বান্দরবানে কয়েক বছর ধরে কিছুু অসাধু চক্র নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংসে মেতে উঠেছে। প্রতিনিয়ত ঝিরি-ঝরনা থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন আর বনজঙ্গল উজাড়সহ নানা রকম প্রতিকূল পরিবেশের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য। এতে বিপাকে পড়েছে এ অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী।
জানা গেছে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে আমিষের চাহিদা মেটাতে শামুক-ঝিনুক ও বিভিন্ন পোকামাকড় খায়। এটি তাদের জনপ্রিয় খাবার হিসেবে প্রায় প্রতিদিনই খেত। দুর্গম পাহাড়ে আদিকাল থেকেই বিভিন্ন ঝিরি-ঝরনা ও পাহাড় ডিঙিয়ে আহরণ ছিল তাদের মূল পেশা। এখান থেকে জীবিকা নির্বাহ করত তারা।
বর্তমানে সেই ঝিরি-ঝরনায় পাথর কমে যাওয়ায় পানি উৎসের স্তর কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন আর নাব্য-সংকটের কারণে বিপন্ন হচ্ছে কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক, বিভিন্ন পোকামাকড় আর কয়েক প্রজাতির মাছ ও প্রাকৃতিক শাকসবজি।
দুর্গম অঞ্চলে বসবাসরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড়ি জনগণ তাদের খাদ্যের জোগান করত ঝিরি-ঝরনা থেকে। বর্তমানে কিছু অসাধু চক্র পাহাড়ের জায়গা দখল করে বনজঙ্গল উজাড় আর খাল ও ঝিরি-ঝরনা থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন করছে । পানির উৎসকে ধরে রাখে পাথর আর পাথরের নিচে বসবাস করে বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়। নির্বিচারে এসব ধ্বংসের কারণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের খাদ্যাভ্যাস বিলুপ্তির পথে। অচিরেই এসব বন্ধ না করলে ভবিষ্যতে খাদ্য-সংকটের পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে যাবে।
প্রকৃতিপ্রেমী বান্দরবান বীর বাহাদুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা ডচিংপ্রু বলেন, আমাদের (ক্ষুদ্র্র নৃগোষ্ঠী) নিত্যদিনের খাদ্যের তালিকার মধ্যে রয়েছে কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক, বিভিন্ন পোকামাকড় আর শাকসবজি। কিন্তু বর্তমানে প্রকৃতি থেকে উৎসারিত এসব জিনিস (খাদ্য) হারিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে বিবর্তনপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে আসছে। কিছু অর্থলোভী ব্যক্তির দ্বারা সেই প্রকৃতি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। শত শত বছরের গাছ আর পাথর হারিয়ে যেতে বসেছে পাহাড়ে। এভাবে চলতে থাকলে বান্দরবানের প্রাকৃতিক লীলাভূমির অস্তিত্ব আর থাকবে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন বান্দরবান চ্যাপ্টারের সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই বলেন, সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝিরি-ঝরনা ও নদ-নদী পানিশূন্য হওয়ার কারণ মনে করলেও মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যাগুলো এর অন্যতম কারণ।
তিনি আরও বলেন, পাথরকে ‘পাহাড়ের প্রাণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও গাছকে সঞ্চালনকারী হিসেবে আখ্যা করা হয়। প্রচলিত আছে, ভূগর্ভস্থা পানির স্তর থেকে সর্বনিম্ন ১০০ ফুট গভীর পর্যন্ত পানি শোষণের ক্ষমতা রাখে পাথর। গাছের মূল সেই পানিকে নিজে শোষণের পাশাপাশি মাটির বিভিন্ন স্তরে সঞ্চার করে। প্রাণ (পাথর)-সঞ্চালন (গাছ) না থাকলে নির্জীব মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
উন্নয়নের নামে অবাধে পাথর উত্তোলন, জোত পারমিটের নামে বৃক্ষনিধন ইত্যাদি ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে পাহাড়ে জীববৈচিতত্র্য হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান তিনি। বান্দরবান সংবাদদাতা