• রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৫:২৩ অপরাহ্ন

ব্যাংকিং সেবা বদলে দিয়েছে এটিএম প্রযুক্তি

ড.যশোদা জীবন দেবনাথ / ১০২ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০২২

মনে মনে কল্পনা করুন- আপনি কোনো একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় টাকা তুলতে গেছেন। প্রথমে আপনি কাউন্টারে চেক জমা দিলেন। ক্যাশ কাউন্টার থেকে আপনাকে একটা টোকেন দিল। আপনি অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, কখন আপনার ডাক আসে। বেশ কিছুক্ষণ পর আপনার ডাকও এলো। এবার আপনাকে পরখ করার পালা। ক্যাশ অফিসার আপনার স্বাক্ষর মেলাচ্ছেন। আপনার ছবি মেলাচ্ছেন। এরপর টাকা দেওয়ার পালা। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কমপক্ষে আধাঘণ্টা সময় ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু এবার ধরুন আপনি ব্যাংকের শাখার নানা ঝামেলা এড়িয়ে দিনরাত ২৪ ঘণ্টার যে কোনো সময় আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারছেন। এটার জন্য আপনাকে কোনো শাখায় যেতে হচ্ছে না। শুধু বাড়ির পাশের একটি এটিএম বুথে গিয়ে আপনি টাকাটা পাচ্ছেন। শুক্র, শনি বা অন্য কোনো দিনে ব্যাংক বন্ধ? তাতে কোনো ক্ষতি নেই। বলা যায়, বাংলাদেশের আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অটোমেটেড ট্র্রেলার মেশিন বা এটিএম যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ব্যবসায়ীদের ঐকান্তিক চেষ্টা এবং সরকারের নীতিসহায়তার কারণে এ খাতটি এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

ড.যশোদা জীবন দেবনাথ


ব্যাংক শাখার বাইরে গিয়ে ব্যাংকের টাকা তোলা যায় এ ধারণাটি আমাদের দেশে নতুন হলেও অন্যান্য দেশে অনেক আগে থেকেই এটিএম মেশিন চালু করা হয়। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে লুথার জর্জ সিমজিয়ান ‘ব্যাংকোগ্রাফ’ নামক একটি মেশিন আবিষ্কার করেন। মূলত, এ মেশিনের মাধ্যমে ব্যাংকের গ্রাহকরা নগদ অর্থ এবং বিভিন্ন ধরনের চেক জমা দিতে পারতেন। এরপর ১৯৬৭ সালে আসে যুগান্তকারী ঘটনা। এ বছর ব্র্রিটেনের আবিষ্কারক জন শেফার্ড এটিএম মেশিন আবিষ্কার করেন। প্রথম মেশিনটি বসানো হয় লন্ডনের এনফিল্ডের বার্কলে ব্যাংকের শাখায়। এরপর সারা বিশ্বে এটিএম মেশিনের জয়রথ চলতে থাকে।
বাংলাদেশে এটিএম মেশিনের যাত্রা খুব পুরোনো- এটা বলা যাবে না। নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে এএনজেড গ্রিনলেজ ব্যাংক এদেশে এটিএম মেশিনের ধারণা চালু করে। কিন্তু এদেশে এটিএম মেশিনের ব্যাপকতা শুরু হয় ২০০৯ সালের পর থেকে। এ সময় টেকনোমিডিয়া নামক কোম্পানি বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের জন্য এটিএম বুথ বসাতে থাকে। বর্তমানে টেকনোমিডিয়ার বসানো মোট এটিএম মেশিনের বুথের সংখ্যা ৫ হাজারের মতো। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে আমরা কি চাহিদামতো এগিয়ে যেতে পেরেছি? এটি একটি বড় প্রশ্ন। নানা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উদ্যোক্তারা এ খাতকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তাদের অগ্রযাত্রায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট এটিএম বুথের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫০০।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কি আমরা গ্রাহকদের চাহিদামতো এটিএম মেশিন বসাতে পেরেছি? উত্তর হচ্ছে ‘না’। এক হিসাবে দেখা গেছে, উন্নত দেশ এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে প্রতি ১ লাখ লোকের জন্য ১৪টি এটিএম বুথ রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রতি লাখ ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীর জন্য মাত্র একটি এটিএম বুথ রয়েছে। এই হিসেবে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সংযুক্তির জন্য এটিএম বুথ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
তবে নতুন যে কোনো বিষয়ে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এটিএম প্রযুক্তিও বাইরে নয়। এ খাতে এখনো বেশকিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে। বিশেষ করে জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি এখানে প্রণিধানযোগ্য। তবে পৃথিবীর কোনো দেশ এ জালিয়াতি থেকে মুক্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এমনকি অস্ট্র্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের মতো দেশেও এটিএম মেশিন থেকে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ হয়ে থাকে। কিন্তু এক হিসাবে দেখা গেছে যে, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এটিএম সংক্রান্ত জালিয়াতির ঘটনা কম। আশার কথা এই যে, নানা ধরনের জালিয়াতি রোধে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। আশা করা হচ্ছে, এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে জালিয়াতির ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।


এটিএম বুথের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে এ সংক্রান্ত মেশিনগুলোর প্রায় সবই আমদানি- নির্ভর। এতে করে প্রতিবছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্র্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে, এ খাতের উদ্যোক্তারা বিষয়টি মাথায় রেখে দেশের ভেতর এসব মেশিন অ্যাসেম্বলিং করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ঢাকার অদূরে কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কে টেকনোমিডিয়ার উদ্যোগে এটিএম মেশিন অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্ট বসানো হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, চলতি বছরেই এ প্লø্যান্ট থেকে এটিএম মেশিন অ্যাসেম্বলিংয়ের কাজ শুরু হবে। এটি করা গেলে এ খাতের আমদানি নির্ভরতা অনেক কমবে। দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্র্রা সাশ্রয় হবে। এক্ষেত্রে সরকারের নীতিসহায়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে বলা যায়, আমাদের দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সংযুক্ত করতে হলে ব্যাংকিং সেবায় অন্তর্ভুক্ত করার বিকল্প নেই। একমাত্র এটিএম প্রযুক্তি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাজধানী থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এই সেবা পৌঁছে দিতে পারলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা গতি পাবে। বর্তমান সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নীতির আলোকে গ্রাম পর্যন্ত ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে ইউনিয়ন পর্যায়ে যেসব সেবাকেন্দ্র রয়েছে সেসব স্থানে এটিএম মেশিন পৌঁছানো গেলে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে যাবে।
লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই; এটিএম খাতের উদ্যোক্তা


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category