সেই কবেকার কথা! ১৯৯১ সাল; সবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পা দিয়েছি। আমাদের গ্রামের হাটে একটি গাড়ী এসে উপস্থিত হল। বায়োস্কোপ দেখানোর গাড়ীর মতো। কৌতূহলী হয়ে পৌঁছালাম গাড়ীর কাছে। দেখলাম- মোবাইল বাইবেল প্রচার কেন্দ্র। বাইবেল ও যীশুর কাহিনী নিয়ে ছোট ছোট পুস্তিকা নামমাত্র মূল্যে অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করছে। আমি সেখান থেকে তার কিছু সংগ্রহ করেছিলাম।
ঐ সকল পুস্তিকার পেছনে বিনামূল্যে বাইবেল পাঠ শিক্ষামালার ঘোষণা দেওয়া ছিল। উৎসাহী হয়ে একটি পোস্টকার্ড লিখে ফেললাম, আমার আগ্রহের কথা জানিয়ে। যথারীতি একসময় উত্তর এসে গেল। আনন্দে আপ্লুত হলাম এ অভাবনীয় সাড়াতে। শুরু হল চিঠি লেখা ও উত্তর পাবার এক অনাবিল আনন্দধারা। কৈশোরের এ খেলায় চিঠি লেখা ও তার উত্তর পাবার অনুভূতিটি ছিল বেশ একটু ‘বিশেষ’ হবার পরশ পাওয়া।
বাড়িতে তখন বিবিসি’র খবর শুনতাম সবার সাথে। সেইসাথে শুনতাম ভয়েস অব আমেরিকা ও রেডিও তেহরান। কিন্তু কখনো চিঠি লেখা হয়ে ওঠেনি অথবা সেরকম নিয়মকানুন জানাও ছিল না। তাছাড়া, পকেটের উষ্ণতাও তেমন ছিল না যে, চিঠি লেখার উপাত্ত সংগ্রহ করব। একদিন জনৈক বন্ধুর উৎসাহে লিখেই ফেললাম বেতারের সমীপে। যথারীতি বেতারে ও ডাকে তার সাড়া পেয়ে ভীষণ উৎসাহিত হলাম। সেই শুরু হল আমার DXing (দূরশ্রবণ) জগতে পদচারণার।
DXing-এর যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দ দূরশ্রবণ নয়। এখানে D অর্থে বোঝানো হয় Distance অর্থাৎ দূরতম, আর X অর্থে Unknown Station. সব মিলিয়ে ইথার তরঙ্গে ভেসে আসা অজানা বেতার সংকেত বা রেডিও স্টেশনকে রেডিও সেটে ধরার দুর্নিবার আকর্ষণকেই বোঝানো হয় DXing। আর যারা এ শখের সাথে যুক্ত তাঁদের বলা হয় DXer। শখ হিসেবে দূর-শ্রবণ বেশ পুরোনো। এটি এমন একটি শখ যেখানে দূরশ্রবণকারী আর সংশ্লিষ্ট বেতার কেন্দ্র নিজেদের মধ্যে ভাবনা-চিন্তা আদান-প্রদান করতে পারেন। যার মাধ্যমে দু পক্ষই উপকৃত হন। দূরশ্রবণকারী বেতারে প্রচারিত অনুষ্ঠান শোনার মধ্য দিয়ে তাঁর জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। এর পাশাপাশি বেতার কেন্দ্রটি তার শ্রবণ মান, দূরশ্রবণকারীদের অনুরোধ, প্রস্তাব ও চাহিদা অনুযায়ী অনুষ্ঠান পরিবর্তন পরিমার্জনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেন।
DXing কথাটি বিশ্বব্যাপী অতি পরিচিতি একটি শব্দ। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন কম্পাংকে (SW, MW, SW, FM), বিভিন্ন ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে। আর এসব অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হল সেই সকল রাষ্ট্রের আইন-কানুন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, বিনোদন, সংবাদ ইত্যাদি বিষয়ে সবচেয়ে কম খরচে শ্রোতাদের মাঝে পৌঁছে দেওয়া। এক কথায় বেতার শোনা ও বেতার কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করাই DXing। অনেকে এটা করেন শখের বশে। সহজ ও সবচেয়ে শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে বেতারের সমকক্ষ আর কোনো বিকল্প নেই। এর সুবিধা হল সম্প্রচার খরচ কম, আর শ্রোতারা শুনতে পারেন খুব কম খরচে অথবা নামমাত্র খরচে। এরজন্যে শ্রোতাদের আলাদা সময় ব্যয় না করলেও চলে; অন্যান্য কাজের মাঝেই এটা শোনা যায়। বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে এটা শোনা সম্ভব; শুধু দরকার পড়ে একটি ভালো মানের বেতারযন্ত্রের বা রিসিভারের। ঐ একটি ছোট্ট যন্ত্রই দূর শ্রবণকারীর একমাত্র মাধ্যম যা দুনিয়াকে এনে দিতে পারে একদম ‘মুঠি মে’।
এক অর্থে দূরশ্রবণকারীর আঙুলের ডগায় গোটা পৃথিবী। সে ইচ্ছে মতো জার্মানী-আমেরিকা-জাপান-নাইজেরিয়া-বসেনিয়া ঘুরে বেড়াতে পারে তার ছোট্ট রেডিওর নব ঘুরিয়ে। কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের মতো একে একে আমারও শুরু হল বিভিন্ন দেশের বেতার আবিষ্কারের পালা।
নতুন নতুন বেতারের স্বর শুনি আর টিউনিং-এর নব স্থির রেখে সাবধানে চেষ্টা করি—এটা কোন বেতার, কোন ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করছে, কত ফ্রিকোয়েন্সিতে অনুষ্ঠান প্রচার করছে, চিঠি পাঠাবার ঠিকানা ইত্যাদি সংগ্রহ করতে থাকি। অবশেষে এসব প্রশ্নের উত্তর পেলে এক ঐশ্বরিক আনন্দে মন নেচে উঠতো।
এই অভাবনীয় শখটির অগ্রগতিতে দেশ বিদেশের নানা বন্ধুরা বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে আমাকে বিভিন্ন সময় সাহায্য করেছেন। কৈশোর ও যৌবনের সেই পড়াশোনা করার দিনগুলোতে নানান সমস্যা (রেডিও শোনা) ও আর্থিক সংকট ছিল; কিন্তু উদ্যমের কোনো অভাব ছিল না। চিঠি লেখার খরচ অথবা নিজস্ব রেডিও সেট না থাকা—এসব অসুবিধা সত্ত্বেও একটা আকর্ষণ অনুভব করতাম ও অনাবিল আনন্দ পেতাম। সেসময় একটা ভাঙা রেডিও দিয়ে “রেডিও ভেরিতাস এশিয়া” (উর্দু বিভাগ) ও “রেডিও থাইল্যান্ডের” (রিসিপসন রিপোর্ট পাঠানোর জন্য) ঠিকানা জোগাড় করা আজও আমার স্মরণে আছে। মনে আছে, পড়া ফাঁকি দিয়ে লেপের তলায় (শীতের সময়) রেডিও শোনার অভিজ্ঞতা।
এভাবেই পৃথিবীর অধিকাংশ বেতারকেন্দ্র যারা QSL কার্ড পাঠায়—তা সংগ্রহ করতে পেরেছি। সঙ্গে স্টিকার, ভিউকার্ড, ক্যালেন্ডার, অনুষ্ঠানসূচি, ব্যাজ, পেন, চাবির রিং, ডাকটিকিট, বেলুন, রাইটিং প্যাড, তথ্যবহুল বই-পত্র, ম্যাগাজিন, পেনেন্ট … আরো কতো কি? এক বা একাধিক এইসব রং-বেরঙের বৈচিত্রে ভরা ও তথ্যে সমৃদ্ধ QSL ও পেনেন্ট জমানো, ডাকটিকিট জমানোর মতোই আনন্দদায়ক ও আকর্ষণীয়। ধীরে ধীরে বিদ্যালয়-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পার করলাম কিন্তু বেতার-জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হইনি কখনো। এখনো বয়ে চলেছে; তবে কলকল ধারার শব্দ না হলেও বহমান আমার দূরশ্রবণ।
এ যাবৎ বহু বেতারে চিঠিপত্র লেখা, টেলিফোনে সাক্ষাৎকার দেওয়া ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুবাদে অনেক পুরস্কার ও সম্মান প্রাপ্তি ঘটেছে। শ্রেষ্ঠ শ্রোতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণির পুরস্কার। ডিজিট্যাল রেডিও থেকে শুরু করে আইপড, টি-শার্ট, ক্যালকুলেটর, ছাতা, টেবিল-কভার, কুশন কভার, টুপি, টেবিল-ঘড়ি, হাত-ঘড়ি, ক্যাসেট, সিডি-ডিভিডি, ভাষা শিক্ষার বই (জার্মান, জাপানি, চীনা, ফ্রেঞ্চ, রুশ), পবিত্র কোরআন, টাই, ব্যাগ, রুকস্যাক, অ্যালবাম, ডায়েরি-কভার…ইত্যাদি। যার মধ্যে দুটি পুরস্কার আমার সারাজীবনের স্মরণীয় করে রাখার মতো। একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সফর ও অপরটি ডয়চে ভেলে কর্তৃক ২০০৬ সালের শ্রেষ্ঠ শ্রোতা ক্লাবের সম্মান।
রেডিও DXing বলতে মূলত শর্টওয়েভ (SW) DXing কেই বোঝান হয়ে থাকে। তবে মিডিয়াম ওয়েভ (MW) ও FM DXing-এর চলও আছে। তবে সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চ রয়েছে শর্টওয়েভ DXing-এ। বর্তমানে ভালো শ্রবণমান (Reception) পেতে উচ্চতরঙ্গ সমৃদ্ধ ডিজিটাল রেডিও পাওয়া যায়; আরও পাওয়া যায় নানা ধরণের রেডিও অ্যান্টেনা। এসব দিয়ে আপাত টার্গেট এরিয়ার বাইরের শব্দ তরঙ্গকেও ধরা সম্ভব হয়।
বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি ও আধুনিকতার যুগে রেডিওর গুরুত্ব কমতে শুরু করেছে। এর স্থলে তথ্য গ্রহণের জন্য হাতের নাগালে এসে গেছে নানা মাধ্যম। বহুল প্রচলিত সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি নানা চ্যানেল (Web SDR), ওয়েব পেজ, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন প্রভৃতির মাধ্যমে রেডিওর অনুষ্ঠান শোনা সম্ভব। এ যেন হাতের মুঠোয় গোটা পৃথিবী। এরফলে বিশ্বের নানা বেতারকেন্দ্র তাদের শর্টওয়েভ বেতার সম্প্রচার ধীরে ধীরে গোটাতে শুরু করেছে। ২০০৬ সালের পর থেকে ডয়েচেভেলে- জার্মানি, রেডিও অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, বুদাপেস্ট, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, শ্লোভাকিয়া-র মতো অর্ধশতকেরও বেশি আন্তজার্তিক বেতারকেন্দ্র তাদের শর্টওয়েভে অনুষ্ঠন সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। শর্টওয়েভে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের বদলে বর্তমানে তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে। কেউ কেউ আবার মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন-এর মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে যেমন– রেডিও ভেরিতাস এশিয়া, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও তেহরান (ওয়েব সংস্করণ “পার্স টুডে”), রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি। বেশ কিছু বেতারকেন্দ্র আবার একেবারেই পাততাড়ি গুটিয়েছে যেমন—রেডিও সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল, রেডিও বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল, রেডিও বুদাপেস্ট, রেডিও তাসখন্দ (উজবেকিস্তান), রেডিও মস্কো প্রভৃতি।
এতসব সত্ত্বেও যে বেতারের গুরুত্ব কমে গেছে এমন নয়। এখনও বেতার-পাগল DXer-রা সারা পৃথিবীময় বেতারকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে। সারা বছর ধরে এসকল DXer-রা নানা কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। নানা ভাষায় এখনও বিশ্বব্যাপী প্রিন্ট ও ডিজিট্যালে নানা পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে চলেছে। বহুমূল্য ‘World Radio & TV Hand Book’ আজও শ্রোতাদের কাছে বাইবেলরূপে বিবেচিত হয়। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী নানা গ্রুপ, ফেসবুক পেইজ, ওয়েবসাইট রয়েছে শ্রোতাদের জন্য। সেখানে তাঁরা তাঁদের অনুভূতি, খবরাখবর ও তথ্য আদান-প্রদান করে থাকেন। এছাড়াও শ্রোতাদের নিয়ে বিভিন্ন বেতারকেন্দ্র শ্রোতা সম্মেলনেরও আয়োজন করে থাকেন। শ্রোতারা নিজেরাও কখনো কখনো শ্রোতাদের নিয়ে আলোচনা সভা ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১৩ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় বিশ্ব বেতার দিবস। প্রতি বছর গ্লোবাল আউট রিচ-এর ব্যবস্থাপনায় ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস উপলক্ষ্যে ভূবনেশ্বরে পালিত হয় বিশ্ব বেতার দিবস। সেখানে পৃথিবীর নানা প্রান্তের বেতারপ্রেমী মানুষজন ছাড়াও বেতারের সাথে সংশ্লিষ্ট, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেতারের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। সারা বছর ধরে বেতারের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে এ অনুষ্ঠানে সম্মানিত করা হয়।
বিশ্বব্যাপী এই DXing শখ ও রেডিও শোনার আগ্রহ বর্তমানে একবিন্দুও কমেনি। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে খবরের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে বেতার। বিনোদন, খবরাখবর ও দুর্যোগ মোকাবিলায় এখনও সমান মূল্যবান বেতার। বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট যখন বিকল হয়ে পড়ে তখনও কিন্তু রেডিওই একমাত্র ত্রাতা হিসেবে মানুষের প্রয়োজনে সমস্ত যোগাযোগ ও খবরের মাধ্যম হয়ে ওঠে। সেই দুঃসময়ে রেডিওকেই একমাত্র বন্ধু হিসেবে কাছে পাওয়া যায়।
আমার দূরশ্রবণের সূচনা হয়েছিল একটি ভাঙা রেডিও দিয়ে; আজ বিভিন্ন বেতারের পুরস্কার হিসেবে বেশ কয়েকটি ডিজিট্যাল রেডিও প্রাপ্তি আমার এ শখকে পূর্ণতা দিয়েছে। সেইসাথে পেয়েছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের (উগান্ডা-ইথিওপিয়া থেকে পোলান্ড-কানাডা ও পাশের দেশ নেপাল ও বাংলাদেশ) পত্র ও ডিএক্সার বন্ধুদের। বাংলা ভাষা ছাড়াও অনন্য ভাষার অনুষ্ঠানও শুনতে পারেন। তাই বেতার শুনুন; নিজেকে আবিষ্কার করুন এক নতুন জগতে। দূরশ্রবণের এ অদ্ভুত শখ সবার জন্য সুখশ্রাব্য হোক।
এস এম নাজিম উদ্দিন, পরিচালক, ইন্টারন্যাশনাল ডিক্স রেডিও লিসেনার্স ক্লাব
বারুইপাড়া, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত