• রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:১২ অপরাহ্ন

ড। সেলিম জাহানের এক সখ্যের আলেখ্য

Reporter Name / ৮০ Time View
Update : শনিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২১

চিত্রপরিচিতি: সঙ্গের ছবিটি ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসে – মানে কবির মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে – দিল্লীতে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিক্ষেত্র রাজঘাটে তোলা। কবি তখন সপরিবারে দিল্লীতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কবির সঙ্গে বাঁদিক থেকে কবি-পত্নী, কবি-কন্যা, কবি-ভ্রাতুষ্পুত্র ও কবি-পুত্র।

 

এক সখ্যের আলেখ্য
(কবি জীবনানন্দ দাশের ৬৭তম প্রয়াণ দিবসে)

ড। সেলিম জাহান 

আমার প্রয়াত পিতা অধ্যাপক সিরাজুল হক ও কবি অধ্যাপক জীবনানন্দ দাশ বরিশাল বি.এম. কলেজে সহকর্মী ছিলেন চল্লিশের দশকে শেষার্ধে। বাবা ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের, জীবনানন্দ দাশ ইংরেজীর। আমার তরুন অকৃতদার পিতা সবে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ঢাকা থেকে বরিশাল গেলেন বি.এম. কলেজে অধ্যাপনার জন্যে, সেই একই জাহাজে তাঁর সতীর্থ বন্ধু শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী যাচ্ছিলেন খুলনা বি.এল. কলেজে অধ্যাপনা করতে। কবি জীবনানন্দ দাশ তার কিছুদিন আগে দ্বিতীয়বারের মতো কোলকাতা থেকে এসে বি.এম. কলেজে যোগদান করেছিলেন।

আমার বাবা ভীষন স্বল্প কথার মানুষ ছিলেন। ঠিক গল্প করার লোক ছিলেন না, গল্প করতেও পারতেন না। অনেকটাই নিভৃতচারী। তাঁর জীবনের গল্পও আমরা বেশীটাই শুনেছি আমার মায়ের কাছে। তাঁর শৈশবের কথা এবং আমার পিতার ছোট বেলার কথা আমি শুনেছি আমার পিতামহী ও আমার পিতার কণিষ্ঠ পিতৃব্যের কাছ থেকে। তাও ছাড়া ছাড়া কুড়িয়ে বাড়িয়ে শোনা। শুনেছি বাবা যখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বি.এ. ক্লাশের ছাত্র, তখন তাঁদের পাঠ্য ছিল Thoms Hardyর The Mayor of Casterbridge. সেটি পড়াতে এলেন সদ্য এম.এ. পরীক্ষা শেষ করা পাবনার জেলা প্রশাসক আবদুল হালিম চৌধুরীর জ্যৈষ্ঠ পুত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তী ছাত্র কবীর চৌধুরী। কিন্তু আমার পিতা যে কেন ফেলী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে পাবনায় বি.এ. পড়তে গেলেন, তা আমরা জানি না।

নিজের কথা বলার ব্যাপারে প্রচন্ড অনীহা ছিল আমার বাবার।  নিজের অধ্যাপনা, পড়া-লেখা, বাড়ী-ঘর নিয়েই থাকতেন ভদ্রলোক। নোয়াখালীর নিজের শেকড়ের প্রতি প্রচন্ড টান ছিল তাঁর। বহুদিন আমরা জানতেই পারি নি যে কবি জীবনানন্দ দাশ আর তিনি দু’বছর বি.এম. কলেজে সহকর্মী ছিলেন। এ কথাটি আমি প্রথম শুনি আমার কৈশোরে বি.এম. কলেজের বহু পুরাতন কর্মী কৈলাশ কাকার কাছে।  ১৯৪০ সাল থেকে কৈলাশ কাকা কলেজে কাজ করতেন। তাঁর মতে, কবি জীবনানন্দ দাশ আর আমার বাবা খুব কম কথা বলার মানুষ ছিলেন বলে, দু’জনের মধ্যে এক ধরনের সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠে। কৈলাশ কাকা বলতেন যে, প্রায়ই যেখানে দেখা যেত যে বি.এম. কলেজের শিক্ষক বিশ্রামাগারের বিশাল সেগুন কাঠের চারদিক ঘিরে অন্যানয শিক্ষকেরা উচ্চস্বরে উত্তপ্ত আলোচনা করছেন, সেখানে কবি জীবনানন্দ দাশ ও আমার বাবা এক কোনায় দু’টো আরামকেদারায় বসে মৃদুস্বরে গল্প করছেন।

ঐ কথার সূত্র ধরেই কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তাঁর জানাশোনার প্রসঙ্গটি জিজ্ঞেস করলে তিনি টুকরো টুকরো করে কিছু কিছু স্মৃতি কথা বলেছিলেন। বয়সে কবি আমার বাবার চেয়ে বেশ বড় ছিলেন। বাবা তাঁকে ‘দাশ বাবু’ বলে ডাকতেন আর তিনি বাবাকে ‘হক সাহেব’ বলতেন। বাবার মুখে শুনেছি কবি জীবননান্দ দাশের ডাক নাম ছিল ‘মিলু’।

বাবা এবং আরও ক’জন তরুন অধ্যাপক তখন থাকতেন ব্রজমোহন কলেজের মূল ভবন ছাড়িয়ে দিগন্ত বিস্তৃত একটি মাঠের মাঝে একটি একতলা হলুদ বাড়ীতে। ঐ বাড়ীটি আমি ষাটের দশকেও দেখেছি। হিন্দু হোষ্টেল ছাড়িয়ে অনেকটা পোড়ো বাড়ীর মতো। সেখান থেকে কোনাকুনিভাবে হেঁটে মুসলিম গোরস্হানের  মাঝ দিয়ে হেঁটে গেলে ‘ধানসিঁড়ি’ ২০ মিনিটের রাস্তা।

মাঝে মাঝে কবি বাবার কাছে ঐ বাড়ীতে আসতেন। সকালে কবি প্রাত:ভ্রমনে বেরুতেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি চলে আসতেন বাবার কাছে চা খেতে। বাবার একটা পুরোনোকালীন পেতলের স্টোভ ছিল। তিনি তাতে চা বানাতেন। দু’কাপ চা নিয়ে দু’জনে বারান্দায় বসতেন। আমার পিতামহী তাঁর পুত্রকে একটি কাঁসার গেলাস দিয়েছিলেন। কবি সেই গেলাসে চা খেতে ভালোবাসতেন। গরম গেলাশটি ধরতেন ধুতির খুঁট দিয়ে। চা খেয়েই উঠে পড়তেন অন্যান্য শিক্ষকদের উঠে পড়ার আগেই। বেশী লোকজনের সান্নিধ্য তিনি পছন্দ করতেন না, ভিড়-বাট্টা এড়িয়ে চলতেন।

সুবেশ হয়েই তিনি বাবার কাছে আসতেন বলে শুনেছি। কিন্তু ঘরে ঢোকার পরে একটা বিপত্তি হতো। বাবাব ঘরে একটি লম্বা মতো গদি আঁটা হাতলবিহীন বেঞ্চি ছিলো। কবি ঘরে ঢুকেই ঐটাতে বসতেন। কিন্তু একবারে কোনায় গিয়ে – বাবা বলতেন যে, মনে হত, তিনি পড়েই যাবেন’। বারবার বলা স্বত্ত্বেও তিনি বেঞ্চির মাঝে বসতেন না, সারা বেঞ্চি খালি থাকলেও। বাড়ীর অন্যান্য অধ্যাপকেরা এটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতেন, কিন্তু কবি নির্বিকার।

বাবা বলতেন, একা থাকলে কলেজের শিক্ষকদের বিশ্রামাগারে একটি কোনায় বসতেন কবি জীবনানন্দ দাশ এক কাপ চা নিয়ে। অন্য অধ্যাপকেরা যখন জমিয়ে গল্প করছেন, তখন কবি কেমন যেন আনমনা হয়ে কি একটা ভাবতেন তন্ময় হয়ে। অনযদের গালগল্পে যেতেন না, এমন কি আমন্ত্রণ জানালেও না। তবে বাবা বলেছেন যে, ‘দাশবাবু হঠাৎ করে হো হো করে জোরে হেসে উঠতেন’। তখন অন্য অধ্যাপকেরা অবাক হলে, কবি কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়তেন।

বড় লাজুক ছিলেন তিনি। অন্য মানুষের সামনে পড়ে গেলে কেমন যেন অস্বস্তি হত তাঁর। নিজেকে নিয়ে থাকলেই সবচেয়ে আরাম বোধ করতেন। বাবা ঠাট্টা করতেন যে, রাস্তার এপারে ওপারে দু’জনে থাকলে দৃষ্টি এড়াতে প্রাণপন চেষ্টা করতেন কবি। ‘কেমন আছেন, দাশবাবু?’ এমন সাধারন প্রশ্ন করলেও কেমন যেন ঘেমে উঠতেন তিনি। নতুন বাজারে দেখা হত দু’জনার কোন কোন সকালে। বাবাকে দেখলেই খুশী হয়ে উঠতেন তিনি, কারন কবি মাছের দর-দাম করতে পারঙ্গম ছিলেন না। তাই চুপিচুপি বাবাকে বলতেন, ‘হক সাহেব, আমাকে একটা মাঝারি মাছ কিনে দিন না?’ এ কথাটা বলার সময়ে বাবার মুখটা, চোখের দৃষ্টিটা, গলার স্বরটা কেমন যেন নরম হয়ে আসতো।

রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে কবির গভীর আগ্রহ ছিল। ভারতীয় নানান দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চিন্তা-চেতনার ওপরে তাঁর ভালো দখল ছিল। বাবার কাছে তিনি পাশ্চাত্যের নানান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে জানতে চাইতেন। রাষ্ট্রচিন্তার বিবর্তন তাঁকে অবাক করতো।ভারত-বিভাজনে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন। সে সময়ে দেশ-বিভাগের টানাপোড়্নে তিনি বিচলিত ছিলেন। তাই তিনি ক্রমাগত: বরিশাল-কোলকাতা করেছেন। তাঁর এই অনিশ্চয়তার কথা তিনি বাবাকে বলেছেন।তাঁর নানান কবিতাতেও এর প্রতিফলন ঘটেছে।

একটা সময়ে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা ও শব্দের প্রতি ঐ সময়ে তাঁর ভীষন কৌতূহল ছিলো। ‘কেন, কে জানে’? বাবা জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পান নি। হয়তো কবিতায় নতুন নতুন আঞ্চলিক শব্দমালা ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, কিংবা কোন কিছু লেখার পরিকল্পনা ছিল নোয়াখালীর পটভূমিতে। তিনি বাবাকে বলেছিলেন যে, ১৯৪৬ সালের নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাঁর চিত্তকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বাবার কাছে ঐ দাঙ্গা সম্পর্কে জানতে চাইতেন। বাবার সঙ্গে এক ধরনের নৈকট্য অনুভব করতেন তিনি। বাবাকে তিনি বলতেন, ‘বরিশাল আর নোয়াখালী সহোদর, মেঘনার এপার-ওপার’।’

একটা সময়ে বাবা সেই অকৃতদার অধ্যাপকদের আস্তানা ছেড়ে উঠে এলেন বৈদ্যপাড়ায় এক বাড়ীতে। হলুদ লাল দালানের হলদে কল্কে ফুলের লতানো সেই অনিন্দ্যসুন্দর বাড়ীটি আমি যৈশবে দেখেছি। ১৯৪৯ সনে আমার বাবা আমার মাকে বিয়ে করে নোয়াখালী থেকে বরিশালে নিয়ে এলে কবি জীবনানন্দ দাশ কোলকাতা থেকে একটা চিঠি লিখেছিলেন নব দম্পতিক্ অভিনন্দন জানিয়ে। সে চিঠি রক্ষিত হয় নি, কারন তখনও অধ্যাপক জীবনানন্দ দাশের ভাগ্যে কবি জীবননান্দ দাশের খ্যাতি জোটে নি।

শেষবার যখন আমার পিতার সঙ্গে আমার দেখা হয়, তখনও জীবনানন্দ প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। নানান কথা হয়েছিল। এক পর্যায়ে দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে বাবা বলেছিলেন, ‘চিনতে পারিনি তখন যে অতো বড় একজন কবি ছিলেন!’ তাঁর কণ্ঠের আক্ষেপ লুকোনো থাকেনি। আমি মনে মনে বলেছিলাম, ‘আমরাও কি কবি তাঁকে পুরোপুরি চিনতে পেরেছি’? ‘বিষন্নতার কবি’, ‘ধূসর কবিতার কবি’, ‘রূপসী বাংলার কবি’, ‘শুদ্ধতম কবি’, কত কথাই তো বলি তাঁর সম্পর্কে, কিন্তু পুরোপুরি কি এখনও ধরতে পেরেছি কবি জীবনানন্দ দাশকে?


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category