সামান্য মুদি দোকান থেকে যে ভাবে সিটি গ্রুপ গড়ে তুললেন এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন, ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সিটি গ্রুপের যাত্রা শুরু। ১৯৫৮ সাল থেকে আমি গ্রোসারির দোকানে বসি। আমরা সংসার চালাই দোকানের আয়-ব্যয় দিয়ে। বাড়ির পাশে আঙ্গিনায় আমাদের দোকান ছিল। ওই দোকানে বসে তখন চিন্তা করেছিলাম নতুন একটা কিছু করা যায় কিনা। কি করলে হবে? আমাদের পাশে ছিল ন্যাশনাল অয়েল মিল, আর সে মিল ছিল অবাঙালিদের। আমি তখন চিন্তা করলাম পাকিস্তান থেকে এসে যদি একটা মিল করে সুন্দর পরিবেশে চালাতে পারে, ব্যবসা করতে পারে আমরা পারবো না কেন। কিন্তু কোনো কিছু চিন্তার থেকে করতে পারাটা অনেক কঠিন কাজ। ওই সময় থেকে শুরু করে দুই বছর লেগেছে, নয় জোড়া ঘানি বসিয়ে মিল চালু করতে। ৫২ হাজার টাকার স্টিমেট ছিল। নয়জোড়া ঘানি দিয়ে মিল চালানো কাঁচামাল কেনা সবকিছু মিলিয়ে। একটি পর্যায়ে গিয়ে ওই টাকা শেষ হয়ে গেল। মিল চালু হয় নি। চালু করতে ধার কর্জ করে চালিয়ে নিতে হয়েছে। ওই পর্যায় থেকে আমরা টুক টুক করে এগিয়ে যেতে থাকি। এক পর্যায়ে আবার একটা লোকসানের হোঁচট খাওয়া হলো। যার ফলে বেশ কিছু টাকা লোকসান হয়ে গেল। তখন চিন্তা করতে লাগলাম- পারবো কি না। মনে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আবার চেষ্টা করতে লাগলাম। এইভাবে বহুবার চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে- আজকে আমরা যে অবস্থানে আছি এখানে প্রায় ৫০ বছরের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে এসেছি। বর্তমান সময়ে চিন্তাও কাজকর্ম করার মতো এনার্জি আছে। পরিকল্পনা করা যায়, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু করা যায়। তখন ওই সব জিনিস আমাদের মাথায় ছিল না। কারণ আমরা একটা ছোট্ট পরামর্শের জন্য একজন নন-বাঙালি সামসুল হক নামের ভদ্রলোককে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করতাম যে, কিভাবে কি করা যায় এবং তার পরামর্শ নিতাম। তখন ওকে কাছে ডেকে এক কাপ চা আপ্যায়ন ও গল্প করে দিনের পর দিন কথা শুনতাম। দিনের পর দিন ওর কথা শুনে বিশ্বাস আর সাহসের জায়গাটায় আমরা যেতে পেরেছিলাম। নয় জোড়া ঘানির মিল বসিয়ে কাঁচামাল কিনে ফ্যাক্টরি চালিয়ে বেচা-কেনা করে একটা জায়গায় আসতে হয়েছে। আগে যারা মিলের মালিক ছিল তাদের থেকে ভালো কিছু তৈরি এবং চাহিদা অনুসারে পণ্য উৎপাদন করে মানুষের কাছে নিয়ে বেচে দিতে হবে আমাদের পণ্যগুলো। সব চিন্তা করে আমরা কাজ করি। আমরা যখন তেল উৎপাদন করে বাজারে দিচ্ছিলাম তখন আমার খরচ ছিল ৯০ টাকা, আমাকে দাম দিয়েছে ৮০ টাকা। আমি বলেছি- ঠিক আছে। ১০ টাকা কমেই ২-৩ মাস দিচ্ছিলাম। এ অবস্থায় দুই মাস পর আমি বাজার মূল্য থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছি। মানুষ ক্রয় করছে। ক্রয়ের পিছনের কারণ ছিল আমার পণ্যটা ভালো। আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে কাজ করতাম। আমরা মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পেরেছি। আর এ সুবাদেই আমরা আমাদের ইন্ডাস্ট্রিটা বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। আমরা যখন আরম্ভ করি তখন আমার কাছে ৫২ থেকে ৫৪ হাজার টাকার বেশি ছিল না। আমি যখন প্রথম ব্যবসা শুরু করি তখন আমার কাছে ছিল মাত্র ৪২ টাকা। আমার বাবা দিয়েছিলেন। ওই টাকা নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় ব্যবসা শুরু করি। ঐখান থেকে আমি আমার ভাই মিলে ব্যবসা করেছি। ঐখান থেকে আমার বড় ভাই গিয়েছেন মৌলভী বাজার। আর আমি গিয়েছি গেন্ডারিয়াতে। ঐ তেলের ব্যবসা থেকে আমরা আজ এইসব জায়গায় বিচরণ করছি। আমি মনে করি আপনি চিন্তা যতটুকু করবেন- চেষ্টা যতটুকু করবেন- পরিশ্রম যতটুকু করবেন তার থেকে বেশি ফল পাবেন। কথায় আছে, পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি। আপনি পরিশ্রম না করলে যত কথাই শোনান আর আমি যত কথাই বলি কোনো কাজে আসবে না। আমি কোনো কোনো সময় মাসে ২৮ দিন ১৮ ঘন্টা করে কাজ করেছি। তখন আমাদের কোনো উপায় ছিল না, পিছনেও যেতে পারবো না। কারণ আমরা ৯ ভাই-বোনের মধ্যে আমি আর বড় ভাই মিলে আমাদের সংসার চালাতে হতো। আমার আব্বা ছিলেন প্যারালাইসিস রোগী। সংসারও টানতে হবে আবার নিজেদের চলতে হবে। এই চলা থেকে থেমে গেলে আমাদের আর যাওয়ার পথ ছিল না। আমাদের পথ ছিল যে এগিয়ে যেতে হবে। যতটুকু হয়, যে ভাবে হয়, এগিয়ে যাও। তবে আমরা সবার সহযোগিতা পেয়েছি। ১ নম্বর সহযোগিতা পেয়েছি ব্যাংকারদের কাছ থেকে; ওই সময় ব্যাংকাররা আমাদের মতো ছোটখাটো ব্যবসায়ীদের বিনা জামানতে পয়সা দেওয়া এটা নজিরবিহীন কাজ ছিল। আমার জীবনে আমি যে কোনো ব্যাপারে ব্যাংকের সাথে আলাপ করেছি- বলেছি যে আমার এই পয়সাটুকু লাগবে এটা দিতে কোনো রকমের দ্বিধাদন্দ্ব করেনি। সময় ক্ষেপণ করেনি। সাথে সাথে সেই পয়সাটা পেয়েছি এবং সেই কাজটা সময়মতো করতে পেরেছি। বাবা-মায়ের দোয়া ছিল। ব্যাংকারদের সহযোগিতা ছিল, নিজের পরিশ্রম ছিল। ভোক্তার চয়েজ ছিল আমার পণ্যগুলো নেওয়ার জন্য ব্যবহার করার জন্য কিনার জন্য। এই জিনিসগুলো আমাকে বেশি উদ্যম এবং বেশি সাহসী করেছে।
আমরা যখন আমাদের মিল ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শুরু করি এটা শুরু করার জন্য ৬ মাসের বেশি লাগার কথা না কিন্তু আমাদের প্রায় ৪ বছর সময় লেগে গিয়েছিল সবকিছু গুছিয়ে তৈরি করার জন্য। ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে আমরা আমাদের পণ্য বাজারজাত করলাম। ২৫ টিন তেল মৌলভীবাজারে ঠেলাগাড়ি করে নিয়ে গিয়ে ৪টা বা ৫টা দোকানে ডিস্ট্রিবিউশন করলাম। ঐখান থেকে আমাদের পথ চলা শুরু হলো। তবে ইন্ডাস্ট্রিগুলো যাই করছি আমার বাবাকে আগে জিজ্ঞাসা করেছি। আমার বাবাকে গাড়ি করে এনে নতুন কারখানার ফিতা কাটিয়েছি। খুব সিম্পল ভাবে যাতে করে আমরা ওটা কন্টিনিউ করে এগিয়ে যেতে পারি। ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কাজ শুরু করলাম। ’৮৫ সালে মাতুয়াইল কোনাপাড়ায় আমাদের একটি স্টিল মিল দিয়েছিলাম। ১৯৮৯ সালে রূপসিতে রিফাইনারি বসিয়েছি। ২০০০ সালে চট্টগ্রামে টারমিনাল দিয়েছিলাম। ২০১৫ সালে হোসেনদিতে ইকোনোমিক জোন করেছি। ২০১৫ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুটি ইকোনোমি জোনের পারমিশন দিয়েছেন। একটি হোসেনদি অন্যটি হলো রূপসি নারায়ণগঞ্জে- এই অবস্থায় আমরা এগিয়েছি। গত জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ আমরা কর্ণফুলি চা বাগান ব্র্যাকের কাছ থেকে নিয়েছি, আশা করি সেখানেও ভালো করবো। আমি হাসপাতাল করেছি, একটা নার্স ইনস্টিটিউট করছি, একটা মেডিকেল কলেজের অনুমোদন পেয়েছি- অতি শীঘ্রই চালু করবো। আমরা যদি এই টুক টুক করে এগিয়ে আসতে না পারতাম ১০টা ছেলে-মেয়েকে কাজ করার সুযোগ করে না দিতে পারতাম আমরা ব্যর্থ হয়ে যেতাম। আমরা যে সময় ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকেছি সে সময় ঐটা পাকা ছিল। দেশটা স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু দেশটি স্বাধীন না করলে আমরা ইন্ডাস্ট্রির মালিক হতে পারতাম না। ব্যাংক আমাদের ফাইন্যান্স করতে পারতো না। ইন্ডাস্ট্রির মানে হলো আপনি যত চিন্তা করতে পারবেন যত আপনি গভীরে যেতে পারবেন তত আপনি বাড়াতে পারবেন। ইন্ডাস্ট্রির শেষ নেই। আমি বিভিন্ন সময় নানা দেশে গিয়েছি- প্রচুর ইন্ডাস্ট্রি দেখার সুযোগ হয়েছে। আর আমি যে কয়েকটা ইন্ডাস্ট্রি করছি এখন যে ইন্ডাস্ট্রিতেই আপনি যাবেন সুন্দর মেশিনারি, সুন্দর প্রোডাক্ট, এরিয়া ভালো, ঘুরতেও আপনি আনন্দ পাবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। একটি ইন্ডাস্ট্রি যদি ২ বছর লাগে আপনারা পরিকল্পনা করে সাজিয়ে আনতে আমি সেটা দেড় বছরে করে দিবো যদি আমাকে সুযোগ করে দেওয়া হয়। ইন্ডাস্ট্রি করার ক্ষেত্রে আপনি যদি দুই মাস এগিয়ে আনতে পারেন তাহলে ১০% টাকা সাশ্রয় করতে পারবেন। আর দুই মাস পিছিয়ে গেলে আপনার ২০% টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিতে যত বেশি পরিশ্রম করে যত বেশি গভিরে যাবে তত বেশি এগিয়ে যাবে। ইন্ডাস্ট্রিতে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
আজকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আরো বেশি এগিয়ে যাবে। পদ্মা সেতু নিজেরা করতে পারছি। কিছুদন পর এক পদ্মাতে ১০টি সেতু হবে। একটার ইনভেস্টমেন্ট কারিগরি সকল কিছু আপনার হাতের নাগালে। আপনার পিছিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। আর আগে একটি পদ্মা সেতু করতে গিয়ে ১০ বার চিন্তা করতে হতো। পয়সা পাবো কোথায়- কি করবো কাকে দায়িত্ব কি ভাবে দিবো? হাজারো বার চিন্তা করতে হয়েছে। আর যিনি চিন্তা করেছেন তিনি এটার পিছনে লেগে ছিলেন। পদ্মা সেতু যদি এই রকম ভাবে হতে পারে তাহলে আমাদের কাছে এই ইন্ডাস্ট্রিগুলো কেন হবে না! না হওয়ার কি আছে। আজকে বাংলাদেশের এই ইন্ডাস্ট্রিগুলো বিশ্বের অন্য দেশে নেই। আপনি যেভাবে যাবেন সেই ইন্ডাস্ট্রিই গেইন করতে পারবেন। ইন্ডাস্ট্রি করতে গেলে একটার পর আরেকটা করতে পারবেন। কেউ আপনাকে আটকে রাখতে পারবে না। অটোমেটিক্যালি করতে পারবেন।
ফজলুর রহমান বলেন, দেশ স্বাধীনের আগে সিটি হয় নাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্পেশাল কর্পোরেশন ছিল। আমরা চিন্তা করলাম- এটা সিটি হবে। আর স্বাধীনের পর ঢাকাটাই সিটি হবে। বলতে গেলে সিটি শব্দটি হচ্ছে ছোট। মানুষ বলতে গেলে সহজভাবে নামটা তাড়াতাড়ি বলবে। তীর আমাদের ব্র্যান্ড। মানুষ সহজভাবে তীরের পণ্যগুলো বিষয়ে জানতে পারবে বলতে পারবে। যে দোকানে যাবে তাকে আর চিন্তা করতে হবে না- আমি দোকানে গিয়ে কি বলবো! সহজভাবে নামটা বলতে পারবে- এই জন্য তীর রাখা হয়েছে।