• রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:৩৯ অপরাহ্ন

মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম: হিন্দু-মুসলমান

Reporter Name / ৭৬ Time View
Update : শনিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২১

মনিজা রহমান

কুয়ালালামপুরে গিয়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের সহাবস্থান দেখে খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মালয়েশিয়া দিয়ে আমার উড়োজাহাজে করে বিদেশ যাত্রার শুরু। এর আগে শ্যামলী বাসে চেপে বেনাপোল-বনগাঁ হয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম। মালয়েশিয়ান অলিম্পিক এসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে এশীয় দেশগুলির প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে একটা ওয়ার্কশপে অংশ নেই। চীন-জাপান-ইরান-কুয়েত-কাতার-ওমান সব দেশের প্রতিনিধিরা ছিল সেই ওয়ার্কশপে।
সময়টা ছিল ২০০৩ সাল। আমাদের দেখাশুনার জন্য যে মালয়েশিয়ান স্বেচ্ছাসেবকরা ছিল, তাদের দেখে বিস্মিত হতাম। কেউ মালয়, কেউ চীনা, কেউ বা ভারতীয়- কিন্তু সবাই তারা মালয়েশিয়ান। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের সহাবস্থানে গড়ে ওঠে একটি দেশের বৈচিত্র্য। সংখ্যালঘুরা একটা দেশের সৌন্দর্য্য- যেটা আজ থেকে আঠারো বছর আগে- তরুণ বয়সে আমার দৃষ্টিভঙ্গীকে পাল্টে দিয়েছিল।
রাত তিনটায় দেখতাম, নির্জন হাইওয়েতে হিজাব পরিহিত এক মালয় নারী টোল নিচ্ছে। সংক্ষিপ্ত পোষাক পরে চীনা মেয়েরা দল বেধে নাইট ক্লাবে যাচ্ছে। দক্ষিণ ভারতীয়রা একচেটিয়া হোটেল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। একটি দেশে সুশাসন থাকলে চিত্রটা যে এমন হতে পারে সেটা বুঝতে সমস্যা হয়নি। মালয়েশিয়ার প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়ায় না গিয়েও মুগ্ধ হয়েছি ওদের মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী নামের রাষ্ট্রপ্রধানের নাম শুনে।
বাংলাদেশেও এমন একটা সময় ছিল। নাম শুনে বোঝা যেত না, কে কোন ধর্মের। রুমা কিংবা রতন যে কোন ধর্মের কারো নাম হতে পারত! গত কয়েক দশক ধরে ইসলামী নাম রাখার একটা ধারা শুরু হয়েছে, যেন তারা নামের জোরে বেহেস্তে যেতে চায়। অথচ তারা ভাবেনা, এক আল্লাহ পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টি করলে, সব ধর্ম, সব নাম ওনারই সৃষ্টি।

এই বাংলায় চন্ডীদাস কিংবা লালন জন্ম নিলেও ধর্ম নিয়ে মানুষের ভেদাভেদ কমেনি। বাংলাদেশী মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা কেউ অন্য দেশ থেকে আসেনি। তারা এদেশীয় ছিল। ইসলামের আধ্যাত্নবাদে আকৃষ্ঠ হয়ে তারা মুসলমান হয়েছেন। কিন্তু এখন আধ্যাত্নবাদের জায়গায় ঠাঁই করে নিয়েছে ধর্মান্ধতা। ‘যে ধার্মিক সে ধর্মের মর্ম বোঝে, যে ধর্মান্ধ সে কখনও বোঝে না।’ কথাটা আমার না। জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র।

ফেসবুকে উসকানি কিংবা নানা ধরনের পোস্ট থেকে বাংলাদেশের মতো এত ভয়াবহ ঘটনা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটে কিনা আমার জানা নেই। আমেরিকার কোন মানুষকে আমি এখন পর্যন্ত ফেসবুক নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখিনি। বেশীরভাগই হয়ত বছরে দুই-চারটার বেশী পোস্ট দেয় না। অথচ বাংলাদেশে এখন প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ফেসবুক। খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের মতো মানুষের মৌলিক চাহিদা যেন এখন ফেসবুক।
নিউইয়র্কে আমার পরিচিত আমেরিকানদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে আগ্রহ বরাবরই কম দেখেছি। কাজের চাপে তাদের সময় কোথায় এসব নিয়ে আগ্রহ দেখানোর! অথচ বাঙালির সব দু:খ, কষ্ট, ঘৃণা, উদ্বেগ উগলে দেয়ার ভাড়ার এখন ফেসবুক। উসকানিকে কেন্দ্র করে মানবতা লংঘিত হয়। স্বজনহারা হয় পরিবার। বাস্তুচ্যুত হয় মানুষ। বেদনার বোঝা বাড়ে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বেঁচে থাকলে হয়ত এখন বড় গলায় বলতে পারতেন না- মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু মুসলমান কিংবা মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
আগেই বলেছি- একটি দেশের সৌন্দর্য্য হল ‘সংখ্যালঘু’ রা। যেখানে ধর্ম-সংস্কৃতি-জীবন যাপনের বৈচিত্র্য থাকবে। নিউইয়র্ক শহরে আমরা বাঙালিরা যেমন সংখ্যালঘু। এমন আরো বহু দেশের-বহু সংস্কৃতির মানুষ পাশাপাশি থাকে এখানে সম্মানের সঙ্গে। স্কুলে কোন খাবার দাবারের প্রোগাম থাকলে দেখেছি, প্রিন্সিপাল আমাদের কয়েকজন সংখ্যালঘুর জন্য ‘হালাল’ খাবারের বন্দোবস্ত করতে অস্থির হয়ে যান। অথচ আমরা অনেকেই আছি যাদের খাওয়া নিয়ে বাছবিচার নেই।
স্কুলগুলোতে মাল্টি কালচার ডে পালিত হয়। সবাই নিজ সংস্কৃতির পোষাক পরে যায়। ক্রিসমাসের সময় কয়েকদিন সংখ্যাগুরু খ্রিষ্টানরা ছুটি নিলেও কোন সমস্যা হয় না। অন্য ধর্মের লোক আছে। প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসবের সময় ছুটি উপভোগ করে। নির্ভয় চিত্তে ধর্ম পালন করে।
মনে পড়ে, স্কুলজীবনে স্টিমারে করে যখন কাউখালিতে আমার নানাবাড়ি যেতাম, খুব ভালো ভালো লাগত। আমার বড় খালার বাসা ছিল বাজারের ওপর। সন্ধ্যাবেলা একদিকে মসজিদে আজান হত, অন্যদিকে উলুধ্বনি দেয়া হত। বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে দেখেছি হিন্দু প্রতিবেশীরা অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে।
একজন মানুষের সবচেয়ে প্রিয় স্থান তার জন্মভূমি, তার বাপ দাদার ভিটে। আজীবন স্বপ্ন-কল্পনায় জেগে থাকে যে বাসভূম। যারা ধর্মীয় জোশে অন্যের বাড়িতে আগুন দেয়, বাস্তুচ্যুত করে কিংবা মন্দিরে হামলা চালায়, তারা অধমের চেয়েও অধম, পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ঠতম গালিটি তাদের জন্য কম হয়ে যায়।
মনিজা রহমান
১৯ অক্টোবর, ২০২১


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category