পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসোতে কথা হচ্ছিল ইউক্রেন থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসা চাঁদপুরের যুবক মাহমুদুল হাসান দোলনের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন কিভাবে ১৫ দিন মারিওপুলে আটকে থেকে তারপর বেঁচে আসেন পোল্যান্ডে। অভিজ্ঞতা বলছিলেন আর শিউরে উঠেছিলেন বারবার। খাবার, গোসল ছাড়া ১৪ দিন ছিলেন একটি বহুতল ভবনের বেজমেন্টে। ১৪ দিন পর যখন বের হয়ে পোল্যান্ডের উদ্দেশ্য রওনা দেন তখন দেখেন পুরো মারিওপুল শহরই ধ্বংসস্তুপ।
সেই ভয়াবহ জীবনে তিনি একমাত্র আশার আলো পেয়েছিলেন পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেনের কাছ থেকে।দোলন বলছিলেন, ১৪ দিনে অন্ধকার জীবনে মোবাইলের চার্জ বাঁচানোর জন্য শুধুমাত্র পোল্যান্ডে বসবাসরত বোন জামাই মাসুদুর রহমান তুহিন আর রাষ্ট্রদূত ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলেছি। ম্যাডাম বারবার অভয় দিয়েছেন যেভাবেই হোক জীবিত উদ্ধার করবেন। উনার সঙ্গে প্রতিদিন কথা বললে মনো হতো বড় আপার সঙ্গে কথা বলছি।
এরকম প্রায় ৮০০ আটকে পরা বাংলাদেশি উদ্ধারের গল্প শুনছিলাম পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেনের কাছে। বাংলাদেশ মিশনের অসাধারণ কর্মদক্ষতার কারণে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আটকে পড়া বাংলাদেশিদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে উদ্ধার করে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। এজন্য পোল্যান্ডের বাংলাদেশিদের মুখে রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন ও দূতাবাস কর্মকর্তা কাউন্সেলার (স্থানীয়) অনির্বান নিয়োগীর জয়জয়কার।
সুলতানা লায়লা হোসেনের এর আগে লিবিয়া যুদ্ধের সময় বাংলাদেশিদের উদ্ধারের অভিজ্ঞতা ছিল। তাই ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার ১ মাস আগে তিনি এক ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। পোল্যান্ড সরকারের সঙ্গে বেশ কিছু অফিসিয়াল যোগাযোগে তিনি আসন্ন সংকটে কি কি ধরনের সহযোগিতা পোল্যান্ড সরকারের লাগবে সেটা নিশ্চিত করেন। তারমধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশি নাগরিকদের যেনো করিডোর দেয়া হয়।
সুলতানা লায়লা হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি একই সঙ্গে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পোল্যান্ড সরকারের কাছেই প্রয়োজনীয় সাহায্যের বিষয়ে জানিয়ে রাখি। সেইসঙ্গে অন্তত এক মাস আগেই দূতাবাসের একটি নাম্বারে হোয়াটসআপ এক্টিভ করে সেখানে ইউক্রেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের যুক্ত হতে বলা হয়। প্রথম ২/৩ দিনেই ২৫৬ জনের লিমিট হয়ে যায়, তারপর আরও দুটি গ্রুপ করে প্রায় ৭০০ জনকে নিয়ে আসা হয় দূতাবাসের যোগাযোগের আওতায়।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের দিনই আমি এক ধরনের একটি মৌখিক আশ্বাস পোল্যান্ড সরকারের কাছ থেকে পাই যেসব বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে আসবে তাদেরকে তারা ঢুকতে দিবে। কিন্তু আমি লিখিত অনুমতির জন্য চাপ তৈরি করি। এক পর্যায়ে রাতে সেটা পাওয়া যায়।
মধ্যরাতে যখন খবর পাই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, তাৎক্ষণিকভাবে দূতাবাস কর্মকর্তা অনির্বান নিয়োগীকে ঘুম থেকে তুলেই একটি তাৎক্ষণিক টিম তৈরি করে ফেলি। যেহেতু দূতাবাসে কর্মীর সংখ্যা কম তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দিয়েও একটি স্বেচ্ছাসেবী টিম তৈরি করা হয়।
দূতাবাস কর্মকর্তা অনির্বাণ নিয়োগী বলেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি আমরা ইউক্রেন বর্ডারে চলে যাই। সবচেয়ে কঠিন ছিল প্রথম ২ দিন, লিখিত অনুমতি থাকার পরও বর্ডারের কর্মকর্তারা বারবার আমাদের চেক করছিল। সঠিক পাসপোর্ট কিনা, ট্রাভেল ডকুমেন্ট সঠিক কি না। এখানে বড় সমস্যা হয়, ইউক্রেন অংশে আমাদের প্রবেশ অনুমতি ছিল না। আমরা পোল্যান্ড অংশে বসে যাদের ট্রাভেল ডকুমেন্ট প্রয়োজন সেটা তৈরি করে ছবি তুলে পাঠাতাম, সেটা দেখে আবার বর্ডার গার্ড আমাদের ওইখান থেকে ফোন করতো, তারপর আমরা এখান থেকে নিশ্চয়তা দেয়ার পর তাদের ছাড় দেয়া হয়। প্রথম ২/৩ দিনের পর বিষয়টা সহজ হয়। তখন মাইনাস তাপমাত্রা, মাঝেমধ্যে তুষার পড়ছে। এরই মধ্যে অনির্বান নিয়োগী সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত হাতে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্লেকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
সুলতানা লায়লা বলছিলেন, এরপর এই উদ্ধার করা বাংলাদেশিদের অনেককে রাজধানী ওয়ারসোতে এনে হোস্টেলে রাখা হয়, প্রতিদিনের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
ওয়ারসোর স্থানীয় ব্যবসায়ী তিসু মজুমদার বলেন, যেভাবে বর্তমান রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা আপা আটকে পড়া বাংলাদেশীদের উদ্ধারে কাজ করছেন সেটা একেবারেই বড় বোনের মায়ায় করেছেন। আমরা তাই উনাকে আপাই ডাকি।