ইকবাল আহমেদ, প্রতিষ্ঠাতা, সিমার্ক গ্রুপ
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চেইন শপ ওয়ালমার্ট থেকে শুরু করে ছোট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানেও মিলছে চিংড়িসহ নানা ধরনের হিমায়িত মাছ। এর মধ্যে বাংলাদেশের মাছও রয়েছে, যা সরবরাহ করছে যুক্তরাজ্যের সিমার্ক পিএলসি। এ সিমার্ক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সিলেটের ইকবাল আহমেদ। তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের হিমায়িত মাছ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্ববাজারে পৌঁছে যাচ্ছে। বদৌলতে বড় হচ্ছে সিমার্কের ব্যবসা।
১৯৭৬ সালে ম্যানচেস্টারে বাবার ব্যবসায়ে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে ব্যবসায়ের জগতে প্রবেশ করেন ইকবাল আহমেদ। ওই বছরেই নিজের দুই ভাই কামাল আহমেদ ও বেলাল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ইকবাল ব্র্র্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি (ইবকো)। প্রতিষ্ঠালগ্ন্ন থেকেই কোম্পানিটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হিমায়িত মাছ, চিংড়িসহ নানা খাদ্যসামগ্রীর আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা শুরু করে। তারা বাংলাদেশ থেকে মিঠা ও লোনা পানির বিভিন্ন ধরনের হিমায়িত মাছ, বাগদা চিংড়ি ও গলদা চিংড়ি নিয়ে যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশে বিক্রি করে। তারা এখন মাছসহ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও গুদামজাতকরণে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী।
১৯৯১ সালে ইকবাল আহমেদ গড়ে তোলেন সিমার্ক পিএলসি। একই বছরে তিনি চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ও হিমাগার গড়ে তোলেন। এরপর বিভিন্ন দেশে প্রক্রিয়াজাত ও হিমায়িত খাদ্যপণ্য রপ্তানি শুরু করেন। তাঁর হাতে গড়া টাইগার, সি গোল্ড, লিলি, মি প্রণ, ইবকো প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এখন হিমায়িত মাছ ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। সব মিলিয়ে সিমার্ক গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার তথা মোট লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি পাউন্ড, যা বাংলাদেশের প্রায় ৪ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার সমান। তবে করোনাভাইরাস ও ব্র্রেক্সিটের প্রভাবে ব্যবসা কিছুটা কমেছে।
বেশ আগেই যুক্তরাজ্যের শীর্ষ ধনী তালিকায় নাম উঠেছে ইকবাল আহমেদের। রপ্তানিতে অবদান রাখার জন্য তিনি একাধিক স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ১৯৯৮ সালে কুইন্স অ্যাওয়ার্ড পান। এ ছাড়া ২০০১-২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সামুদ্র্রিক মাছ রপ্তানিতে শীর্ষস্থান অর্জনের সুবাদেও রপ্তানি পদক পায় সিমার্ক।
অন্য অনেকের মতো ইকবাল আহমেদের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠাও সহজ ছিল না। তিনি বলেন, ‘ব্যবসা সময়ে সময়ে কঠিন হয়ে উঠেছে, কিন্তু কখনো হাল ছাড়িনি। ওল্ডহ্যাম ও ম্যানচেস্টারের দোকানে দোকানে আর রেস্তোরাঁয় পণ্য বিক্রি করেছি। এখানে–ওখানে দরজায় দরজায় গিয়েছি। সফলতা অর্জনের পাশাপাশি বহু জায়গায় প্রত্যাখ্যাতও হতে হয়েছে।’
ইকবাল আহমেদের ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে আরও নানা খাতে ও নানা দেশে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে তাঁর রয়েছে তিনটি কারখানা। এ ছাড়া দাতব্য কাজেও রয়েছে তাঁর বিশেষ আগ্রহ। সিলেটের নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছেন স্কুল ও কলেজ। রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ কর্মসূচি চালাচ্ছে ইকবাল আহমেদের ফাউন্ডেশন। তিনি এনআরবি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন, এখন পরিচালক।
বাংলাদেশের চিংড়ির রপ্তানি সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ইকবাল আহমেদ বলেন, ‘গত ১০ বছরে কোনো প্রবৃদ্ধি হয়নি। তবে মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছরে আয় বেড়েছে, চিংড়ি রপ্তানি কিন্তু বাড়েনি। প্রায় ২০ বছর ধরে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে। চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত এ চিংড়ি উৎপাদন করছে, রপ্তানিতেও নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা। পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ির চাষ শুরু হলে রপ্তানি বছরে এক বিলিয়ন বা এক শ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা জিএসপি থাকায় সহজেই আমরা বাজার ধরতে পারব। অনেক দেশের এ সুবিধা নেই, এতে তারা পিছিয়ে পড়বে।’
চিংড়ির বাজার সম্পর্কে ইকবাল আহমেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে মাঝারি আকারের চিংড়ির চাহিদা বেশি। আগে চিংড়ি বড় সুপার মার্কেট ও হাইপার মার্কেটে বিক্রি হতো। এখন চিংড়ি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হয়ে গেছে। ১৬-২০টি চিংড়ির ওজন ৪৫০ গ্রাম (১ পাউন্ড) হলে সেটাকে আন্তর্জাতিক মানের আকার বলে ধরা হয়। বাংলাদেশে চিংড়ি চাষে এখনো বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ শুরু হয়নি। যেসব দেশ বিশ্ববাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা সবাই তা শুরু করেছে।’
বাংলাদেশে বড় আকারের চিংড়ি উৎপাদন হয়। অনেকে মনে করেন, বড় চিংড়ি মানেই বেশি দাম, আসলে সেই দিন আর নেই। এ জন্য এমন আকারের চিংড়ি উৎপাদন করতে হবে, যেটির চাহিদা আছে আন্তর্জাতিক বাজারে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা হচ্ছে না।
ইকবাল আহমেদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে বড় আকারের চিংড়ি উৎপাদন হয়। অনেকে মনে করেন, বড় চিংড়ি মানেই বেশি দাম, আসলে সেই দিন আর নেই। এ জন্য এমন আকারের চিংড়ি উৎপাদন করতে হবে, যেটির চাহিদা আছে আন্তর্জাতিক বাজারে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা হচ্ছে না। আমরা শুধু বাগদা চিংড়ি উৎপাদন করছি, যেটা প্রতি হেক্টরে ৩০০-৪০০ কেজি উৎপাদন হয়। এ কারণে আমরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় পারছি না।’
১৯৬৫ সালে যখন ইকবাল আহমেদের বয়স ৯ বছর, তখন তাঁর বাবা কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। ফলে কম বয়সেই তাঁকে দেশে থাকা পুরো পরিবারের হাল ধরতে হয়। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মা ও ভাইবোনদের নিয়ে ইকবাল আহমেদও যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন। তখন ইকবালের বয়স ছিল ১৫ বছর। ওই সময় তাঁরাই ছিলেন ম্যানচেস্টারের ওল্ডহ্যামে একমাত্র বাংলাদেশি পরিবার।অর্থকণ্ঠ প্রতিবেদক