হাসান মীর
জাপানের প্রাচীনতম সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান NHK ( Nippon Hoso Kyokai বা Japan Broadcasting Corporation ) ‘ এর অঙ্গ সংগঠন রেডিও জাপানের বাংলা সম্প্রচারের ৬১বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ তেসরা এপ্রিল। আপনারা জানেন জাপানের মানুষ তাদের নিজেদের দেশটাকে বলে নিপ্পন (Nippon ) বা নিহন ( Nihon) যার অর্থ সূর্য থেকে সৃষ্ট আর এশিয়ার পূর্বপ্রান্তের দেশ বলে আমরা জাপানকে বলি সূর্যোদয়ের দেশ, অর্থাৎ যে দেশে প্রথম সূর্য ওঠে।
জাপানে সরকারি উদ্যোগে সম্প্রচার ব্যবস্থার সূচনা ১৯২৬ সালের ৬ ই অগাস্ট তখন নাম ছিল রেডিও টোকিও। এরপর বিধিবদ্ধ আইনের আওতায় NHK নামে যাত্রা শুরু হয় ১৯৩৫ সালের পয়লা জুন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় এবং দেশটি আমেরিকার দখলে চলে যাওয়ায় ছয় বছরের বেশি NHK ‘ এর সম্প্রচার বন্ধ ছিল ১৯৫২ সালে পুনরায় এর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে NHK’ এর রয়েছে একাধিক টিভি চ্যানেল ( NHK World স্যাটেলাইট চ্যানেলে বাংলাদেশেও দেখা যায় ) আর রেডিও জাপান নামে রেডিওর হোম সার্ভিস, FM আর SW রেডিও। শর্টওয়েভে রেডিও জাপান বাংলা, হিন্দি উর্দুসহ প্রায় ১৮ টি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। বাংলা অনুষ্ঠান শর্টওয়েভে বাংলাদেশে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ৭-৪৫ মি. এবং এফ এম ব্যান্ডে ৭ টি বিভাগীয় শহরে রাত ৯.০০ টা থেকে ৯.৪৫ পর্যন্ত শোনা যায় ( এখন অবশ্য ৯.৩০ পর্যন্ত ]। জাপানে পরীক্ষামূলক TV সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালে।
এবার বাংলা অনুষ্ঠানের খবর। রেডিও জাপানে বাংলা সম্প্রচারের শুরু ১৯৬১ সালের তেসরা এপ্রিল। এখানে একটা মজার ঘটনা আছে। তখন পাকিস্তানি ভাষা হিসেবে উর্দু ভাষার অনুষ্ঠান প্রচার হতো। টোকিওতে অধ্যয়নরত শেখ আহমেদ জালাল নামে একজন ‘ পূর্ব পাকিস্তানি ‘ বাঙালি ছাত্র এ নিয়ে প্রথমে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন, বাংলা আর উর্দু দুটোই যখন পাকিস্তানের সরকারি ভাষা তখন উর্দুর পাশাপাশি বাংলায় অনুষ্ঠান নয় কেন। তিনি এ নিয়ে NHK কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললেন। তারা জানালেন – বিষয়টি সরকারি পর্যায়ে উত্থাপন করতে হবে এবং সরকারি সিদ্ধান্ত হলেই কেবল তারা বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান চালু করতে পারেন। তখন টোকিওতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ( Mohammed Ali of Bogra, তিনি এক সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন) । শেখ জালাল কয়েকজন সঙ্গী- সাথী নিয়ে দূতাবাসে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের আরজি জানালেন। রাষ্ট্রদূত বললেন – লিখিত দরখাস্ত দাও, আমি পররাষ্ট্র দপ্তরের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেবো। তাই হলো। শেখ জালালের দরখাস্ত এক পর্যায়ে NHK কর্তৃপক্ষের হাতে পৌছালো। তারা শেখ জালালকে ডাকলেন। উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও ১৫ ( কিংবা ২০) মিনিটের অনুষ্ঠান প্রচারের সিদ্ধান্ত হলো। প্রথম ঘোষক বা পাঠক নির্বাচিত হলেন শেখ জালাল নিজেই। তারিখটি ছিল ১৯৬১ সালের তেসরা এপ্রিল। ( এরপর দৈনিক আধ ঘন্টা এবং ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে কিছুদিনের জন্য অতিরিক্ত আধঘণ্টার প্রভাতী অধিবেশন চালু হয়েছিল। করোনা মহামারির পর এখন প্রচারিত হচ্ছে ৩০ মিনিটের অনুষ্ঠান )।
শেখ জালাল পরবর্তীকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপালন করেছেন। ২০০১ সালে রেডিও জাপানের বাংলা বিভাগের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার আগারগাঁয়ে বাংলাদেশ বেতার ভবনের সম্মেলন হলে যে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল, সেখানে তাঁর সাথে আমার দেখা ও কথা হয়। সেদিন তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পুরনো দিনের গল্প শুনিয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে আমার আগে রেডিও জাপানে কর্মরত ফারুক হোসেনও অংশ নেন। ( আমি বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রেষণে রেডিও জাপানের বাংলা বিভাগে কাজ করেছি ফেব্রু. ১৯৮৮ থেকে অগাস্ট ১৯৯১ পর্যন্ত) । আমি তখন যেসব অনিয়মিত শিল্পী/ উপস্থাপকদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদের মধ্যে অনোয়ারুল করিম আর অজন্তা গুপ্ত এখনো রয়েছেন বলে জানি। ইসকান্দার আহমদ চৌধুরী ও কল্যাণ দাসগুপ্ত ( পরে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ) প্রয়াত আর জয়শ্রী চট্টোপাধ্যায় কলকাতায় অবসর জীবন কাটাচ্ছেন বলে জানি । আমি যখন ছিলাম, রেডিও জাপানের দক্ষিন- এশিয়া বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন হিরোফুমি সাতো। বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন কাজুমা হানাওয়া ( অবসরপ্রাপ্ত) আর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন কাজুহিরো ওয়াতানাবে। বর্তমানে বাংলা বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন চিকা মুরাকামি নামের এক মহিলা। মিঃ ওয়াতানাবে অবসরগ্রহণের পরেও কিছুদিন বাংলা বিভাগের সঙ্গে পরামর্শক হিসাবে যুক্ত ছিলেন তবে শুনেছি। এ ছাড়া তিনি একসময় টোকিও বিদেশী ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষকের যে দায়িত্বপালন করেছেন, তারও মেয়াদ শেষ হয়েছে। যতদূর জেনেছি, ওয়াতানাবে- সান টোকিও থেকে দূরে উত্তরের কোনো শহরে স্থায়ী হয়েছেন তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। পরিশেষে, বাংলা বিভাগের সঙ্গে জড়িত সকলকে প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা বার্ষিক উপলক্ষে আমার আগাম শুভেচ্ছা ও
অভিনন্দন।
রেডিও জাপানের পরমায়ু শতগুণ বৃদ্ধি পাক।
NHK ভবনের ছবিটি আমার তোলা , আমার ছবিটি কে তুলেছিলেন মনে নেই ) । পুরনো লেখা, পুনঃসম্পাদিত।
পাদটীকা : রেডিও জাপান NHK’র বাংলা সম্প্রচার বিভাগ চালু হওয়ার পর থেকে যে ক’ জন জাপানি প্রযোজক / সম্পাদক বাংলা বিভাগের প্রধানের দায়িত্বপালন করেছেন, আমার মতে মি. কাযুহিরো ওয়াতানাবে ( জন্ম ১৯৫২) তাঁদের মধ্যে সেরা। তিনি ভারতের শান্তিনিকেতনে বাংলা শেখেন ফলে বাংলা পড়া ও লেখায় যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছেন। রেডিও জাপানে কাজের ফাঁকে তিনি অন্তত চারটি জাপানি ভাষার বই ( বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা, আমার বাংলাদেশ, রক্ত ও কাদা ১৯৭১ এবং ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাই ১৯৭৭ ) বাংলায় অনুবাদ এবং কয়েকটি বাংলা গল্প জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটির জাপানি ভাষায় অনুবাদ। আমি তাঁর সুস্থ দীর্ঘজীবন কামনা করছি।