বায়ুদূষণ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি। প্রতি বছর বিশ্বে ৭০ লাখের বেশি প্রাণহানি ঘটে বায়ুদূষণের কারণে। মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন- ক্যানসার ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করে পিএম- ২.৫। আইকিউএয়ার বায়ুতে পিএম- ২.৫ এর যে উপস্থিতি পেয়েছে, তা বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের জন্য ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ বলে সতর্ক করে দিয়েছে।
গত বছর বাংলাদেশের বায়ুতে প্রাণঘাতী পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম- ২.৫ এর উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ছিল ৭৬ দশমিক ৯ শতাংশ; যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে বাংলাদেশে পিএম- ২.৫ এর উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ছিল যথাক্রমে ৯৭ দশমিক ১, ৮৩ দশমিক ৩ ও ৭৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম।
নেমে আসবে বড় বিপর্যয়
এভাবে বায়ুদূষণ চলতে থাকলে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে- এমন শঙ্কা পরিবেশবিদদের। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, বায়ুদূষণ যে একটা বড় সমস্যা, এটা সরকার বিশ্বাস করে না। সরকারকে এটা বিশ্বাস করতে হবে। তারা (সরকার) হয়তো মানবিক বিপর্যয় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করছে, যা ইতোমধ্যে আসা শুরু করেছে।
আবর্জনা পুড়ে সৃষ্ট ধোঁয়া বাতাস বিষাক্ত করে তুলছে
শরীফ জামিল বলেন, এটা বড় সমস্যা, সমাধান না করলে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে। যেসব কারণে বায়ুদূষণ হয়, তা চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। অতীত থেকে জানতে হবে, কীভাবে বায়ুদূষণ হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে বায়ুদূষণ না হয়, সেজন্য কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ইটভাটা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। তবে এটা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া যাবে না, নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। দূষণ রোধে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করলে তখন সমস্যাগুলো চিহ্নিত এবং নির্মূলও সহজ হবে। যদি জনগণকে সম্পৃক্ত করা না হয়, তাহলে অতীতে যেমন কিছুু প্রকল্পের মাধ্যমে রাষ্ট্রের টাকা লুটপাট করা হয়েছিল, সমস্যার সমাধান হয়নি; এক্ষেত্রেও তা-ই হবে।
তিনি বলেন, নির্মল বায়ু আইনের একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। সেটা কিন্তু সরকার বাস্তবায়ন বা কার্যকর না করে উল্টো এখন বিধিমালা তৈরির কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। সরকার বায়ুদূষণকে সমস্যা হিসেবে মনে করে না। বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। তা না হলে আইনের খসড়া হলো, অথচ আইন না করে বিধিমালা কেন? এর একটিই কারণ। বায়ুদূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে বাঁচানো যায়, সেই চেষ্টা চলছে।
বাপার সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, যদি শক্তিশালী আইন হয়, তাহলে বায়ুদূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আর এগোতে পারবে না। সরকারের ভেতরে যারা নিজেদের বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ চরিতার্থে সক্রিয় থাকে, এটা তাদেরই কাজ। এত বড় সমস্যাকে যদি সমস্যাই মনে করা না হয় এবং পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় তবে এটা দিনদিন গুরুতর হবে— এটাই স্বাভাবিক এবং তা-ই হচ্ছে।
ইটভাটায় যে কয়লা ব্যবহার হয়, তা অত্যন্ত নি¤œমানের। সেখানে সালফারের মাত্রা কম থাকার কথা বলা হলেও থাকে বেশি। আমাদের দেশে যে জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হয়, তাও অত্যন্ত নি¤œমানের। এগুলোর মান বাড়াতে হবে।
বায়ুদূষণের কারণ
বিভিন্ন কারণে দেশে বায়ুদূষণ হয়। এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, বায়ুদূষণের কারণগুলো আমরা কম-বেশি সবাই জানি। এর মধ্যে একটি কারণ হলো- যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া। ধূলার মাধ্যমেও বায়ুদূষণ হয়। বিভিন্ন কনস্ট্রাকশনের কাজ এবং ইটভাটাও বায়ুদূষণের জন্য দায়ী।
তিনি বলেন, ইটভাটায় যে কয়লা ব্যবহার হয়, তা অত্যন্ত নি¤œমানের। সেখানে সালফারের মাত্রা কম থাকার কথা বলা হলেও থাকে বেশি। আমাদের দেশে যে জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হয়, তাও অত্যন্ত নি¤œমানের। এগুলোর মান বাড়াতে হবে। বায়ুদূষণকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে চিন্তা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ইস্যুতে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো সংস্থা যুক্ত। কিন্তু যে নিয়ম আছে, তা যথাযথভাবে প্রয়োগ হয় না।
উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে হচ্ছে বায়ুদূষণ
চলমান উন্নয়ন কর্মকা- বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সোবহান। তিনি বলেন, শহরের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে বায়ুদূষণের এক নম্বর কারণ হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকা-। নিয়ম হচ্ছে, আপনি এমনভাবে কর্মকা- চালাবেন যাতে পরিবেশের ক্ষতি না হয়। কিন্তু বাস্তবে কেউই সেটা মানছে না।
প্রকৌশলী আবদুস সোবহান বলেন, সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করলে তা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সেভাবে রেখে দেওয়া হচ্ছে। ২০ কিলোমিটার রাস্তা সংস্কারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একসঙ্গে পুরো রাস্তা খুঁড়ে রাখা হয়। অথচ নিয়ম হলো, ২০ কিলোমিটারের রাস্তার দুই কিলোমিটার সংস্কার শেষে আবার নতুন করে দুই কিলোমিটারের সংস্কার হবে। কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়ম মানা হয় না। সিটি করপোরেশনও শহরের ময়লাগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করে না। সেজন্যও বায়ুদূষণ হয়।
বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে সরকারের অব্যবস্থাপনাই দায়ী বলছেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক। তার মতে, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তাদের ন্যূনতম কাজও করছে না। বায়ুদূষণ কমাতে হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা সংস্থাগুলোর তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, দেশে মেট্রোরেলসহ বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের কাজ করার সময় ধুলোবালি ওড়ে। সে কারণে বায়ুদূষণ হয়। বৃষ্টিপাত শুরু হলে আবার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
তিনি বলেন, আমরা সিটি করপোরেশনকে বলেছি। তারা জার্মানি থেকে পানি ছিটানোর জন্য একটা মেশিন আনছে। এছাড়া মেট্রোরেলসহ যারা উন্নœয়নমূলক কাজ করছে, আমরা তাদের নোটিস করেছি। তারা যেন দেখে-শুনে কাজ করে। আমরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। আমরা বলেছি, নিয়ম মেনে কাজ করতে হবে। অযথা খোঁড়াখুঁড়ি করা যাবে না, পানি ছিটাতে হবে।
ইটভাটা আগের তুলনায় অনেক কমেছে- এমন দাবি করে শাহাব উদ্দিন আরও বলেন, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণে অনেক ইটভাটা ছিল। অনেকগুলো আমরা বন্ধ করেছি। রাস্তায় পুরাতন গাড়ির চলাচল বন্ধের বিষয়ে আমরা সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে বলেছি।৩অর্থকণ্ঠ ডেস্ক