• শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:১৮ অপরাহ্ন

বৈষম্য কমানোর প্রত্যয়ে দীপ্ত হোক পহেলা বৈশাখ

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ / ৯৮ Time View
Update : রবিবার, ৮ মে, ২০২২

আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ধারক ও বাহক, বাঙালির প্রাণের নববর্ষের উৎসব, বাংলা বর্ষের প্রথম দিবস পহেলা বৈশাখ; শুধু বারো মাসের তেরো পার্বণের অন্যতমটি নয়- এটির সাথে সমসাময়িক আর্থসামাজিক জীবনযাত্রার চালচিত্রের পরিচয় বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনটির উদযাপনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। পহেলা বৈশাখের আগের দিন ‘চৈত্র সংক্রান্তি’তে যুগে যুগে স্থানে ও কালে আয়োজিত হয় অনেক অনুষ্ঠান ও সংস্কারবান্ধব রীতিনীতি পালনের পর্ব। পরের দিন পহেলা বৈশাখ যেন নির্ভেজাল নির্ভার নিরাপদ আনন্দে শুরু হতে পারে সেকারণে সংবছরের যাবতীয় লেনদেন বোঝাপড়ার সালতামামি চলে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে। আগের বছরের শেষের হিসাব-কিতাব মেলানোর মধ্যে নতুন বছরের যাত্রার বেগ ও মাত্রা নির্ভর করে। শুচি শুভ্র অবয়বে, মনের সকল ক্ষোভ, খেদ, বেদনা ও বিমর্ষভাব কাটিয়ে আনন্দ উৎসবে নতুন বছরকে নতুন দিনে বরণ করাই উদ্দেশ্য।

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
এই নিবন্ধের লেখক

নতুন বছরের নতুন খাতা খোলা হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেনাবেচার দায়-দেনার লেনদেনের। হালখাতা তাই আর্থসামাজিক জীবনায়নে নতুন প্রেরণা প্রাপ্তি অনুষ্ঠানের একটি অন্যতম উপলক্ষ। হালখাতা শব্দের মধ্যে অর্থনৈতিক জীবন যাপনের একটা প্রাকরণিক পদ্ধতির নির্দেশনা আছে। নতুন দিনে নতুনভাবে সবকিছু শুরুর মধ্যে একটা পূত-পবিত্র ও প্রসারিত মন প্রসারণের, হৃদয় উজাড়করণের, মনোযোগের বিবেচনার ব্যাপার জড়িত। সম্রাট আকবর ‘ফসলি সন’ হিসেবে বাংলা বর্ষ প্রবর্তন করেছিলেন। পহেলা বৈশাখ সেই সনের প্রথম দিন হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল। সে সময় থেকে চৈত্র সংক্রান্তি অধুনা ‘জুন মাসের তিরিশ তারিখে’র মতো। চৈত্র মাসে অনেক কাজ শেষ হওয়ার, শুরুর নয়। চৈত্র মাস স্বভাবে শুষ্ক, রুক্ষ; রক্তচক্ষুর ন্যায় তার চাহনি। সারা বছরের সব ভালোমন্দের মেজাজ চৈত্র মাসের মগজে ঠাঁই নেয়। বিয়ের কাজের মতো শুভকাজ কেউ চৈত্র মাসে ফেলতে চায় না। কিন্তু বৈশাখ? সে যেন নতুন কিছু গড়ার নতুন কিছু শুরুর জন্য মাহেন্দ্রক্ষণ হাজির করে। রাস্তায় আলপনা এঁকে এই নতুন সময়কে স্বাগত জানানো হয়। নতুন পোশাক পরে সবাই নতুন খুশির মেজাজে দিন বা বছর শুরু করতে চায়। রুক্ষ চৈত্র থেকে বিমল আনন্দের বৈশাখে বিবর্তন ঘটে মানুষের, প্রকারান্তরে তার মনের বনে লাগে শুভ্র সূচির ছোঁয়া, জাগে প্রসারিত হৃদয়ের দোলা। মাত্র একদিন আগে সে ছিল উদ্বিগ্ন, উত্তপ্ত, নিতান্ত ব্যতিব্যস্ত ও মনমরা।

প্রতীয়মান হয়, হালখাতা উৎসব ক্রমশ তার কার্যকারিতার তাৎপর্য হারাচ্ছে। বাড়ছে না হালখাতা (হিসাব রাখার নতুন খাতা) ক্রয়-বিক্রয়ের পরিমাণ। নববর্ষ উদযাপনে অন্য অনেক ক্ষেত্রে (অধিকাংশই অনুৎপাদনশীল খাত) কর্মকা- বেড়েছে। যা দেখে সংবাদ মাধ্যমের কাছে মনে হয়েছে অর্থনীতিতে গতিশীলতা এসেছে। মনে হয়েছে কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে মানুষের মধ্যে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আবহমান উৎসবে মানুষের অংশগ্রহণের মাত্রা বাজারে বৈকি, সুুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সে চাঞ্চল্যে নিতান্ত নানাবিধ ব্যয়ের উৎসবে মাতামাতি বেড়েছে। কিন্তু পণ্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি চাহিদা অনুযায়ী না বাড়ায় সরবরাহে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় বৈসাদৃশ্য ও বেমানান বাড়াবাড়িতে সমাজ ও অর্থনীতির দৈন্য ও দুর্দশা ফুটে উঠেছে। ইলিশের সংগ্রহে ভাটা সত্ত্বেও একদিকে ইলিশ রপ্তানির প্রয়াস যেমন চলেছে অন্যদিকে বর্ধিত চাহিদা মেটানোর মতো উৎপাদন বা ধরার উদ্যোগে ভাটা পড়ায় ইলিশের দাম পহেলা বৈশাখের ২/৪ দিন আগে থেকে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে মুখরোচক সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়েছে। যত দাম হাঁকা হোক না কেন- প্রতিযোগিতা করেই যেন কেউ কেউ ইলিশ কিনেছেন- ভাবখানা এই ইলিশ না হলেই যেন চলে না। চড়া দামে ইলিশ কেনার মানুষ আছে বলেই ইলিশের চড়া দাম হাঁকার অবকাশ তৈরি হয়েছে। সরবরাহ ও চাহিদার এই মহামহিম দূরত্বের দেশে চড়া আকাশচুম্বি দাম হাঁকা হয়েছে। এই অবস্থায় সমাজে আর্থিক বৈষম্যের বিবর আরো বেদনাদায়কভাবে উন্মোচিত হয়েছে। বৈশাখের যে আবহমান সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ- ভেদাভেদ ভুলে পুরানো দিনের বেদনা ও বৈষম্যের জঞ্জাল সরিয়ে নতুন দিনের আলো অবগাহনের মতো গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা ও পরিতৃপ্তিকে উপভোগ করার চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক হয়েছে কতিপয় পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির এই অতি অস্বাভাবিক আচরণে।

প্রভূত পরিসংখ্যান, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও পটভূমিতে আজ এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, বৈষম্য বাড়ছে অনেক ক্ষেত্রে- সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের ও নাগরিকের মধ্যে, করদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে, শিল্পমালিক ও শ্রমিকের মধ্যে, নীতিনির্ধারকের সাথে পোষণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, উৎপাদনকারীর সাথে খুচরা ক্রেতার, ব্যাংকের আমানতকারীদের সাথে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার, সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যাশার সাথে আর্থিক খরচে কর্মনৈপুণ্যের, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার সাথে ব্যয় ব্যবস্থাপনার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সাথে সাধারণ মানুষের। সমাজে অর্থ ক্ষেত্রে অপব্যয়ের জৌলুসের চাকচিক্যের ডামাডোলকে মনে হতেই পারে এটি পুঁজিবাদী মানসিকতা প্রসূত এবং বৈষম্য বিলাসী উদাসীন ঊর্ধ্বতনদের ইচ্ছা ও অভিলাষ উৎসারিত। এই অগ্রগতি গুণগতমান উন্নয়ন ব্যতিরেকে শিক্ষার পাসের হার বৃদ্ধির মতো সাময়িক তৃপ্তিলাভের অগ্রগতি মনে হতে পারে- ভূত ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করে নয়- সাময়িকভাবে, নিজেদের মতো করে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকা-কে সীমিতভাবে সীমাবদ্ধকরণের প্রয়াস উৎসারিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য বিভাজন থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী একটি স্বাধীন সার্বভৌম অর্থনীতির প্রাণবায়ু যে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও ন্যায়নীতি নির্ভরতা, নৈতিক মনোবল ও মূল্যবোধ তার সার্বিক অবস্থান ও উপস্থিতি আপাত প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসা অবয়বে উৎসাহিতবোধ করা চলে না। সেগুলো ক্রমশ নির্বাসনে পাঠিয়ে সাময়িক এই প্রগলভতায় সমাজ প্রকৃতপক্ষে এগোচ্ছে না পিছাচ্ছে তার একটা সালতামামি প্রয়োজন। সালতামামি পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হোক।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category