ক্ষত
আইরিন রহমান
মাঝরাতে কিংকিং শব্দে টেলিফোনটা বেজে উঠায় লাবণ্য সদ্য ঘুম লাগা চোখ মেলে বিরক্তির সাথে ঘমের ঘোরেই ফোন রিসিভ করে চমকেউঠে .. ওপাশ থেকে কে যেন ফিসফিস করে বলে ওঠে মামনী আমার কেমন আছিস তুই লাবন্য ? তুই ভাল আছিস তো ? লাবণ্যখুব ঠান্ডা গলায় বলে উঠে কে ? কে আপনি ? কাকে চাচ্ছিলেন ? সে কিরে আমাকে চিনছিস নাহ বাবু ! বাবা আমি তোর বাবা ।কি আশ্চর্য তুই আমাকে চিনতে পারছিস নাহ ? লাবণ্য বলে উঠে আপনি রং নাম্বারে ডায়েল করেছেন আমার বাবা বছর খানেকআগেই মারা গেছেন । দয়া করে মাঝরাতে যাকে তাকে ফোন করে বিরক্ত করবেন নাহ । বলেই ঠাস করে ফোনটা কেটে দেয় ।বাড়ীরফোনের তারটা টান দিয়ে খুলে ফেলে । মোবাইল ফোনটা নিয়ে সুইচ অফ করে দিতে না দিতেই মা এসে দাঁড়ায় বলে কিরেএতো রাতে কার সাথে কথা বলছিলি? বলে কেউ না রং নাম্বার কে যেনো ফোন দিয়ে বিরক্ত করছে । যাও তুমি শুয়ে পরো অনেকরাত হয়েছে মা ।মা গুটি গুটি পায়ে চলে গেলে লাবণ্যের মনে পড়ে তার বাবার কথা , পুরানো সেইসব দিনের কথা । বাবা …. ! আহা কতদিন বাবাকে আর বাবা বলে ডাকতে হয়না । আর কোনো দিন বাবা ডাকটা ডাকা হবেও নাহ । সবই নিয়তির খেলা।বাবাকে হারানোর দিনটা ছিলো তাদের পুরো পরিবারটাকে তছনছ করে ফেলবার দিন ।স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি বাবাকে এভাবেঅকালে হারাতে হবে । বাবাকে হারিয়ে লাবণের কাঁধে এখন কঠিন দ্বায়িত্ব ছোট ভাইটার পড়াশুনা আর পিঠাপিঠি ভাই বল্টুরজন্য একটা ভালো মেয়ে পেলে বিয়ে দিয়ে বল্টুর একটা গতি করে দেবার স্বপ্ন দেখে লাবন্য।ছেলেবেলা থেকেই লাবন্য খুবই মেধাবীছাত্রী ছিল অল্প বয়সেই সে ডাক্তারি পাস করে সবে মাএ একটা নামকড়া একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকরি পেয়েছিল কিন্তু ,তারমধ্যেই বাবাকে হারিয়ে গোটা সংসারের দ্বায়িত্ব তার ঘাড়ে এসে পরে ।বড়লোকবাবার একমাএ কন্যা হবার জন্য ছোট থেকেইবিলাসবহূল জীবনে অভ্যস্ত থাকার কারণে যে মেয়ে খুবই অহংকারী ছিল সেই মেয়েটাই এখন সামান্য কটা টাকা দিয়ে মারচিকিৎসা ভাইয়েদের পড়ার খরচ জোগাতে হাপিয়ে উঠতে উঠতে মনে করে বাবা সাথে তাদের বিলাসবহুল চাকচিক্যে ভরপুরসোনালিদিনগুলির কথা ।আহা কি সুন্দরই নাহ কাটছিল তাদের দিনগুলো । ছোটবেলা থেকেই লাবণ্য তার বাবার ভক্ত মারসাথে খিটমিট লেগেই থাকত বাবাই ছিল বরাবর তার সবচাইতে কাছের বন্ধু । বাবা মেয়ে সারাক্ষন খুনসুটিতে মেতে থাকত । বাবালাবন্যকে ছাড়া যেন কিছুই বুঝতেন না ।সারাক্ষণ বাবা মেয়ে ছায়ার মত একসাথে থাকত । তারমধ্যেই মা আচমকা অসুস্থ হয়েপড়ায় তাদের মাকে দেখভাল করার জন্য একজন নাস রাখতে হয় , যাকে মা তার ছোট বোনের মত আদর করতেন একদিনহঠাৎ সেই শিউলি খালাকেই বাবা কিভাবে যেন বিয়ে করে বসেন ! শুধু তাই নয় বিয়ে করে তাদের সবকিছু থেকে বন্চিত করে বাড়ীথেকে বের করে দেন । বাবার শেষ কথা ছিলো আজ থেকে তাদের সাথে তার আর কোন সম্পকই নেই। অনেক কেঁদে ছিল সেদিনতিনভাই বোন আর তাদের মা । মা হাতজোড় করে সুযোগ চেয়েছিল শেষবারের মতো তার সংসারটা টিকিয়ে রাখতে বাবাকেঅনুরোধ করেছিল । কিন্তু বাবা ছিলেন অণঢ় সেই এক কথা মায়ের সাথে তার আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না ।তাই তার দ্বিতীয় বিয়ে।সেইটাই ছিল শেষবারের মতন লাবন্যের বাবাকে দেখা ! বিয়ের প্রথম কয়েকবছর বাবা আর শেফালীখালার সংসারটা ছিল খুবছিমছাম আর ভালবাসায় ভরপুর , কিন্তু বিয়ের বছর দেড়েক ঘুড়তে না ঘুড়তেই নাকি শেফালীখালার সাথে বাবার সম্পর্কেরঅবনতি ঘটতে শুরু করে।একদিন বাবার এক ছোট বোন তাদের মিতিলাফুপি মাকে রসিয়ে রসিয়ে তাদের বাড়ীতে এসে এখবরদিচ্ছিল ।দরজায় আড়ি পেতে কিছুটা শুনে ফেলে লাবণ্যের কেমন যেন দলাপাকিয়ে বমি আসে আর খুব রুচিতে বাঁধে, তাই তোআর সহ্য করতে না পেরে সেইদিন মিতিলাফুপুকে আর কোনদিন এসমস্ত খবর নিয়ে তাদের বাড়ি না আসার কথা বলে, একপ্রকার জোর করে চলে যেতে বলেছিল।রাগে মিতুলাফুপু ঝাঁঝলো কন্ঠে লাবণ্যকে কিছু কথা শুনিয়ে বিদায় নিয়েছিল। বাবারএহেন দুঃসংবাদ শুনে মায়ের তো একটু হলেও সস্তি পাওয়ার কথা ছিল , যে নিয়তি তার বদলা ঠিকই নিয়েছে কিন্তু সহজ সরলমমতায় ভরা লাবণ্যের মা সেই কথা শুনে সেদিন ভেউ ভেউ করে কেঁদেকেটে একাকার করেছিলেন । সে রাতে মা পানি টুকুওস্পশকরেনি ,সেদিন লাবণ্য বুঝে উঠেছিল এতো কিছুর পরেও বাবার জন্য তার মায়ের মনের গভীর কোনে এখনো বোধহয় কিছুটা মায়াআর ভালোবাসা রয়েই গেছে । লাবণ্যের প্রচন্ড রাগ হয় মা কে দেখে ।একটা মানুষ এতো কোনো নিলিপ্ত হবে , এতো অপমান, ভৎসনা আর কস্ট দিবার পরও কোনো সেই লোকটার প্রতি আবারও মায়া হবে ? লাবণ্য তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা । তাইতো যতোটা সম্ভব আজকাল মাকে সে এড়িয়ে চলে ।কথা খুব কম বলে পাছে মা বাবার কোনো কথা বলে বসে সেই ভয়ে ।ঢং ঢংকরে দেয়াল ঘড়িটা জানান দিয়ে দিল রাত ২টা বেজে গেছে । লম্বা একটা দীঘশ্বাস ছেড়ে চোখ দিয়ে গড় গড় করে গড়িয়ে পরাদীঘদিনের অপমান আর প্রচন্ড কস্টের অশ্রুধারা মুছে, বুকের মধ্যে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষতটাকে সংগোপনে আবারও মনেরকোনে জমা রেখে আয়নার দিকে তাকায় , আর ভাবে কিছু ক্ষত কখনই সাড়বার নয় ! তারপর নিজেই নিজেকে বলে তোমারবাবা তো কয়েকবছর আগেই মারা গিয়েছেন , তার জন্য আর কত কস্ট পাবে লাবণ্য ! তোমার হাতে এখন অনেক কাজ সেদিকেমন দাও ।তোমায় এখনো অনেক রাস্তা পারি দিতে হবে .. বোকা মেয়ে যাও ওঠো যেয়ে দেখো মা কি করছে ? ঘুমানোর আগে মা ঔষধ খেয়েছে তো ? বাড়ী ফিরে বল্টু কি সদর দরজাটা লাগিয়ে ছিল . … এসব ভাবতে ভাবতে আনমনে লাবণ্য নিজেকে সামলেনিয়ে এগিয়ে চলে !