• শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:২৮ অপরাহ্ন

সাধারণ ক্যাডারে প্রকৌশলী-চিকিৎসক

Reporter Name / ১৪৬ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২২

বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের বিসিএস প্রবণতা অত্যধিক হারে বেড়েছে। সম্প্রতি বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ পাওয়ার পর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেশা বদল বিষয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অভিভাবকরা যে সন্তানকে নিয়ে ছোটবেলা থেকেই চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলী বানানোর স্বপ্ন দেখতেন, তারাও এখন চিকিৎসাবিদ্যা-প্রকৌশলবিদ্যা পড়ালেও ভবিষ্যতে বিসিএসের একটি দাপুটে ক্যাডার চেয়ারে দেখতে চান। উল্লেখ্য, বর্তমান বাস্তবতায় দাপুটে ক্যাডার বলতে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত পুলিশ, প্রশাসন এবং পররাষ্ট্রকে বোঝানো হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী চিকিৎসা ডিগ্রি কিংবা প্রকৌশলে পড়ে তার নিজের দক্ষতানির্ভর পেশায় যাচ্ছে না। কারণ ওইসব ক্যাডারের সুযোগ-সুবিধা তার নিজ ক্ষেত্রের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ তাদের মেধার ক্ষেত্রে কোনো কমতি নেই।

মেধাক্রম এবং ক্যাডার পছন্দক্রম বিবেচনাতেই যেহেতু বিসিএসে চাকরি হয়, সেহেতু নিজের সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করে তাদের সুবিধাভিত্তিক ক্যাডারে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইদানীং বিসিএসের পূর্ণাঙ্গ ফলচিত্রে দেখা গেছে, পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্সের মতো শীর্ষ ক্যাডারের বেশিরভাগ পদে মনোনীত হচ্ছেন এমবিবিএস এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা প্রার্থীরা। ক্রমাগতভাবে পরপর কয়েকটি বিসিএসে এমন চিত্র আমরা লক্ষ্য করলাম। এ প্রবণতার অন্যতম কারণ হিসেবে আন্তঃক্যাডার বৈষম্যকেই দায়ী করা যায়। সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে ক্যাডারভেদে পদোন্নতিতে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য।

আমরা দেখি, বিসিএস পরীক্ষায় ক্যাডার পছন্দক্রম ফরম পূরণ করতে গিয়ে শিক্ষা ক্যাডারকে অনেক নিচের ক্রমে রাখা হয়। কারণ একজন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তার সুযোগ-সুবিধা পূর্বে উল্লিখিত দাপুটে ক্যাডারের তুলনায় অনেক কম। তা ছাড়া প্রভাব-প্রতিপত্তির বিষয় তো রয়েছেই। অথচ শিক্ষকতা একটি আদর্শ পেশা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে মেধাবীদের এই পেশায় আসার প্রবণতা লক্ষণীয় মাত্রায় থাকার কথা। শুধু বৈষম্যের কারণে এখন আর কেউ বাই-চয়েস শিক্ষকতায় আসতে চাচ্ছে না। ঠিক একইভাবে ডাক্তারি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে তারা ওই পেশাতেও থাকতে চাচ্ছে না। কারণ সেখানেও ক্যাডারভেদে দৃশ্যমান বৈষম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছ। বাস্তবতা এমন একটি পর্যায়ে এসেছে, অনেকেই মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছে না নিজ দক্ষতানির্ভর পেশায় থেকে।
আমাদের দেশে যারা সবচেয়ে মেধাবী তারা মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়। তাই বিসিএসের মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়ও যে তারা ভালো করবে এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা একজন ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডাক্তারি পড়া শিক্ষার্থীর জন্য উত্তর করা অনেকটা সহজ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ বিষয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা কম নম্বর পেয়ে ক্যাডার পছন্দের পেছন সারিতে চলে যাচ্ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার স্তর অনেকটা বিসিএসমুখী হয়ে উঠছে। কারণ স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনার ভিত্তিতে কোনো শিক্ষার্থী ভালো চাকরির সুযোগ পায় না। এ কারণে স্নাতক পর্যায়ের শুরু থেকেই তারা বিসিএস সিলেবাস আত্মস্থ করার চেষ্টা করে যায়। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হলো, একটি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া; সে বিষয়ে জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান উন্নয়ন কিংবা জ্ঞানের সম্প্রসারণ। সুদূর দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে সেই জায়গাটা দখল করে নিয়েছে বিসিএস গাইড বই। ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ক্লাসে লেকচার না শুনে, মনোযোগ না দিয়ে বিসিএস গাইড পড়ে। সম্মান শ্রেণিতেও পড়ে, মাস্টার্সেও পড়ে। আবার পড়াশোনা শেষ করে পাঁচ বছর সেই একই বইগুলো পড়ে।

শিক্ষার্থীরা পঠিত বিষয়ের অর্জিত জ্ঞান, শিক্ষা বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করতে পারছে না। তাহলে এই শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? কিছু ব্যতিক্রম থাকবে। কিন্তু গণহারে পেশা বদলের বিষয়টি কোনোভাবেই শুভ লক্ষণ নয়। একজন শিক্ষার্থী লোকপ্রশাসন কিংবা সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়াদি- সরকার, রাষ্ট্র, রাজনীতি, প্রশাসন ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে ৫ বছর পড়াশোনা করে। আবার যেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কিংবা রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়- পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে ৫ বছর পড়াশোনা করে। তাহলে এ অর্জিত শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? বিসিএস সিলেবাসে যেখানে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, উচ্চতর গণিত, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার। মানবিক কিংবা কলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা যেখানে গণিত, উচ্চতর গণিত, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার বিষয়ে কম অবগত। কারণ তারা এসব বিষয় পড়ে না। কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগ কিংবা মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পর্যায় থেকে বিজ্ঞান, কম্পিউটার, গণিত পড়ে অভ্যস্ত। তাই তাদের বিসিএসে প্রবেশে খুব বেগ পেতে হয় না। আর অপেক্ষাকৃত মেধাবী হওয়ায় তারা ইচ্ছামতো ক্যাডার চয়েস করতে পারছে। এতে হোঁচট খাচ্ছে মানবিক কিংবা কলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে দেখা যায়, যারা যে বিষয়ে পড়াশোনা করছে; পড়াশোনা শেষে তারা সে বিষয় সম্পর্কিত চাকরিতে যোগদান করছে। কিন্তু আমাদের দেশে এর উল্টো চিত্রই লক্ষ্য করা যায়। ইদানীং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ফলে বিভিন্ন কারণেই অধিকাংশের প্রথম পছন্দ বিসিএস।
এই মুহূর্তে আমাদের দেশের কর্মসংস্থান পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। প্রভাব-প্রতিপত্তি, মর্যাদা, সম্মান এবং সুযোগ-সুবিধা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আবদ্ধ না রেখে এর যথাযথ প্রয়োগ ঘটালে এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কমিয়ে আনলে এমন পেশা বদলের প্রবণতা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category