• রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:৩৪ অপরাহ্ন

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডে জড়িত একজন আটক

Reporter Name / ১০০ Time View
Update : শুক্রবার, ১ অক্টোবর, ২০২১

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডে জড়িত আটক-১

জাফর আলম, কক্সবাজার,০১ অক্টোবর

কক্সবাজার জেলার উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মাস্টার মুহিব্বুল্লাহ হত্যা কান্ডে জড়িত মোহাম্মদ সেলিম উল্লাহ প্রকাশ লম্বা সেলিম (২৭) নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
শুক্রবার (০১ অক্টোবর) সকাল ১১ টার দিকে এপিবিএন সদস্যরা কুতুপালং ক্যাম্প-৬ থেকে তাকে গ্রেফতার করেন ।

বিষয়টি সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অধিনায়ক মোঃ নাইমুল হক। তিনি জানান, মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে মোহাম্মদ সেলিম প্রকাশ লম্বা সেলিমকে গ্রেফতার করে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।

বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের লম্বাশিয়ায় অবস্থিত এআরএসপিএইচ কার্যালয়ের সামনে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ।

এ ঘটনায় ২৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ। যার নং-১২৬/২০২১। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া ও তাদের মানবাধিকার নিয়ে দেশে-বিদেশে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন মুহিবুল্লাহ। সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। ক্লিন ইমেজের কারণে তাকে সবাই মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন। চালচলনেও ছিলেন অত্যন্ত সাদামাটা। মিয়ানমারে বসবাসের সময় তিনি সেখানকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করায় রোহিঙ্গারা তাকে ‘মাস্টার’ বলে সম্বোধন করতেন। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের যে কোনো বিপদে-আপদে ছুটে যেতেন তিনি। শিক্ষায় অনগ্রসর রোহিঙ্গাদের কাছে ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ ছিলেন সত্যিকারের আদর্শ। অনেকে তাদের ‘মুক্তির দূত’ হিসেবে বিবেচনা করতেন। নির্লোভ ও পরোপকারী মুহিবুল্লাহ শেষ পর্যন্ত টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হলেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কেন কারা তাকে হত্যা করল? তাকে সরিয়ে দিয়ে খুনিরা কার স্বার্থ হাসিল করেছে?

মুহিবুল্লাহর স্বজন ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ওপর নজর রাখে- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, চাঞ্চল্যকর এই খুনের নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করেছেন আবদুর রহিম নামের এক রোহিঙ্গা। সরাসরিও হত্যা মিশনে ছিলেন তিনি। পেছন থেকে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন আবদুল্লাহ ও হাসেম নামের আরও দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। রহিম রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একজন নেতা। তার সন্ত্রাসী সংগঠন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের প্রত্যাবাসনবিরোধী। এ লক্ষ্যে তারা ক্যাম্পে নানা ভয়-ভীতি ও প্রচারও চালায়। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে দীর্ঘদিন ধরেই অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। তৃতীয় কোনো পক্ষের হয়ে মুহিবুল্লাহকে খুন করা হয়েছে কিনা, তাও গুরুত্বসহকারে অনুসন্ধান করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। খুনিদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবসনের প্রধান কণ্ঠস্বরকে সরিয়ে দেওয়া- এমন ধারণা করছেন সংশ্নিষ্টরা। এর পক্ষে এরই মধ্যে নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত মিলছে।

মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের মংডুর টাইনশীপ সিকদার পাড়ায় ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ফজল আহমদ, মাতার নাম উম্মুল ফজল। তিন ভাই, চার বোনের মধ্যে মুহিবুল্লাহ সবার বড়। মুহিবুল্লাহ বিবাহিত এবং ৯ সন্তানের জনক। মিয়ানমারে থাকতে তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষকতার সূত্রে তিনি ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ নামে রোহিঙ্গাদের কাছে পরিচিত।
উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ১ নম্বর (পূর্ব) ক্যাম্পের ডি ব্লকে ছোট একটি ঝুপড়ি ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। এই বসতঘরের সামনে অন্য একটি ঘর রয়েছে। এটিকে ব্যবহার করতেন অফিস হিসেবে। ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’-এর অফিস এটি। এই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন মুহিবুল্লাহ। অফিসঘরে বসেই প্রয়োজনীয় কাজ করতেন তিনি। সংগঠনের সভা-মিটিং করতেন। প্রতিদিন রাতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আড্ডাও দিতেন। বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে এশার নামাজ শেষ করে অফিসে এসে বসেন মুহিবুল্লাহ। সঙ্গে ছিলেন আরও সাত থেকে আটজন। তাদের উদ্দেশ করে মুহিবুল্লাহ বলছিলেন, ‘পরিস্থিতি শিগগির অনুকূলে আসবে। মিয়ানমারের সঙ্গে কয়েকটি দেশের আলোচনা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা রাজি হয়েছে। আমাদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে।’ মুহিবুল্লাহ কথা শেষ করার আগেই ঘরে প্রবেশ করে ১০-১২ জন মুখোশ পরিহিত সশস্ত্র ব্যক্তি। ঘরের বাইরে ছিল আরও ৮-১০ জন। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্র। একজন পিস্তল উঁচিয়ে কিছুটা এগিয়ে আসে। এরপর সোজা মুহিবুল্লাহকে লক্ষ্য করে পরপর পাঁচ রাউন্ড গুলি করে। মুহিবুল্লাহ চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়েন মাটিতে। এরপর হামলাকারীরা পশ্চিম দিকে পাহাড়ি পথে চলে যায়। এভাবেই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়েছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত নুরুল আমিন (৪৫)। তিনি সম্পর্কে মুহিবুল্লাহর চাচাতো ভাই। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার সময় একজন আমার মুখে সজোরে ঘুসি মারে। তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পর আমরা পুলিশ ডেকে নিয়ে আসি। তাদের সহযোগিতায় গুলিবিদ্ধ মুহিবুল্লাহকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’ নুরুল আমিন জানান, মুহিবুল্লাহর শরীরে চারটি গুলির চিহ্ন দেখা গেছে। এর মধ্যে দুটি গুলি লেগেছে পেটে, একটি বুকে এবং অন্য একটি গুলি ডান বাহু দিয়ে বের হয়ে গেছে।

মুহিবুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন সংগঠন উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা এই হত্যার দ্রুত তদন্ত ও বিচার চেয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) আসরের নামাজের পর উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্প-১, ইস্ট ২ নম্বর কেন্দ্রে নামাজে জানাজা শেষে পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category