কোভিড-১৯ বদলে দিয়েছে অনেক কিছু। বদলে গেছে মানুষের জীবন-যাপনের স্বাভাবিক রীতি-ধারাও। সামাজিক জীবনেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়েছে। করোনা মহামারিতে দেশের অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। জীবন বাঁচাতে অনেকে বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। পাশাপাশি বিদেশ ফেরত প্রচুর মানুষও রয়েছেন। কর্মহীন অবস্থায় বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে ফেরার হিড়িকে চাপে পড়ে গ্রামীণ অর্থনীতি। ওই চাপ কাটানোর বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গ্রামীণ মানুষের পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মেটানোসহ আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রকল্প গ্রহণ করে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ বসতবাড়ির আঙিনা, পুকুর ও খালের পাড়, বাড়ির আশপাশ, স্যাঁতসেঁতে ছায়াযুক্ত প্রতি ইঞ্চি অব্যবহৃত ও অনাবাদি জমিতে শাক-সবজি ও ফলমূল উৎপাদন করা হবে। তাতে মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর হওয়ার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে ওই নির্দেশনা দেন। এরপরই কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পতিত জমিতে উন্নত কৃষি-প্রযুক্তি ব্যবহার করে শাক-সবজি ও ফলমূল চাষাবাদের প্রকল্পটি হাতে নেয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী সারাদেশে (হাওর ও পাহাড়ের কিছুু অংশ ছাড়া) বর্তমানে পতিত ও অনাবাদি কিন্তু আবাদ হতে পারে এমন জমির পরিমাণ ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৬৬৮ হেক্টর। ওই জমি চাষের আওতায় আনা যেতে পারে। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান করাও সম্ভব। প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদনও পায়।
সূত্র জানায়, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে গৃহীত ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পে মোট ৪৩৮ কোটি ৪৭ টাকা খরচ হবে। যার পুরোটাই হবে সরকারি অর্থায়ন। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। সরকারি অর্থায়নে দেশের সব উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তাতে সারাদেশের পতিত জমি ও বসতবাড়ির চারপাশ চাষের আওতায় আসবে। বাড়ির আঙিনার পতিত জমিগুলোও নানা শাক-সবজি আর ফলে ভরে উঠবে। আর তা পরিবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিক্রি করেও পাওয়া যাবে নগদ টাকা। সব মিলিয়ে গড়ে উঠবে পারিবারিক পুষ্টি বাগান এবং মানুষের আয় বাড়বে। সোনার ফসলে ভরে উঠবে বাড়ির আঙিনা। এমনকি এক বছরেই দেশজুড়ে পারিবারিক পুষ্টি বাগান দেখা যাবে। ওসব বাগানে শাকসবজির পাশাপাশি ফলমূল উৎপাদন করা যাবে।
সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন গ্রামে ৫ লাখের বেশি পারিবারিক পুষ্টি বাগান গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। দু’ভাগে ওসব বাগান গড়ে তোলা হবে। তার মধ্যে দেড় শতকের মধ্যে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৪০০টি বাগান হবে। বাকি বাগানগুলো হবে ৫ শতক জায়গার ওপর। তার মধ্যে স্যাঁতসেঁতে জায়গায় কচু জাতীয় ও ছায়াযুক্ত স্থানে হলুদ ও আদা ফসলের বাগান গড়ে উঠবে। প্রতিটি বাগানে ৫টি করে ফল, ফসলের বেডে তিন মৌসুমে মোট ১৫টি ফসল উৎপাদন হবে। একটি বেডে ৩টি ফসলের ফলন পাওয়া যাবে। প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ৫ লাখ ১৭ হাজার ৯২০টি বিভিন্ন প্রদর্শনী খামারও স্থাপন করা হবে। প্রতি ইউনিয়নে ৩২টি প্রদর্শনী খামার হবে। তা ছাড়াও প্রকল্পের অধীনে প্রতি বাগানীকে ৫ হাজার টাকার উপকরণ দেওয়া হবে। প্রথম বছর সার, বীজ, চারা কলমসহ একাধিক উপকরণ দেওয়ার কথা। দ্বিতীয় বছরে বাগান মেরামত ও চারা কলমের জন্যে ২ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। পাশাপাশি ১০০টি কেঁচো বা জৈব সার ফার্ম গড়ে তোলার জন্যেও সহায়তা দেওয়া হবে। ওসব বাগানে উৎপাদিত শাক-সবজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ফুলকপি, মুলা, বেগুন, বাঁধাকপি, মরিচ, লাউ, কুমড়া; আর ফলের মধ্যে থাকবে মাল্টা, পেঁপে, থাই পেয়ারা ইত্যাদি। প্রস্তাবিত খামারের মডেল এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে একজন কৃষক সারাবছরই খামার থেকে কিছু না কিছু পাবেনই। কখনো সবজি থাকবে, আবার কখনো থাকবে ফল। এক লাখ ৭৭ হাজার ১২০ জন কৃষক-কিষানি ও ৫ হাজার ৭৬০ জন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন রক্ষণাবেক্ষণ এবং সম্প্রসারণের বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। যেসব পরিবারের এক থেকে দেড় শতাংশ পরিমাণ পতিত জমি আছে, তারা এই সুবিধা পাচ্ছে। প্রকল্পের মূল কার্যক্রমের মধ্যে প্রদর্শনী প্লট স্থাপনের মাধ্যমে বছরব্যাপী ৫ লাখ ৩ হাজার ১৬০টি কৃষক পরিবারের পারিবারিক সবজি পুষ্টি বাগান প্রদর্শনী স্থাপন, ৭ হাজার ৩৮০টি স্যাঁতসেঁতে জমিতে কচুু জাতীয় সবজি চাষ প্রদর্শনী, ৭ হাজার ৩৮০টি ছায়াযুক্ত স্থান, বসতবাড়িতে আদা, হলুদ চাষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে। তা ছাড়া শাক-সবজি সংরক্ষণের জন্য ১২৮টি জিরো এনার্জি কুল চেম্বার স্থাপন করা হবে। ১০০টি কমিউনিটি বেইজড ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন পিট স্থাপন করা হবে। মেকানিক্যাল ভার্মিকম্পোস্ট সেপারেটর মেশিন ১০০টি, ফুট স্প্র্রেয়ার ৪ হাজার ৫৫৪টি, হ্যান্ড স্প্রেয়ার ৯ হাজার ১০৮টি, বারিং নাইফ ১৩ হাজার ৬৬২টি, বুশ কাটার ১৩ হাজার ৬৬২টি সরবরাহ করা হবে।
এ প্রকল্প বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হচ্ছে কোনো জায়গা যেন অনাবাদি পড়ে না থাকে। ওই নির্দেশনা মেনেই দেশের অনাবাদি, বসতবাড়ি সংলগ্ন পতিত জমি অর্থাৎ সকল প্রকার ভূমি কৃষি কাজে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হবে। তা ছাড়াও করোনার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ে। এমন অবস্থায় কোনো জমি অনাবাদি রাখা না হোক তাই এমন ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যাতে বাড়ির চারপাশে নানা ধরনের সবজি ও ফলমূল কৃষক উৎপাদন করতে পারেন। এর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হবে। অথচ বছরের পর বছর ধরেই মানুষের বাড়ির আশপাশে জমি অব্যবহৃত পড়ে থাকছে। সেখানে কখনো কিছুু চাষ হয়নি এবং প্রযুক্তির ব্যবহারও হয়নি। ওসব পতিত জমিকে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফলনের উপযোগী করে তোলা হবে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, দেশের প্রতিটি গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই খালি জায়গা বা পতিত জায়গা দেখা যায়। ওসব জায়গায় অনেক কিছুই ফলানো সম্ভব। তাতে ওই পরিবারটিকে বাজার থেকে অনেক শাক-সবজি কিনতে হবে না বরং বিক্রি করতে পারবে। এটি সরকারের ওই রকম একটি উদ্যোগ। এর মাধ্যমে পুষ্টিহীনতা দূর হওয়ার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। উদ্যোগটি ইতিমধ্যে কার্যকর হওয়ায় অনেক গ্রামীণ পরিবার পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আয় বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে রাখছে উৎসাহব্যঞ্জক অবদান।