোঝা যায় তাদের উন্নতি।