• শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:১০ অপরাহ্ন

আসুন, মাতৃভূমির ঋণ শোধ করি

ড. নুরুন নবী / ১৩৮ Time View
Update : সোমবার, ৯ মে, ২০২২

ড. নুরুন নবী, এ নিবন্ধের লেখক

আমরা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিরা আসলে এক দিক দিয়ে ভাগ্যবান। কারণ, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমরা এখানে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করি। নিজেদের অবশ্যই ভাগ্যবান ভাবতে পারি, কারণ আমাদের সন্তানদের ভালো মানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুবিধা নিশ্চিত করতে পারছি। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের বেশির ভাগেরই নিজেদের বাড়ি আছে, ব্যাংক হিসাবটাও স্বাস্থ্যবান, শেয়ারবাজারে আছে বিনিয়োগ।

প্রশ্নœটা হলো, বিদেশের মাটিতে আমাদের সাফল্যের পেছনে আমরা কি মাতৃভূমির কাছে ঋণী? উত্তরটা অবশ্যই ‘হ্যাঁ’। আমরা অবশ্যই আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের কাছে ঋণী। বেশির ভাগ প্রবাসী বাংলাদেশির প্রথম প্রজন্মই বাংলাদেশের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার সুফলভোগী, যেটা দেশের করদাতাদের টাকায় পরিচালিত হয়। এর ফলে আমাদের খুব সামান্যই টিউশন ফি দিতে হতো, আমাদের অনেকেই আবার পূর্ণবৃত্তি পেয়েও বিনা অর্থে পড়াশোনা করেছে। এ কারণেই আমরা আমাদের মাতৃভূমি এবং এর জনগণের প্রতি ঋণী। আমরা যেমন আমাদের মায়ের প্রতি সব সময়ই কৃতজ্ঞ থাকি, সব সময়ই তার যতœ নিই, একইভাবে আমাদের উচিত মাতৃভূমিরও যতœ নেওয়া।

দেশের প্রতি আমাদের এই ঋণভার আমরা লাঘব করতে পারি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনীতি এবং জীবনমান উন্নয়নে অবদান রেখে। ব্যাংক, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, প্রযুক্তি-স্থানান্তর নানা খাতেই এ বিনিয়োগ হতে পারে।

বাংলাদেশ যে একটি বিকাশমান অর্থনীতির দেশ, এ তো বিশ্ব অর্থনীতির মানুষেরাই বলছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ তাই শুধু দেশের প্রতি আমাদের ঋণ শোধই হবে না, এতে করে আমরাও আর্থিকভাবে লাভবান হবো। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি তিনটি সূচকে প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের চেয়েও ভালো। এ তিনটি সূচক হলো নবজাতকের মৃত্যুর নি¤œ হার, গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারের হার। বাংলাদেশের জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, এ হার শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও ভারতের সঙ্গে তুলনা করার মতো; পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ ও নেপালের চেয়ে ভালো।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, বাংলাদেশ ‘৭ শতাংশের ক্লাবে’ যোগ দিয়ে প্রতিবছর ৭ শতাংশ করে এ অর্থনীতিকে বিকশিত করে গড়ে এক দশকে অর্থনীতির আকার প্রায় দ্বিগুণ করে ফেলতে পারে। যে ক্লাবের বর্তমান সদস্যরা হলো চীন, কম্বোডিয়া, ভারত, মোজাম্বিক ও উগান্ডা। এইচএসবিসির অর্থনীতিবিদেরা বাংলাদেশকে ২৬টি দেশের মধ্যে রেখেছেন, যার মধ্যে আছে চীন, ভারতসহ লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশ, যেখানে দৃঢ়ভাবে বিকশিত হচ্ছে অর্থনীতি। যেখানে ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতিই বরং তেমন একটা স্থিতিশীল নয়।

বিশ্বব্যাংক এবং সিআইএর ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুকের প্রতিবেদন বলছে, ‘বিশ্বের ২৯টি সবচেয়ে আবেদনময় অর্থনীতি’র তালিকায় বাংলাদেশ আছে ১৯ নম্বরে, এক নম্বরে আছে ইরাক। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও. ব্লেক ২০১২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল হতে পারে। বাংলাদেশ হতে পারে এশিয়ার ‘নতুন রেশমি পথ’। তিনি এ-ও বলেছিলেন, নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য প্রতিবেশী ভারত ছাড়িয়ে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় পৌঁছে যাবে।

শেরশাহের আমলের ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের মতো ‘নতুন রেশমি পথ’ এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভূয়সী প্রশংসা করে যুক্তরাষ্ট্রের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে। অবকাঠামোগত এবং বিনিয়োগের অন্তরায়গুলো দূর করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থাতেই আছে। পরিবর্তনের হার যদিও ধীর, পথের বাধাগুলোও বেশ জোরালো; তার পরও ব্লেক বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণের গতিশীলতা, সহনশীলতা এবং উদ্যোক্তার মানসিকতা এ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে।

গত বছর প্রবাসী বাংলাদেশিরা এক হাজার ১০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এ বছর এক হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি পাঠাবেন। পাঁচ বছরের মধ্যে এ বার্ষিক প্রবাহটি দুই হাজার কোটি ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মুদ্রামান প্রতিদিনই শক্তিশালী হচ্ছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মুদ্রামান ৫ শতাংশ বেড়েছে, যেখানে রুপি হারিয়েছে ১৫ শতাংশ। প্রতিবছরই প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ বাড়ছে। গত বছর বাংলাদেশ সরকার তিনটি প্রবাসী ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। এ তিন ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হিসেবে সাড়ে ১৮ কোটি ডলার বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।

২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ‘ইন অ্যান আনলাইকলি কর্নার অব এশিয়া, স্ট্রং প্রমিজ অব গ্রোথ’ শিরোনামের এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, কক্সবাজারে বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেল তৈরি হচ্ছে। গ্রিন ডেল্টা হাউজিং নামের একটি বাংলাদেশি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বেশ কিছুু প্রকল্পে কাজ করছে। কার্লসন রেজিডর হোটেল গ্রুপ, যারা ঢাকায় এরই মধ্যে র‌্যাডিসন হোটেল চালাচ্ছে, কক্সবাজারেও দুটো হোটেল চালুর পরিকল্পনা করছে ২০১৫ সালের মধ্যে। এ প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছিল, অন্যতম উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশের সামনে রয়েছে প্রচুর সুযোগ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগসহ বিভিন্ন বাধা সামলেও ১৬ কোটি মানুষের এ দেশটি উন্নয়নের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিই ব্যক্ত করছে।

বাংলাদেশের মানুষ একই সঙ্গে উদ্দীপনাময় এবং সহনশীল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা এ বিরল গুণটি দেখিয়েছিল। অলঙ্ঘনীয় বাধা ডিঙিয়ে অর্জন করেছিল স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পর আরও অনেক বাধা-প্রতিকূলতা পেরিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ একই রকম দৃঢ়তা দেখিয়েছে। এ অগ্রযাত্রায় প্রবাসী বাংলাদেশিরাও কাঁধ মেলালে বাংলাদেশ নিজেদের অর্থনীতি এবং জীবনমান অন্য একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে।

বিশ্ব অর্থনীতির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভবিষ্যদ্বাণী এবং দেশটিতে চলমান দৃশ্যমান উন্নয়ন এ সাক্ষ্যই দেয়, বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। আসুন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে মাতৃভূমির প্রতি আমরা আমাদের ঋণ শোধ করি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category