আপনার কি মন কান্দে? জানি, হঠাৎ চমকে উঠে বলবেন, এ কেমন প্রশ্ন? পরক্ষণেই হয়তো বলবেন, মনতো কাঁদেই কিন্তু এ প্রশ্ন করে কান্না আরো বাড়াচ্ছেন কেনো? এ দুনিয়ায় জানতে চাওয়ার মতো বিষয়ের কি অভাব আছে? এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নয়, অন্য কোন প্রশ্ন করুন কারন এ রকম প্রশ্ন করলে যে মনের কান্না চোখে এসে যায়। আসলে এটাই হলো আসল কথা, মনের কোনে লুকিয়ে থাকা কান্না চোখে এসে দৃশ্যমান হয়ে যায়। এমন কোন মন কি আছে যাতে লুকিয়ে নেই কোন কান্না? আমরা হলফ করে বলতে পারি, নেই, এমন কোন মন নেই যেখানে কান্না নামক বালিকাটি নিঃশব্দে পড়ে নেই, সব মনেই আছে।
জিগ্যেশ করলাম এক সিনিয়ার ভাইকে, “বড় ভাই, একটা জিনিস জানতে চাই, আপনার মনে কোন কান্নাকি লুকানো আছে?” তিনি চমকে উঠলেন, উত্তর দিলেন, “আছেতো অবশ্যই কিন্তু এ জাতীয় প্রশ্ন কেনো?” যখন জানালাম যে, এ বিষয়ের উপর লিখবো, তাই জানতে চাচ্ছি, তখন তিনি বললেন, “আছে, বলছি তবে লেখার মধ্যে আমার নাম দেবেননা, ব্রাদার।” নাম না দেয়ার প্রতিজ্ঞা করার পর তিনি বললেন, “আমার মা হঠাৎ খুব অসুস্হ হয়ে পড়েছিলেন, আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন কিন্তু পথভাড়া সংগ্রহ করতে না পারায় গ্রামের বাড়ি যেতে পারিনি। যখন গেলাম তখন ওনার দেহে প্রাণ নেই। আমি কয়েকবার ওনার বুকে কান রেখে শুনতে চাইলাম শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ, যদিও আমি জানতাম তিনি নেই। এই কান্না আমার মনে সব সময়ই লুকিয়ে থাকে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠি ছিলো, এমন এক বন্ধুকে প্রশ্নটি করলে সে উত্তর দিলো, “মানুষের মনে কান্না না থেকে কি পারে! কান্না নামক বিষয়টি লুকিয়ে থাকার জন্য মনইতো সবচেয়ে নিরাপদ স্হান।” ওর মনে লুকানো কান্না সম্পর্কে জানতে চাইলে তার পিতার কথা বললো। “আব্বার শরীর হঠাৎ কেনো যেনো অবশ হয়ে গেলো! ডাক্তার সাহেবেরা কোন কারন খুঁজে পাচ্ছেননা। ঐ অবস্হায় তিনি সম্পূর্ণভাবে আশা ছেড়ে দিলেন। কিছুদিন এভাবে পড়ে থাকার পর তিনি আরো অস্হির হয়ে পড়লেন। আমার কথা তুলে বললেন, ও বুঝি আমাকে দেখতে আসার সময়টুকুও পায়না! অনেক সীমাবদ্ধতা ডিংগিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন তিনি নিষ্প্রাণ। আব্বার চোখের দিকে আমি পুরা জীবনে কখনো তাকাইনি। দেখলাম, মনে হলো তিনি চোখ বন্ধ করে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। অবয়ব চকচক করছে কেমন এক অপার্থিব আলোয়। ভয়ে ভয়ে কপালে একটু হাত রাখলাম। কবর দেয়ার সময় কবরে নামার সাহস হয়নি আমার। ওর বুঝি আমাকে দেখতে আসার মতো সময়টুকুও হয়না– এই কথাটি আমার মনে সদা থাকে লুকিয়ে আর মাঝে মাঝে আমার অস্তিত্ত্বকে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে।
বয়সে আমার চেয়ে বড় যাঁরা ওনাদের সাথে কথা বলতে আমি ছিলাম সদা সংকুচিত। এক চাচা, বয়স আমার চেয়ে অল্প কয়েক বছর বেশি, ওনার মিশুক প্রকৃতির কারনে আমার সাথে সম্পর্ক ছিলো ভালো। তিনি আমার পিতার আপন ভাই নন, চাচাতো ভাই। মনের কোনে লুকায়িত কান্নার কথা জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিলেন, “বাবারে, চাপা পড়া লুকায়িত কান্না মানুষের মন-ব্যাংকেইতো জমা থাকে।” ওনার কান্নাটা সম্পর্কে জানতে চাইলে বললেন, “তুইতো জানিস আমার ছোট ভাই সম্পর্কে। ও যখন বিদেশে ছিলো তখন এক সময় সে এক বছরেরও বেশি সময় অসুস্হ এবং নিখোঁজ ছিলো। এমন কোন ওয়াক্ত ছিলোনা যখন তার জন্য আমরা বিধাতার দরবারে আবেদন করিনি। প্রত্যেক প্রার্থনার সময় হাত তুলেছি তার জন্য। আর এখন সে কি করে, জানিস? আমাদের জমিজমা নিয়ে সে যা করছে তা অহরহ আমাকে কষ্ট দেয়। মানুষ আমার কাছে কত কিছু জানতে চায়, আমি কিছুই জানাইনা। এগুলো বলতে গেলে নিজেইতো ছোট হয়ে যাই। কিন্তু মনোযন্ত্রণা সয়ে বেড়ানোও অনেক কঠিন।
আমার এক বছরের জুনিয়ার, এলাকার এক ভাই, কলেজের প্রফেসার, জানতে চাইলাম তার মনের কোনে লুকোনো ব্যথার কথা। ও বললো, মাইন ভাই, এমন এক কথা জিগ্যেশ করলেন যে, বলতেও সংকোচ লাগে, না বলেও পারা যায়না। আমি যখন ইন্টারে পড়ি তখন এক স্কুল ছাত্রীর সাথে আমার গভীর পরিচয় হয়। এরপর চলে গেলো কুড়িটা বছর। জানিনা আছে কোথায়। এখনো স্বপ্নে দেখি, ও তার দুটো ভিন্ন বয়েসী শিশু সন্তানকে পাশে বসিয়ে ভাত-তরকারী রাধছে। আহারে, মনে হয় যেনো একেবারে বাস্তব। দেয়ালের উপর দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি। ঘুম ভেংগে গেলে মনটা হাহাকার করে ওঠে। কান্নাগুলো কষ্ট হয়ে মনের ভেতর লুকিয়ে যায় আর আমি হয়ে পড়ি বিষন্ন। এসব কষ্টের কথা বলাওতো যায়না!
নিউ ইয়র্কে বসবাসকারী এক বন্ধুর কাছে তার কষ্টের কথা সম্পর্কে জানতে চাইলাম, তিনি জানালেন, দেশে থাকা ছেলেমেয়েদের জন্য ওনার মন কাঁদে। বিশেষ করে একটি ছেলের জন্য মন কাঁদে বেশি যে আসলে একটি শিশু, কৈশোরে এখনো পা দেয়নি। জন্মের পর থেকে ওনার কোলে পিঠে বড় হওয়া ছেলেটি আসলে ওনার ছোট ভাইয়ের ছেলে। ওনাকে বড় আব্বা বলে ডাকে। প্রত্যেক দিন দুজনে হাটতে বেরুতো অথবা রিক্সায় বেড়াতো কিন্তু তিনি আমেরিকা চলে আসার পর ছোট্ট এই ছেলেটির সাথে একমাত্র মেসেঞ্জারেই যোগাযোগ হয়। এখন সে কৈশোরে পদার্পন করবে করবে অবস্হা। এক বছর আগেও মেসেঞ্জারে বলতো, “বড় আব্বা, করোনা কমেছে, প্লেন চলে, তুমি চলে আসো, আমি তোমার সাথে আমেরিকা চলে যাবো।” ইদানীং সে বড় আব্বার ফোন না ধরার অর্থাৎ এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। এই দূরত্ত্বটা সে বহন করতে পারেনা। এই ভদ্রলোকও এই দূরত্ত্ব সহজ ভাবে নিতে পারছেননা, যেতেও পারছেননা। কষ্টটা লুকিয়ে রাখেন মনের কোনে। তিনি বলেন, এটাকে মনের কোনে কান্না লুকিয়ে রাখা না বলে কষ্ট লুকিয়ে রাখা বলতে পারেন। আমি বললাম, কষ্ট যখন হয় অনুভূতির প্রক্রিয়ায় রান্না, তখনই এটা হয়ে যায় কান্না। আমার কথা শুনে তিনি মৃদু হাসলেন যখন অবয়বে আনন্দের চেয়ে বেদনাই প্রকাশ পেয়েছে বেশি।