আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এক সুদীর্ঘ সংগ্রামের সফল পরিনতি। এটি হঠাত করে ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় নয়। ১৯৭১ সালের ৯ মাসের যুূদ্বের মধ্যেও এটাকে সীমাবদ্ধ করা যাবেনা। এরপেছনে রয়েছে বাঙ্গালী জাতির ত্যাগতিতিক্ষার সুপ্রাচীন এক গৌরবময় ইতিহাস। এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এর রয়েছে সুবিশাল ধারাবাহিকতা ; একটি পরম্পরা।
বাঙ্গালী বীরের জাতি, তার রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। আমাদের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস আছে। ১৭৫৭ সালের পলাশী যদ্ধের পর, আমাদের রয়েছে প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই ও সংগ্রামের ইতিহাস। হাজার হাজার মানুষ জেল খেটেছে, দীপান্তর বা কালাপানি খেটেছে, আত্মাহুতি দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, ফাঁশি কাষ্ঠে ঝুলেছে।
এরপর ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তান নামক অদ্ভুত রাষ্ট্রের শাসনশোষনের কথা তো আমাদের সকলেরই জানা। তাই বলা হয়ে থাকে, মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র নয়মাসের গৌরবময় ইতিহাস সৃস্টির পেছনে রয়েছে বাঙালি জাতির পাকিস্তানি আমলের ২৩ বছরের জাতিগত আত্ন নিয়ন্ত্রনাধিকারের জীবনপণ এক রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস।’ কৃষক শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের শোষন মুক্তি ও রুটিরুজির সংগ্রাম। সময়ে সময়ে এবং প্রয়োজনে, বিভিন্ন সময়ে, ছাত্র আন্দোলনের যে ভূমিকা তা আমাদের স্মৃতি পটে এখনও জাগরুক।
একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বহুকাংখিত স্বাধীনতা আমাদের এক বিরাট প্রাপ্তি। কিন্তু স্বাধীন দেশেও হত্যা করা হয়েছে অনেককে। আমরা হারিয়েছি অনেক ত্যাগী নেতা, প্রিয়জন ও সহযোদ্ধা বন্ধুকে। কেউবা শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। কেউ পরবর্তীকালে রোগেশোকে ভুগতে ভুগতে, আবার কেউবা অকস্মাৎ আমাদের চিরতরে ছেড়ে চলে গেছেন। আমাদের কত প্রিয় মুখ এখন আর নেই। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করবার দৃঢ় প্রত্যেয়ে আমরা আজ মিলিত হয়েছি।
কিশোর বয়সে এবং উঠতি যৌবনে, জীবন বাজি রেখে, এদেশকে হানাদার মুক্ত করতে আমরা অস্ত্রহাতে ঝাপিয়ে পড়ে ছিলাম। রঙ্গলাল সেনের “স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়” পংক্তিটি যেন বারবার অনুরণিত হচ্ছিল আমাদের মনের কোণে।
এখন এদেশ হানাদার মুক্ত। কিন্তু সেইসব প্রিয় সহযোদ্ধাদের অনেকেই আর নেই। যারা বেঁচে আছি তারা বয়সের ভারে নুহ্য। কে কখন চলে যায় তার কোন ঠিকঠিকানা নেই।
যার বজ্রকন্ঠের আহ্বানে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও ঘাতকরা হত্যা করে। আজ তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। আমাদের মাঝে নেই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, কমরেড মনিসিংহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সসস্র অংশগ্রহণের স্মৃতিচিহ্ন অনেক। তন্মধ্যে বীরত্বের, সাহসিকতার ও দেশপ্রেমের স্হায়ী স্বাক্ষী কুমিল্লার বেতিয়ারা। ১১ নবেম্বর ১৯৭১ তারিখে সেখানে আমাদের ৯ জন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা পাকহানাদারের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। ঐদিনের কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন।
প্রতিবছর ১১ নবেম্বর ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর এবং আসেপাশের এলাকা থেকে বেতিয়ারায় মিছিল আসে। ফুলে ফুলে ভরে যায় সহযোদ্ধাদের শহীদ মিনার। তাই এতগুলো বছর পরে আজও ভুলা যায়না বেতিয়ারাকে। ভুলা যায়না আগরতলা, তেজপুর, নেফা এবং বায়কোরা বেসক্যাম্প। ভুলা যায়না কমান্ডারদের। অবশ্য তাদের কেউ কেউ এখন পরপারে।
সত্যি বলতে কি, বিগত ৫০ বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধায় তাদের সকলকেই স্মরণ করছি। সহযোদ্ধাদের স্মরণ করা প্রকারান্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধকেই স্মরণ করা।
আশা করা যায়, আজকের এই স্মৃতিচারণ অনস্ঠানটি একটি দলিল হয়ে থাকবে। আমরা কেউই চিরদিন বেঁচে থাকবোনা। আগামী প্রজন্ম
এই স্মরণসভা থেকে শিক্ষা গ্রহন করবে। তাদের পূর্ব সুরীদের অবিশ্বাস্য সাহস, বীরত্ব এবং আত্নত্যাগের কথা জানতে পারবে। গর্ব ও গৌরবে তাদের বুক ফুলে উঠবে। e