জাফর আলম, কক্সবাজার
কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলেছে দুই ‘সাইফুল’ এর ইয়াবা রাজত্ব। পাশ্ববর্তী দেশমিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় বড় চালান দুই সাইফুলের নামে দেশে আসলেও তালিকাভুক্ত সীমান্তে ইয়াবা ডন খ্যাত সাইফুল করিমের নাম বার বার উঠে এসেছে।অনেকটা অপ্রকাশিত ছিল আরেক শীর্ষ ইয়াবা কারবারী সাইফুল ইসলামের নাম। ২৫ সদস্যের ‘উপকূলীয় ইয়াবা সিন্ডিকেট’ গঠন করে এই সাইফুল সাগর পথে ইয়াবা এনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়েছে। গত ১১ জানুয়ারী সাইফুলের ইয়াবা ও আইস নিয়ে তার ফিশিং বোট মাঝি সৈয়দ করিম মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে সাইফুল ইসলামের ইয়াবা সাম্রাজ্যের অজানা সব তথ্য। ফিশিং বোট মাঝি সৈয়দ করিমকে দিয়ে ইয়াবা ও আইস পাচারের অভিযোগে সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করেছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
জানা গেছে, সীমান্তে ইয়াবা ডন খ্যাত দুই সাইফুলের মধ্যে ২০১৯ সালের ৩১ মে হাজী সাইফুল করিমের অধ্যায়ের ইতি হয়। সেই সময়ে পুলিশের সাথে কথিত বন্দুক যুদ্ধ নিহত হওয়ার পর অনেকটা আলোচিত সমালোচিত হাজী সাইফুল করিমকে ভুলে যেতে বসেছিল মানুষ।
কিন্তু আরেক সাইফুল টেকনাফ উপকূলে ২৫ জনের সিন্ডিকেট করে সাগর পথে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইস এর বড় বড় চালান আনার খবর উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। হাল সময়ে উপকূলে দাউদ ইব্রাহিম খ্যাতি অর্জন করেছে এই সাইফুল ইসলাম।অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ লেঙ্গুরবিল গ্রামের সৈয়দ হোসেনের ছেলে সাইফুল ইসলাম। শীর্ষ ইয়াবা গডফাদার (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত)
বিএনপি নেতা জাফর আহম্মদ প্রকাশ জাফরের সাথে রাজনীতির পাশাপাশি ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন সাইফুল ইসলাম। আস্তে আস্তে সীমান্তের ওপারেও ইয়াবা ব্যবসা রপ্ত করেন।
পর্যাক্রমে মিয়ানমারের ইয়াবা কারবারীদের কাছে আস্থা অর্জন করার পর তাকে আর পিছন ফিরে থাকাতে হয়নি। আরও জানা গেছে,হাজী সাইফুল করিমের পাশাপাশি সাইফুল ইসলামও ইয়াবার জগতে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। নিজেই কিনে নেন তিনটি ফিশিং বোট। সাগরে মাছ শিকারের নামে সিন্ডিকেট সদস্যদের দিয়ে সাগর পথে মাদক, আইসের পাশাপাশি বিদেশী অস্ত্রের ব্যবসায়ও জড়ায় সাইফুল। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক সন্ত্রাসীদের কাছে নাইন এমএম পিস্তল ও দেশীয় তৈরি বন্দুক সরবরাহের অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। ব্যাংক ব্যালেঞ্চ সহ শত কোটি টাকার মালিক এই উপকূলীয় সিন্ডিকেট প্রধান সাইফুল। তার বিরুদ্ধে ঢাকা যাত্রাবাড়ী, টেকনাফ, রামুসহ বিভিন্ন থানায় মামলাও রয়েছে। ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত থেকে ২০১১ সাল থেকে ২৫ জনের উপকূলীয় সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক তিনি। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সরাসরি মিয়ানমারের ইয়াবা কারখানা থেকে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইস পাচার করেছে। ২০১৪ সালে রামু থানায় ইয়াবাসহ প্রথম আটক হন সাইফুল ইসলাম।
ডিএনসি টেকনাফ বিশেষ জোন সুত্রে জানা গেছে, গত ১১ জানুয়ারী বিকালে সাইফুল ইসলামের ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার
> আ্যমফিটামিন যুক্ত ইয়াবা ট্যাবলেট ও ক্রিস্টাল মেথ পাচারের সময় ফিশিং বোট মাঝি সৈয়দ করিমকে টেকনাফ রাজার ছড়া মেরিন ড্রাইভ রোডেস্থ নাহিদ স্টোরের নামনে আটক করেন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর টেকনাফ বিশেষ জোনের রেইডিং টীম।আটক সৈয়দ করিম মাঝি ডিএনসির জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, জব্দকৃত ইয়াবা ও আইস সাইফুল ইসলাম তাকে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে কক্সবাজার পৌঁছে দেওয়ার জন্য দিয়ে ছিল। এব্যাপারে টেকনাফ বিশেষ জোনের উপ-পরিদর্শক তুন্ত্ত মনি চাকমা বাদী হয়ে ধৃত সৈয়দ করিম মাঝি ও ইয়াবা ডন সাইফুল ইসলামকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। টেকনাফ থানার মামলা নং- ৪৩, জিআর-৪৩। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাইফুলের উপকূলীয় ইয়াবা সিন্ডিকেটের অন্যান্য সদস্যরা হলেন, মিঠাপানির ছড়ার নুর বশর প্রকাশ বুলু ড্রাইভার তার রয়েছে তিনটি ফিশিং বোট, টেকনাফ সদর
হাতীয়ার ঘোনার আব্দুল্লাহ,উত্তর লেঙ্গুরবিলের মোঃ আয়াছ, সোলাইমান,জাহালিয়া পাড়ার মোঃ জাফর, মোঃ আয়াছ ( মৃত মোহাম্মদ উল্লাহ), হাতিয়ার ঘোনার মোঃ আবদুল্লাহ ও একই এলাকার মোহাম্মদ রশীদ (আনুইয়া)। এদের প্রত্যেকের রয়েছে ফিশিং বোট। মাদক মামলার আসামীও তারা।স্থানীয় বাসিন্দারা আরও জানান, ইয়াবার চালান নিয়ে প্রথম কক্সবাজারের রামু থানায় গ্রেফতার হন সাইফুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে কক্সবাজারের রামু থানার মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্ণ আইনে মামলা নং ২৩/৩৭৩,১৬ অক্টোবর ২০১৪ দায়ের করা হয়। এরপর দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে এসে ফের শুরু করেন মাদক চোরাচালান ব্যবসা।টেকনাফ মডেল থানা পুলিশের একটি সুত্র জানায়, ইয়াবা কারবারী সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানার মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা নং ৪৪/৩১২, তাং-১৩ এপ্রিল ২০১৭।ডিএমপি যাত্রাবাড়ী থানার মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা নং ৫০/১৩৫২,তাং-১১ ডিসেম্বর ২০১৮, টেকনাফ
থানার মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা নং ২২/৫৪৫, তাং-১০ জুলাই ২০২১, টেকনাফ থানার মামলা নং-১৯/৬৪১, তাং-৪ আগস্ট ২০২১, সর্বশেষ টেকনাফ থানার মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা নং ৪৩/৪৩, তাং-১১ জানুয়ারী ২০২২ মামলা রয়েছে। একাধিক দায়িত্বশীল সুত্রে প্রকাশ, ক্রিস্টাল মেথ
আইস ও ইয়াবা আনেন সরাসরি মিয়ানমারের আকিয়াব থেকে। ওপারের রোহিঙ্গাদের সাথে সিন্ডিকেট আছে তার। রোহিঙ্গাদের ১০/১৫ জন দেশী ও রোহিঙ্গা ডাকাত দিয়ে সশস্ত্র পাহারায় বিভিন্ন সময়ে টেকনাফ লেংগুর বিল ঘাট, তুলাতলি ঘাট, হাতিয়ার ঘোনার ঘাট, মিটাপানির ছড়া ঘাট, হাবিরছরা ঘাট, নোয়াখালী পাড়া ঘাটে ইয়াবা খালাস করে। ৩০টি মাছ ধরার ট্রলার আছে উপকূলীয় এই সিন্ডিকেটের। সব ফিশিং বোটের মাঝিরা রোহিঙ্গা হওয়ায় তারা ওই দেশের সব জায়গা চিনেন এবং সাগরপথও অজানা নয়। এই সাইফুল উপকূলীয় সিন্ডিকেট সহ স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের সমন্বয়ে গঠিত আরও ৩/৪ টি ইয়াবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বলেও অভিযোগ । একটি সুত্রে জানা গেছে,
এই উপকূলীয় সিন্ডিকেট ঠিকিয়ে রাখতে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সুরক্ষায় ঢাকা থেকে জনৈক আবদুল বারি নামের ব্যক্তি বিভিন্ন দপ্তরে তদবির চালায় বলে অভিযোগ। তার পরিচয় সনাক্তে কাজ করতে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
এই আবদুল বারি নামের ব্যক্তিই সীমান্তে ইয়াবা সিন্ডিকেট সদস্যদের সুরক্ষার কথা বলে ফায়দাও হাসিল করছে বলে সুত্রে প্রকাশ।
পুলিশ সুত্রে জানা গেছে, টেকনাফে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে শুরু হলে ক্রসফায়ার ভয়ে জীবন বাচাতে দুবাই পালিয়ে যান সাইফুল। মেজর সিনহা হত্যার পর মাদকের বিরুদ্ধে ভাটা পড়লে ফের চলে আসে বাংলাদেশে। চালিয়ে আসছিল মাদক ব্যবসা। অর্ধডজন মাদক মামলা মাথায় নিয়ে গ্রেফতার এড়াতে এই সাইফুল আবারও বিদেশ পাঠালোর চেস্টায় সব আয়োজন শেষ করেছে বলে বিভিন্ন সুত্রে প্রকাশ।