খুফিয়া’র নায়িকা নির্বাচন ও বিদেশী সিনেমায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি
মনিজা রহমান
‘খুফিয়া’ সিনেমাতে অভিনয়ের প্রস্তাব একে একে বাংলাদেশের দুজন নায়িকা প্রত্যাখানের পরে এখন আরেকজন অভিনেত্রী করবে বলে জল্পনা কল্পনা চলছে। বলিউডের সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব, তদুপুরি বিখ্যাত সব সিনেমার নির্মাতা বিশাল ভরদ্বাজের প্রস্তাব, সেটা কেন প্রত্যাখান হবে?
তাদের বক্তব্য চিত্রনাট্য পড়ে মনে হয়েছে, সিনেমাতে বাংলাদেশকে ঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিকে ভুলভাবে দেখানো হয়েছে। এখন কথা হল, যদি কোন সিনেমাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, তাহলে সেটা প্রতিবাদ করার দায়িত্ব কি বাংলাদেশে সরকারের নয়? কারণ ইতিহাস বিকৃতি করা এক ধরনের অন্যায়। আর অন্যায়কে সহ্য করাও নিশ্চয়ই অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে।
আলিয়া ভাটের ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ সিনেমার শীর্ষে থাকবে- ‘রাজী’। বছর দুয়েক আগে সিনেমাটি দেখতে গিয়ে শুরুতে খুব ভালো লাগছিল। এই সিনেমার আলিয়া ভাট এক ভারতীয় গোয়েন্দার চরিত্রে অভিনয় করে যে পাকিস্তানের একজন উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারের কনিষ্ঠ পুত্রকে বিয়ে করে। সে বিভিন্ন তথ্য ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনীকে সরবরাহ করে।
এই কাজে যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। এভাবে শ্বশুর-ভাসুরকে হত্যা করার পরে ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে মারা যায় আলিয়ার স্বামী। অন্যদের হত্যা করলেও স্বামীর মৃত্যু আলিয়া সহ্য করতে পারেনা, শেষ পর্যন্ত সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
মেঘনা গুলজার পরিচালিত বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম সফল এই সিনেমাতে পুরো সময় ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বিতর্ক উঠেছিল আলী আব্বাস জাফর পরিচালিত সিনেমা ‘গুন্ডে’ কে ঘিরেও। এখানে অভিনেতা রণবীর সিং ও অর্জুন কাপুর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া রিফিউজি বা উদ্বাস্তু’র ভূমিকায় অভিনয় করে। প্রয়াত প্রতিভাবান অভিনেতা ইরফান খান ও মেধাবী অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়াও এই সিনেমাতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘গুন্ডে’ সিনেমার প্রথম দৃশ্যে দেখানো হয়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশের জন্ম হয়। চলচ্চিত্রটিতে বাংলাদেশের মানুষ যে জীবনপণ রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, সেটা উল্লেখ করা হয়নি। বাংলাদেশের ৩০ লাখ শহীদের মৃত্যু, মা-বোনদের আত্মত্যাগকে উপেক্ষা করা হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য এই সিনেমার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল।
শাহরুখ খান ও আনুশকা শর্মা অভিনীত ‘জাব হ্যারি মেট সেজাল’ সিনেমায় ইউরোপে অবস্থিত বাংলাদেশী অভিবাসীদের অসম্মানভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সিনেমার একটি চরিত্র বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসী। তাকে একটি নকল জুয়েলারি চক্রের হোতা হিসেবে দেখানো হয়। তিনি হ্যারি অর্থাৎ শাহরুখ খানকে বলেন, ’বাংলাদেশে বারবার বন্যায় কৃষি জমি নষ্ট হওয়ার কারণে তিনি জীবিকার সন্ধানে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে পর্তুগালে এসেছেন।’ সন্দেহ নেই, কোন সিনেমায় এভাবে বাংলাদেশী অভিবাসীদের উপস্থাপন, অবশ্যই মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেবে।
শুধু হিন্দি সিনেমা নয়, হলিউডের অনেক সিনেমাতে ‘বাংলাদেশ’ দেশটাকে হাস্যকর ভাবে দেখানো হয়। কিছুদিন আগে একজনের লেখায় পড়েছিলাম- নায়ক একটা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরে বলছে, ‘এটা যদি মেড ইন ফ্রান্স হয়, তাহলে কিছু হবে না। আর মেড ইন বাংলাদেশ হলে আমি অবশ্যই মারা যাব।’ কথাটা সত্যি অপমানজনক। ’মেড ইন বাংলাদেশ’লেখা পোষাক সারা পৃথিবীতে সেরা ব্র্যান্ডশপগুলোতে। বরং বেশীরভাগ সময় ‘মেড ইন চায়না’ জিনিষকে ভঙ্গুর ও সস্তা ধরা হয়।
নেটফ্লিক্সে বেশী বেশী সিনেমা দেখার সুবাদে সেদিন দেখলাম- জাস্টিন টিম্বারলেক ও মিলা কুনিস অভিনীত সিনেমা ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট’। সিনেমার পরিচালক হলেন উইল গ্লুক। সিনেমায় জাস্টিন টিম্বারলেক একজন আর্ট ডিরেক্টর। মিলা কুনিস একজন জব রিক্রুটার, যে জাস্টিন টিম্বারলেককে জি কিউ ম্যাগাজিনের জন্য নিয়োগ দেয়। এই কাজের জন্য মিলা কুনিস কমিশন পায়। জি কিউ ম্যাগাজিনে জাস্টিন টিম্বারলেকের সহকর্মী হয় আরেক বিখ্যাত অভিনেতা উডি হ্যারেলসন।
একদিন অফিসে বসে কাজ করছিল টিম্বারলেক, মিলা কুনিসের সঙ্গে বন্ধুত্বে ভাঙ্গন ধরার জন্য সে মন মরা ছিল তখন। ওই সময় উডি হ্যারেলসনের সঙ্গে টিম্বারলেকের যে কথোপকথন হয়, সেটা অনেকটা এই রকম।
উডি : লাঞ্চ খেতে যাবে না?
জাস্টিন : আমার কিছু কাজ আছে। লাঞ্চ খেতে যাচ্ছি না।
উডি : তোমার মতো কাজ করার মানুষ আছে বলেই আমেরিকা পৃথিবীতে নম্বর ওয়ান।
উডি : তবে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জাপানের পরে আমেরিকা… থ্যাঙ্কস গড ফর বাংগাদেশ।
ইংরেজী উচ্চারণে বাংলাদেশ উচ্চারণে ‘ল’ শব্দটা শোনা যায় না। এখানে সহচরিত্রটি বাংলাদেশ নিয়ে ঠাট্টা করল এই কারণে যে বাংলাদেশের মতো দেশ আছে বলে আমেরিকা এখনও ওপরে। এই কথাটি অভিনেতা অন্য কোন ব্যর্থ রাষ্ট্রকে নিয়ে বলতে পারতেন! কিন্তু কোন কারণ ছাড়া তিনি বাংলাদশে সম্পর্কে বললেন।
সিনেমাটার ওই অংশ দেখার পরে খুব খারাপ লেগেছিল। বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক কোন খবর শোনার পরে যেমন খুব ভালো লাগে, তেমনভাবে নেতিবাচক কোন মন্তব্যে বিরক্ত লাগে। কখনও বেদনায় আক্রান্ত হই। হলিউডের মুভি হয়ত বাংলাদেশে সবাই দেখেনা, যে কারণে হয়ত বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বলিউডের সিনেমা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সবার প্রিয়।
‘খুফিয়া’ সিনেমা প্রসঙ্গে আবার আসি। নেটফ্লিক্সের প্রযোজনায় ভারতীয় পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজের এই সিনেমাতে গল্পের প্রয়োজনে এক চরিত্রের জন্য বাংলাদেশী অভিনেত্রী প্রয়োজন। অভিনয়ের প্রস্তাব দেয়া হলে প্রথমে বিদ্যা সিনহা মিম ও পরে মেহজাবিন চৌধুরী সেটা প্রত্যাখান করেন। তাদের অভিযোগ চিত্রনাট্যে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পরে আজমেরী হক বাঁধন আছেন তাদের তালিকায়।
বলিউডে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েও তারা ফিরিয়ে দিলেন। যে নির্মাতার হাত ধরে ‘মকবুল’ ‘ইশকিয়া’ ‘কামিনে, ‘হায়দার’, ‘ওমকারা’র মত মানসস্মত সিনেমা বানিয়েছেন, সেই পরিচালক তার নতুন সিনেমায় বাংলাদশেকে বাজে ভাবে উপস্থাপন করছে, এটা সত্যি বিস্ময়ের ও বেদনারও।
লেখার শেষে প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি বলিউড ইন্ডাস্ট্রিজ ও ভারতের সরকার দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। একই কথা প্রযোজ্য হলিউড ও আমেরিকার ক্ষেত্রে। দয়া করে দুটি বিষয়কে এক করবেন না।