ড. সন্তোষ কুমার দেব
পর্যটন এখন একটি শিল্প, যা অনেক দেশের অর্থনীতির অন্যতম মুখ্য উপাদান। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ দেশে দেশে ভ্রমণ করে আসছে। পৃথিবী দেখার দুর্নিবার নেশায় মানুষ সাত সমুদ্র তেরো-নদী পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছে অজানা অচিন দেশে।
মানুষের এই দুর্নিবার ভ্রমণাকাক্সক্ষা থেকেই পর্যটনশিল্পের উৎপত্তি। পর্যটন এখন শুধু কোনো ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর দেশভ্রমণ নয় বরং সমগ্র মানবগোষ্ঠীর জন্য এটি বিশ্বজনীন। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটনের রূপ, প্রকৃতিতে এবং সেবার মানে এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন।
২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। ১৯৮০ সাল থেকে সব দেশে এটি পালিত হয়ে আসছে। ২০২২ সালে বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জবঃযরহশরহম ঞড়ঁৎরংস’।
‘জবঃযরহশরহম ঞড়ঁৎরংস’ পর্যটনশিল্পে সৃজনশীলতাকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। অন্যদিকে করোনা মহামারি পর্যটনশিল্পে সংকট মোকাবিলা ও সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে সম্মিলিত উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সম্মিলিত উন্নয়ন মূলত প্রাইভেট-পাবলিক স্থানীয় জনগোষ্ঠী সম্পৃক্ত ও সমন্বয় করে উন্নয়ন।
২০১৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে পর্যটনের ভূমিকা ছিল ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার তবে ২০২১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলারে। ২০১৯ সালে বিশ্ব জিডিপিতে অবদান ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ তবে মহামারির কারণে ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশে।
২০১৯ সালে পর্যটন খাতে কর্মরত ছিল ৩৩০ মিলিয়ন মানুষ তবে ২০২০ সালে ৬২ মিলিয়ন লোক চাকরি হারিয়েছিল এই সেক্টরে, যা মোট চাকরির ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ, তবে ২০২১ সালে পর্যটন কেন্দ্রগুলো পুনরায় চালু হওয়ায় ১৮ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ পুনরায় চাকরি ফিরে পায় বিধায় এখন ২৮৯ মিলিয়ন মানুষ এই সেক্টরে কর্মরত। ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ পর্যটক ৪৭ দশমিক ৪ শতাংশ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটনশিল্প। করোনা মহামারির সংকট কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যে ৫টি সেক্টরকে গুরুত্ব আরোপ করেছে তার মধ্যে পর্যটন উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ বাস্তবায়নে অন্যতম ভূমিকা রাখবে পর্যটনশিল্প। টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যটন, সমবায় পর্যটন, গ্রামীণ পর্যটন, সুনীল পর্যটন, কমিউনিটি-বেইজড ট্যুরিজম ও ভার্চুয়াল ট্যুরিজম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশের পর্যটন নীতিমালার আলোকে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় এই খাতের সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল হয়েছে। কিন্তু নানাবিধ সমস্যার কারণে বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের বিকাশে প্রত্যাশিত ও কাক্সিক্ষত অগ্রগতি সাধিত হয়নি। করোনাভাইরাস পর্যটনশিল্প বিপর্যস্ত করে দিয়েছে বিধায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডাররা। এমনকি ঋণাত্মক প্রভাব পড়েছে খাতসংশ্লিষ্ট মানুষদের আয়ের ওপর এবং চাকরি হারিয়েছে অনেক লোক।
বৈশ্বিক পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানমুখী। বাংলাদেশে পর্যটন আকর্ষণগুলোর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, মিঠামইন হাওর, সিলেটের চা-বাগান, রাতারগুল, বিছানাকান্দি এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়।
কোরাল আইল্যান্ড সেন্টমার্টিন, রামুর বৌদ্ধমন্দির, হিমছড়ির ঝরনা, ইনানী সমুদ্রসৈকত, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর ও কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ি অঞ্চল দেখে পর্যটকেরা আত্মভোলা হয়ে যান। আবার আমাদের দেশে অনেক ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর মাজার, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি শুধু দেশি ও বিদেশি পর্যটক ও দর্শনার্থীদের কাছেও সমান জনপ্রিয় ও সমাদৃত।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং পর্যটনের একটি উপস্থাপনায় শ্রমজীবী মানুষের জন্য পর্যটন ধারণার বিকাশের রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল, যার উৎপত্তি ফ্রান্সে। সমবায়ভিত্তিক পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের আর্থিকভাবে পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি স্থায়ী উপার্জনের পথ সুগম হবে।
পর্যটকেরা এখন গ্রামমুখী। গ্রামের নান্দনিক সৌন্দর্য দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা, চাষাবাদ, লোকসংগীত, গ্রামীণ জীবনধারা, সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা গ্রামবাংলার জীববৈচিত্র্য ও সবুজের সমারোহ।
পর্যটন একটি শ্রমঘন শিল্প, তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে এই শিল্প অনন্য ভূমিকা পালন করছে। পর্যটনকে বিশ্বমানে উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে, যার মধ্যে পর্যটন নগরী কক্সবাজার অন্যতম।
পর্যটন নগরী কক্সবাজারে তিনটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন পার্ক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এই তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হলো সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। এই ট্যুরিজম পার্কগুলোয় প্রায় ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রতি বছরে বাড়তি আয় হবে প্রায় দুইশ কোটি ইউএস ডলার।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি-২০৩০) অর্জন ত্বরান্বিত করতে সমবায়ভিত্তিক পর্যটন, গ্রামীণ পর্যটন, কমিউনিটি-বেইজড ট্যুরিজম, জেলাভিত্তিক পর্যটন, সাংস্কৃতিক পর্যটন ও হাওর পর্যটন উন্নয়নের মধ্য দিয়ে একতা-সাম্য ও সহযোগিতার প্রত্যয় বৃদ্ধি করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে পর্যটনশিল্প বাংলাদেশে জাতীয় উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারে।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য পর্যটন প্রসার প্রয়োজন। অল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে সমবায় পর্যটন, কমিউনিটি-বেইজড পর্যটন আরও সম্প্রসারিত হবে।
গ্রামের মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা, একতা, সাম্য বৃদ্ধি পাবে যা বর্তমানে চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সহযোগিতা করবে এবং বাস্তবায়িত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা।
পর্যটনশিল্পের করোনা মহামারি সংকট উত্তরণে ও টেকসই পর্যটন বিনির্মাণে নিম্নলিখিত কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। পর্যটকদের নিকট পুনরায় আস্থা তৈরি ও নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টির লক্ষ্যে পুনর্বাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো চিহ্নিতকরণ, প্রচার ও প্রসারের কাজ গবেষণার পরিধি বৃদ্ধি করে পর্যটক প্রত্যাশা সম্পর্কে ধারণা সমৃদ্ধ করা দরকার। সেই সাথে ডিজিটাল সেবা ও ডিজিটাল মার্কেটিং কৌশলসমূহ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ ও সন্তুষ্টি বিধান আরও সহজ হবে। টেকসই পর্যটন বিনির্মাণে ও মহামারি সংকট উত্তরণের জন্য কমিউনিটি-বেইজড ট্যুরিজম, রিভার ট্যুরিজম, হাওর ট্যুরিজম, গ্রামীণ পর্যটন ও সুনীল পর্যটনের গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের উপাদানগুলোর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ওয়েব সাইট, বিগ ডেটা ও কনটেন্ট মার্কেটিং-এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিধায় পর্যটন ব্র্যান্ডিং ও প্রমোশনের ক্ষেত্রে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নর্থ-আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের দেশগুলো সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং (ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব)-এর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করছে, এতসব উন্নত বিশ্বের মতো পর্যটন প্রমোশনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের উপর দেশে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
পর্যটনের নতুন ধারণা চচঈচ (চৎরাধঃব-চঁনষরপ-ঈড়সসঁহরঃু চধৎঃহবৎংযরঢ়)-এর উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। পর্যটন সংশ্লিষ্ট উপ-খাতগুলোর মধ্যে ট্র্যাভেল এজেন্ট, ট্যুর গাইড, ট্যুর অপারেটর, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, ফুড সাপ্লাই চেইন ও অন্যান্য উপখাতসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে পর্যটন উন্নয়নের জন্য গাইডলাইন তৈরি করতে হবে। ছোট ছোট প্রমো তৈরি করে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্র্যান্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে আলোকিত হবে অমিত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পর্যটন।