দু’বছর আগের প্রথম দিনের কথা। তখন আমি ছিলাম একা। থাকতাম টাওয়ার হ্যামলেটস এর হার্টে, স্পিটালফিল্ডে, পেটিকোট লেন মার্কেটের উপরেই। পুত্র সজীবের ছোট্ট কোয়ার্কী এক রুমের এক স্টুডিও এ্যাপার্ট্মেন্টে। পাগল মানুষ, কবি মানুষ, ঐ একা একাই লিখি, থাকি, ঘুরি আর স্ফূর্তি লাগে। কারন কি! কারন সঙ্গে আছে না দুনিয়ার বিষ্ময়ভরা দুই চোখ যারা কূটো দেখলেও নেচে ওঠে। আছে অদম্য এক মন যে বসে থাকতেই চায় না এক জায়গায়।
তো সেদিন সন্ধ্যায় টোয়েনবি হলের পিয়ানো ও মানুষের সঙ্গ শেষে ফ্ল্যাটে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাঝ রাতে শুনি জানালায় কবুতরের বাক কুম্কুম্ বাক কুম্কুম্। ট্রফেলগার স্কোয়ার থেকে তখনকার সিটি মেয়র ক্যান লিভিংস্টোন নিষেধাজ্ঞা দিলে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। তখন থেকে তারা এই লন্ডনেরই নানান বহুতল দালানে বাসা বেঁধে আছে। আমার দালানের নাম মার্চেন্ট হাউস। এটা আছে পূর্ব লন্ডনের সেই কুখ্যাত জ্যাক দা রিপার নামের ১৮৮৮ সালের সিরিয়াল কিলারের আমল থেকে। এখানে বানিজ্য করতে আসা বেনিয়ারা এই রকম ছোট ছোট রুম নিয়ে রাতে থাকতেন আর সকালে বহুজাতিক হকারের পেটিকোট মার্কেট থেকে কম দামে জিনিস খরিদ করতেন। এত পুরানো দালান বলেই তার ফাঁক ফোকড়ে তাদের বাসা করতে সুবিধা। প্রায়ই ঘুম ভাঙলে বুঝি কার্ণিশে কবুতরদের কনফারেন্স চলছে। হয়তো দিনে মার্কেটের ফুড কোর্ট থেকে ঠোঁটে করে আনা কীট কিংবা খাদ্যকনা ঘিরেই তা চলছে। একদিন দেখেছি পিজি টিপস চায়ের ব্যাগ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খাচ্ছে খয়েরী চা পাতা।আহারে জালালী কইতর কিন ব্রীজ আর শাহজালালের মোকাম ছেড়ে তোরাও আমার মত কষ্টা চা খাস!
বাঁ থেকে শাচৌ, শামসুর রাহমান, আজাদ, আহমেদ হুমায়ুন, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ও আমি।
মনে হয়েছিলো কার্ণিশ কেটে বুকের ভেতর কবুতর ঢুকে পড়েছে। আর ঘরে থাকা যায় না। কুট কুট করে এ রাত প্রভাত হয়ে যাবে। কী আছে জীবনে, যা মনে লয় করো শামীম! তুমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুসুম। এ বেলাই রোদ থাকতে থাকতে তোমার লেপ তোষক শুকোও। তাই হুট করেই হাঁটতে হাঁটতে মনুমেন্ট ব্রীজের কাছে চলে গেছিলাম। দেখি রাত ক্ষয়ে যাচ্ছে, কমলাকান্ত সিরাপ ডোবা ট্স্টসে সূর্য উঠবে উঠবে করছে। আশ্চর্য, এভাবে হাওয়ার হাত ঠেলে বেরিয়ে না এলে আমার ফ্ল্যাটের কোমরের কাছেই যে এ ব্রীজ, জানতেই পারতাম না।
আমারতো নদী দেখলেই প্রানে নাচ লাগে আর ঊষা দেখলেই জাগে ঊপাসনা।মনে হয় টেমস জলে বিছিয়ে দিই জায়নামাজ আর সূর্যের চরণে সেজদায় পড়ে সুকান্তের মত বলি,
হে সূর্য! শীতের সূর্য!
হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়…
তুমি আমাদের উত্তাপ দিও।
হঠাত দেখি, ওম্মা একি! ভ্যানগ্যগের ছবি হয়ে টাওয়ার ব্রীজের ট্যাসেলে ঝুলছে ভোলাভালা এক নতুন ভোর। তার পেছনে একরাশ হুলিগান মেঘের হাঙ্গামা। ব্রীজের কংক্রিটে হেলান দিতে না দিতেই টেমস বেয়ে শীতের হিলহিলে আঙ্গুলগুলো উঠে এলো চুলে বিলি কাটতে। আর সে হিমেল ও হিপ্নোটিক ম্যাসাজ এমনই ম্যাজম্যারাইজিং যে তা আমার কেশ ছাড়িয়ে দেহখন্ডের শেষ রোমগোড়ার উষ্ণতাও নিয়ে নিল। হাড়ের গিটগুলো হড়হড়িয়ে সরে গেল, পেশীর কোষগুলো স্পঞ্জের মত শীত চুষতে থাকলো। হায় শীত, শক্ত প্রাণের শীত। জানুয়ারীর প্রথম প্রভাতে তুমি আর মেরো নাকো।
বাংলাদেশেও নাকি এখন ভালই শীত প্রভাত হয়। কেউ কেউ হিটারও চালায়। ঢাকায় শীত একটা মধুর ওম দেয়। সে ওম মচমচে, ক্রিস্পি। দস্তানা, কোট লাগে না। বাবুর হাটের ডোরাকাটা শাল, রমনা মার্কেটের একটি রঙিন কার্ডিগান আর ছেলেদের জন্য বাবু মার্কা ব্লেজার হলেই চলে যায়। তবে সিলেটের শীত জাম্পেশ। দেশে থাকতে মনে মনে বলতাম, শীত আয়রেবা সিলেটর লাখান। জমাইয়া এক বালতি চা খাইতাম। আমরা আসলে এক বালতি চা খেতাম আমাদের বিচিত্রার নিউইয়ার্স পার্টি শেষে পরের বছরের প্রথম শীতে অন্ধকারে।
অনামিকা,ডানা, নীনা, দীনা (চেয়ারে ও পাশে ছোট্ট সাশা), আমি, সেলিনা ও মিমি
বছরের শেষ দিনে বারোটা বাজলে শাচৌ (শাহাদত চৌধুরী)র হাটখোলার প্রাচীন বাড়িটির সামনের ঘাসে আগুন জ্বালতাম। সে আগুনে গত বছরের বিচিত্রা পুড়াতাম। গাইতাম আগুন জ্বালো… আগুন জ্বালো…। পেছনে সামিয়ানার নিচে গুটাতে থাকা বার্বাকূ’র চুলো থেকে আসতো পোড়া মাংসের সুগন্ধ। ঘন্টা খানেক আগেই আমি আর সেলিনা পাল্লা দিয়ে নেচেছি। আমি তো এক পর্যায়ে হিল ছুড়ে ফেলেই নাচছিলাম। সে সময় জাহানারা খালাকেও (শহীদ জননী) শাচৌ হাতে ধরে নিয়ে এসেছেন দিতে এক চক্কর। তিনি ফ্লোরে পদ্মফুল ফোটাতে ফোটাতে আমার খালি পায়ে নাচ দেশে মিষ্টি হাসলেন। আমি ছুঁড়ে ফেলেছি সোনালী পেন্সিল হীল।
এরপর আমি রাহমান ভাই (শামসুর রাহমান), সেন্টু ভাই (আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ), হুমায়ুন ভাই (আহমেদ হুমায়ুন) ও আজাদ যেখানে শাচৌর গল্পে মেতেছে তাতেও ঢুঁ মেরেছি। সে যতদিন বিচিত্রায় ছিলাম। কোনবার সেলিনা আর আমি আসর ছেড়ে এসে আগুন জ্বালো্র দলে এসে গেছি। পাশেই নায়লা- বাদল। হাটখোলার গলি থেকে শেষ অতিথীর গাড়ির শব্দ মিলিয়ে গেলে বিচিত্রা পরিবার ও ফ্রেন্ডস অব বিচিত্রা গরম কাপ নিয়ে গোল হয়ে পুরানো বিচিত্রা্র আগুনে হাত সেঁকেছি। জানুয়ারীর পিওর বাতাস কাগজের আগুন রঙ কালো করে উড়িয়ে নিয়ে যেতো নারানগঞ্জের দিকে।
এসব ভাবতে ভাবতে জানি না কখন বিলেতের তীব্র শীতে সূর্যদয়ের আগেই ব্রীজের উপর হয়ে যাচ্চিলাম এ্যা ডেড পিস অফ মিট। এক হিমেল কোল্ড স্টোরেজ। কারন তুষার পাত শুরু হয়েছে। তো একটু তুষার হলেও না হয় হতো। চোখের সুখে গায়ের অ-সুখ ঝটকা মারতাম। তা না দেখি আমার দস্তানাহীন খয়েরী খালি হাতের উপর বসে যাচ্ছে স্বচ্ছ এক প্লাস্টিক পরত। বুঝলাম এক্ষুনি একটা গরম ক্যাফে বা কফিনে না ঢুকলেই নয়। এখন চা চাই , এক বালতি চা।
করেছি কি! তাড়াহুড়োতে বুটতো নয়ই মোজাও পরে আসিনি। জুতোগুলো লাগতে লাগলো যেন গ্লেসিয়ারে ধাক্কা লাগা লোহাবাহী জাহাজ। ঐ জাহাজ নিয়ে ভাসতে ভাসতে বুঝি নাকের ডগার মালিকানা চলে যাচ্ছে। শুধু তার সুরঙই ভরসা। কেবল ঘ্রাণের ঘড়িতেই আমার মৃতদেহ করছে টিক্ টক্ টিক্ টক্। চোখের পাপড়িতে পড়ছে চিনির মত স্লিট। কুয়াশা কাটিয়ে কোনমতে যখন এক জাপানী ক্যাফতে প্রবেশ করলাম তখন অর্ডার দিতে গিয়ে দেখি শামীম পাখি আর ঠোঁট খোলে না। সব জমাট বরফ। সুদর্শন জাপানী ছেলেটি পেছনের দেয়াল মেন্যূতে যা দেখালো মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ছেলেটি এক গরম মৃন্ময়ী ভান্ডে এনে দিলো সুগন্ধী ধোঁয়া ওঠা গ্রীন টি। স্বয়ংক্রিয় ভাবে দুই করতলে টিপটকে এমন জড়িয়ে ধরলাম যেন শীতার্ত রাতের উষ্ণ প্রেমিক। তারপর তাতেই চুম্বন দিতে লাগলাম বাক্যবিহীণ।আমার ঠোঁট ফিরে এলো অবয়ব বাড়িতে। ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিল- আর কিছু চাই কি? আমি মুখ তুলে দেখি ওম্মা! এই চূড়ান্ত শীতেও ওর গায়ে চানাচুরের মত খালি একটি টি শার্ট। বুঝলাম ওর দেহে আছে যৌবনের কোট। আহা, আমার সে কোট বাংলাদেশের সাপ্তাহিক বিচিত্রায় হারিয়ে এসেছি। এখন সে স্মৃতিই শীতদেশে আমার যৌবন, আমার মিঙ্ক কোট।
কিন্তু তাতে কাল বাবাজির যেন কিছু যায় আসে না। কোভিডে কোভিডে যে পৃথিবীর এ বেহাল দশা তাতে তার কোন বিকার নেই। ২০২২ ধেই ধেই করে এগিয়ে আসছেই।
শামীম আজাদ
লন্ডন