অলরাউন্ডার ইমরান খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান ১৯৯২ সালে ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জয় করেছিল। সে বিশ্বকাপ জয়ে পাকিস্তান দলের সঙ্গে বৃষ্টির অবদানের কথা আমরা জানি। সেটি ক্রিকেট; গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। কিন্তু রাজনীতির প্রেক্ষাপট ভিন্ন। যাই হোক, খেলা থেকে অবসর নিয়ে এক সময়ের এই ক্রিকেটার যখন দল গঠন করেন, তখন ২০০২ সালে নির্বাচনে আসন পান একটি। তেহরিক-ই-ইনসাফ নামে এই ক্রিকেটারের দলের বাংলা অর্থ হচ্ছে, বিচারের জন্য পাকিস্তান আন্দোলন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ৩৪টি আসন পেয়ে সবার দৃষ্টিতে চলে আসে ইমরান খানের দল। ২০১৮-এর নির্বাচনে তেহরিক-ই-ইনসাফ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে, জোট সরকার গঠন করে ইমরান খান হয়ে যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
পাকিস্তানে সেনাবাহিনী প্রধানের পদটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্রটির জন্মদাতা জিন্নাহ ভারতবর্র্ষের স্বাধীনতার সময় মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্ন ও ধর্মের নামে জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব তুলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টি করেন। যে অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছে পাকিস্তান, জিন্নাহ সে অঞ্চলের বাসিন্দা না। পাকিস্তান জন্মের পরপরই এক বছরের মধ্যে জিন্নাহ যক্ষ্ণারোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান। ১৯৫১ সালে দেশটির প্রথম সেনাপ্রধান আকবর খান পাঠান পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাজ্জাদ জহিরের সহযোগিতায় ক্ষমতা দখল করতে চাইলে তা ব্যর্থ হয়। তার কিছুদিন পরেই আততায়ীর হাতে নিহত হন দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। হত্যার তদন্ত রিপোর্ট আজও অপ্রকাশিত, বিচারের প্রশ্নই আসে না। তারপর সেনাপ্রধান হন জেনারেল আইয়ুব খান। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীই হয়ে যায় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। দেশটির পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশ নামে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৃশংস হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে বাংলাদেশে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীই পৃথিবীর একমাত্র সেনাবাহিনী যা নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
দেশটিতে সামরিক বাহিনীর প্রধানরাই বেশিরভাগ সময়ে সরকারপ্রধান হয়েছেন। স্নায়ুযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনুকূল্যে বেড়ে ওঠা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আমেরিকা শক্তিশালী করে তুলেছে। আজ সেই সেনাবাহিনীই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে কিনা সেটা দেখার জন্য হয়তো আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
সাম্প্রতিককালে পাকিস্তান মার্কিন বলয় থেকে বেরিয়ে এসে চীন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করছিল। আফগানিস্তানের তালেবানের বিরুদ্ধে যখন লড়াই করছে আমেরিকা, সে সময় পাকিস্তানের জনগণ আফগান তালেবানকেই নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। গ্যালাপ পাকিস্তান নামের একটি সংগঠনের জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৭২ শতাংশ পাকিস্তানি যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের শত্রু মনে করে। গণমাধ্যম বলছে, চীন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অতি মাখামাখির খেসারত দিতে হচ্ছে ইমরান খানকে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে বরাবরই আমেরিকান রাষ্ট্রদূত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। পাকিস্তানের ক্ষমতা বদলে আমেরিকা ষড়যন্ত্র করছে- এমন অভিযোগ ভদ্মাদিমির পুতিনের।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বারবার শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। বারবারই তা লঙ্ঘিত হয়েছে। দেশটির বিচার বিভাগও ক্ষমতার প্রশ্নে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যায়। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় থাকাকালে প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মোহাম্মদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলেন। আবার এও সত্য, সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বিমানে থাকা অবস্থায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে বরখাস্ত করেছিলেন এবং পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট এই আদেশের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট এই আদেশে ফরাসি বিপ্লবের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। এটি পাকিস্তানেই সম্ভব। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র রাষ্ট্র যার উচ্চ আদালত সংবিধানের বাইরে গিয়ে সামরিক শাসনকে বৈধতা দেন।
পাকিস্তান নিয়ে এত আলোচনার মোদ্দা কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রটি সৃষ্টিই হয়েছে এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য। মুসলিম ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে তার বিপরীতে ভিন্ন ধর্মের উন্মাদনা সৃষ্টি করার জন্য। তাই পাকিস্তান কখনও স্থিতিশীল থাকে না। আজ অবধি দেশটির সব প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। কেউ হয়েছেন দেশান্তরী হয়েছে, কেউ গেছেন জেলে অথবা কেউবা হয়েছেন নিহত, কারও হয়েছে ফাঁসি। মাঝেমধ্যে কিছু সেনা চাটুকার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তারা জনগণের ভেতর কোনো ভিত রচনা করার কথা চিন্তাও করেননি। বুটের তলায় মাথা রেখে একদিন বিদায় নিয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, ক্রিকেটার থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইমরান খানের ভাগ্যে কী ঘটবে এই সময়ে। বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব আনলে দেশটির প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে পত্র দিয়েছেন। বিরোধীরা গেছেন উচ্চ আদালতে। সেখানে প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালের নেতৃত্বে বেঞ্চের সিদ্ধান্তে পার্লামেন্ট পুনর্বহাল হয়েছে। শাহবাজ শরিফ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী। এ পর্যন্ত দেশটিতে ২২ জন প্রধানমন্ত্রী এসেছেন, যারা কেউই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ আর প্রয়াত বেনজিরের পিপলস পার্টিসহ বহু পার্টির সমন্বয়ে জোট সরকার। পেছনের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, এত পার্টির জোট সরকারের মেয়াদ পূর্ণ করা কঠিন।
পাকিস্তান বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল না। ইমরান খানের রাজনৈতিক দল ও জীবন কেমন করে বেঁচে থাকবে, আগাম নির্বাচন যদি হয় তাহলে সত্যি কি তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে নাকি মিলিয়ে যাবে, সেই প্রশ্ন। যেই বৃষ্টি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে দিয়েছিল, সেই বৃষ্টিই পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জয় করে এনে দিয়েছিল। বৃষ্টির মতোই পাকিস্তানের রাজনীতিতে কোনটা যে কখন কার জন্য আশীর্বাদ আর কোনটা যে কখন কার জন্য অভিশাপ, সেটা বলা মুশকিল।
ঝড়-বৃষ্টি-বন্যা-খরা আমরা এসবের কিছুই চাইব না। আমরা চাইব, পাকিস্তানে গণতন্ত্র ও প্রগতির ধারার সূচনা। যা এ অঞ্চলের গণতন্ত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চর্চাকে শক্তিশালী করবে।
রুস্তম আলী খোকন
কলাম লেখক; সাবেক ছাত্রনেতা