নব্বই দশকের শুরুর সময় থেকে প্রায় একযুগ সময়কালীন নিউইয়র্ক এর থিয়েটার গ্রুপ গুলোর নাট্য আন্দোলন বা নাটক মন্চায়নের একটা স্বর্ণযুগ ছিলো।১৯৯২ সাল থেকে প্রায় ২০০৪ পর্যন্ত প্রায় এই একযুগ সময়কালীন নিউইয়র্ক এর ৪টি গ্রুপ তাদের নিজস্ব প্রযোজনা গুলো নিয়মিত মন্চায়ন করতো নিউইয়র্ক এর মন্চ গুলোতে।মাসের পর মাস রিহার্সেল করে বছরে দুটি করে কিংবা কখনো কখনো তারও অধিক নতুন নতুন নাটক মন্চায়ন করতে দেখা যেতো নাট্য সংগঠন গুলোকে।সেই সময় মুলত নিউইয়র্ক এর নাটকের সংগঠন গুলোই ডমিনেট করতো নিউইয়র্ক এর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড।
প্রথম দিকে বাংলাদেশ থিয়েটার অব আমেরিকা, ড্রামা সার্কল, নিউইয়র্ক বাংলাদেশ থিয়েটার প্রতি বছরই নিয়মিত নাটক মন্চায়ন করতো, কয়েক বছর পর সেই স্রোতে যুক্ত হয় ঢাকা ড্রামা, ততদিনে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ থিয়েটারের কার্যক্রমও অবশ্য একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।
থিয়েটার অব আমেরিকা যারা নেতৃত্ব দিতেন বা নিয়মিত নাটক করতেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সউদ চৌধুরী, ঝর্না চৌধুরী, ফজলুল কবীর, স্বপ্না কাওসার, ডা: ফারুক আজম, লিটন বাবু, চন্চল, শামীম মামুন লিটন, নাজরা চৌধুরী, শ্যামা হাই, শিপলু, শাহীন তরফদার সহ আরো অনেকেই।
ড্রামা সার্কেল এর যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নার্গিস আহমেদ, রিপা আহমেদ, মুজিব বিন হক, জহির মাহমুদ, আর্থার আজাদ, মিল্টন আহমেদ, আফরোজা কামাল গীতি, লিটন খান, আদেল, ফেরদৌস খান, পলাশ পিপলু, বিপ্লব, মেসি মোস্তাক এবং আমি (আবীর আলমগীর) সহ আরো অনেকেই।
নিউইয়র্ক বাংলাদেশ থিয়েটারের নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার জহিরুল ইসলাম, সেলিম ভাই, তাজ ভাই, জাফর ভাই (ওনাদের অনেকেরই পুরো নাম এখন আর মনে নেই) এবং সারোয়ার হারুন বাংলাদেশ থেকে এসে কিছুদিন ওনাদের সংগে থাকলেও পরবর্তীতে টিটু গাজীকে নিয়ে তৈরী করেন ঢাকা ড্রামা।এখানে উল্লেখ্য যে একমাত্র ঢাকা ড্রামা’ই এখন পর্যন্ত তাদের নতুন নতুন নাটক নিয়মিত মন্চায়ন করে যাচ্ছেন এবং প্রতি বছর বিশ্ব নাট্য দিবসটিও তাদের নেতৃত্বেই নিউইয়র্কে পালিত হয়ে আসছে, যেখানে বিভিন্ন নাট্য সংগঠনও অংশগ্রহন করে তাদের সেই আয়োজনে।
মুলত ১৯৯০ সালের দিকে নিউইয়র্কে নাট্য আন্দোলন বা নাটক নিয়ে কাজ শুরু হয় মরহুম আল মুক্তাদিরের মাধ্যমে।তার সংগে ছিলেন ঝর্ণা চৌধুরী, রাব্বী মোহাম্মদ খোকন, তাজ ভাই এবং আরও অনেকেই।মরহুম আল মুক্তাদির এর লেখা নাটক ঢাকা যাই মন্চায়ন হয় ১৯৯০ সালে।নাটকটি মন্চায়ন হয় বাংলাদেশ সোসাইটি’র অনুষ্ঠানে।যদিও মরহুম আল মুক্তাদির নাটকটির মন্চায়ন দেখে যেতে পারেন নি।তিনি সকল রিহার্সেল সহ সব প্রস্তুতির নিজ হাতে সম্পন্ন করলেও নাটকটি মন্চায়নের আগেই মৃত্যুবরন করেন।সেই সময় মরহুম আল মুক্তাদির সাহেব কে মন্চায়ন প্রস্তুতির সব ধরনের সহযোগীতা করেছিলেন লিটন ভাই এবং শিপলু ভাই।
পরবর্তিতে সদ্য ঢাকা থেকে আসা রঙ্গনা নাট্য গোষ্ঠির জহির মাহমুদের নির্দেশনায় ১৯৯১ সালে কালের সাক্ষী নাটকটিও মন্চায়ন হয় বাংলাদেশ সোসাইটির ব্যানারে।
তখন নাটক কিংবা অন্যান্ন সকল অনুষ্ঠান গুলি হতো এস্টোরিয়ার লং আইল্যান্ড সিটি হাইস্কুলের পুরনো ভবনটির মিলনায়তনে অথবা জ্যামাইকার টমাস এডিশন স্কুলের মন্চে।
পরবর্তিতে নাট্য সংগঠন গুলি তৈরী হলে সবগুলো নাট্যসংগঠন তাদের বেশীর ভাগ নাটকই মন্চায়ন করতো জ্যামাইকার পিএস 86 কিংবা এস্টোরিয়ার পিএস 17 এর মন্চে। আমরা সেই সময়ের নাট্য কর্মীরা এই দুটি মন্চকে মনে মনে বেইলী রোড়ের মহিলা সমিতি মন্চ মনে করেই নাটক করতাম এবং পুলকিত হতাম।
নব্বই দশকের শুরুতে ঝর্না চৌধুরী’র নেতৃত্বেই প্রথমে বাংলাদেশ থিয়েটার অব আমেরিকা নাট্য সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে।তার সংগে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন মুজিব বিন হক, সউদ চৌধুরী, নার্গিস আহমেদ, রিপা আহমেদ, খন্দকার জহিরুল ইসলাম, তাজ ভাই এবং আরো অনেকে।সেই সময় বাংলাদেশের বিশাল কাস্টিং এর বহুল জনপ্রিয় নাটক মুনতাসীর ফ্যান্টাসী এবং বেয়াদবি মাফ করবেন নাটক দুটিও মন্চায়ন হয় নিউইয়র্কে।মুনতাসীর ফ্যান্টাসী পরিচালনা করেন আজিজুস সামাদ ডন এবং বেয়াদবি মাফ করবেন পরিচালনা করেন জহির মাহমুদ।
একটা সময় কিছুটা সাংগাঠনিক মতানৈক্যর কারনে ভেংগে যায় সংগঠনটি।নার্গিস আহমেদ, রিপা আহমেদ, মুজিব বিন হক, জহির মাহমুদ মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ড্রামা সার্কল এবং সেলিম ভাই ও তাজ ভাইকে নিয়ে খন্দকার জহিরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন নিউইয়র্ক বাংলাদেশ থিয়েটার।
বাংলাদেশের বেশ ক’জন বিশিষ্ট নাট্যজন বাংলাদেশ থিয়েটার অব আমেরিকার বেশ ক’টি নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন, তাদের মধ্যে এস এম সোলায়মান, তারিক আনান খান এবং তৌকির আহমেদ উল্লেখযোগ্য।নাট্যজন এস এম সোলায়মান মাসের পর মাস নিউইয়র্কে থেকে তার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো মন্চায়ন করিয়েছেন বাংলাদেশ থিয়েটার অব আমেরিকার প্রযোজনায়।
আমার সংগঠন ড্রামা সার্কল এর বেশীরভাগ নাটক মুলত নির্দেশনা দিয়েছেন মুজিব বিন হক এবং জহির মাহমুদ।এছাড়াও বিশিষ্ট নাট্যজন সালেক খান নির্দেশনা দিয়েছেন হেনরিক ইবসেনের ডলস হাউস নাটকের বাংলা রুপান্তর “না” নাটকটি এবং বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যজন জামাল উদ্দিন হোসেন নির্দেশনা দিয়েছেন জে-বি প্রিস্টলির এন ইন্সপেক্টর কলস নাটকের বাংলা রুপান্তর নিংশব্দ ঘুনপোকা এবং মুনির চৌধুরীর জমা খরচ ইজা।ড্রামা সার্কল সেই সময়ের একযুগে প্রায় ২৩টি পুর্নাংগ নাটক মন্চায়ন করেছে নিউইয়র্ক সহ উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহরের মন্চে।
নব্বই দশকের শেষের দিকে নিউইয়র্কের বাংলা নাট্য আন্দোলনে দুটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা মনে আছে, একটি হলো বাংলাদেশ থিয়েটার অব আমেরিকার মুল ধারার মন্চে বাংলা নাটকের মন্চায়ন।
অফ অফ ব্রডওয়ের মন্চে প্রথম বাংলা নাটকের মন্চায়ন শুরু করে তারা, কয়েকটি প্রযোজনাও করে তারা অফ অফ ব্রডওয়ের মন্চে।এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা রাখে বাংলাদেশ থিয়েটার অব আমেরিকার ফজলুল কবির।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯৯৯ সালে অফ অফ ব্রডওয়ের মন্চে সৈয়দ শামসুল হক এর নুরল দিনের সারাজীবন নাটকটির একটানা দুই সপ্তাহের মন্চায়ন।ওপার বাংলার বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব সুদীপ্ত চট্রোপাধ্যায় তখন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে নাট্যকলা বিভাগে অধ্যাপনা করতেন, একই সাথে তিনি নিউইয়র্ক নিউজার্সীর নাটকের সংগঠন এপিক এ্যাকটর্স এর সাথেও যুক্ত ছিলেন।তার সেই সংগঠনের ব্যানারে তিনি নুরল দীনের সারাজীবন নাটকটি অফ অফ ব্রডওয়েতে মন্চায়ন করবার প্ল্যান করেন।তিনি নিউইয়র্ক এর সকল বাংলাদেশী নাট্য সংগঠন গুলোর সহযোগীতা চান, আমরা প্রায় সব সংগঠন থেকেই তার আহবানে সারা দেই এবং অভিনয় করি সেই নাটকে।তখন নাট্যাভিনেতা খালেদ খান এর ছোটো ভাই নাট্যাভিনেতা শাহীন খানও নিউইয়র্কে থাকতেন, সুদীপ্ত চট্রোপাধ্যায় আমাদের সকলকে নিয়ে এবং তার নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ৫জন এদেশীয় ছাত্র সহ বিশাল একটি দল নিয়ে অফ অফ ব্রডওয়ের মন্চে দুই সপ্তাহ টানা নাটকটি মন্চায়ন করেন।তাকে সহযোগীতা করবার জন্য কোলকাতা থেকে আসেন তার বন্ধু নাট্য নির্দেশক চন্দন সেন।চন্দন দা তখন কয়েকমাস নিউইয়র্কে থেকে সুদীপ্ত দা’কে সহযোগীতা করেন নাটক টি মন্চায়নের জন্য।
নাটকটি মল্চায়নের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি হলো সৈয়দ শামসুল হক এর উপস্থিতি।নাটকটি মন্চায়ন কালীন তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তিনি সাদরে আমন্ত্রণ গ্রহন করেন এবং বাংলাদেশ থেকে আসেন।পরপর তিনদিন তিনি দর্শক সারিতে বসে তার নিজের লেখা এই নাটকটির মন্চায়ন মন্ত্রমুগ্ধের মত উপভোগ করেন, যা ছিলো আমাদের সকল নাট্য কর্মীদের জন্য দারুন এক অভিজ্ঞতা এবং ভাললাগা ও মনে রাখার মতো স্মৃতি।
ঐ সময় সপ্তাহে চারদিন করে টানা চার মাস আমরা নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির নাট্যকলা বিভাগের রিহার্সেল রুমে রিহার্সেল করেছি।নাটকটিতে আমাদের সাথে বৃটিশ সাহেব দের চরিত্র গুলো করেছিলো নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির এদেশীয় সাদা চামড়ার বেশ কয়েকজন ছাত্র।সে সময়ে ঐ নাটকটির প্রযোজনাটি ছিলো নিউইয়র্কে বাংলা নাটক মন্চায়নের ইতিহাসে একটি অসাধারন সম্মিলিত প্রযোজনা।প্রতিদিন রিহার্সেলের আগে চন্দন দা এবং সুদীপ্ত দা আমাদের নাটকের নাটকের স্কুলিং করাতেন, নাটকের সকল খুঁটিনাটি বিষয়ে শিখিয়েছেন তারা আমাদের, যা ছিলো আমাদের জন্য দারুন সব অভিজ্ঞতা।
বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতির উত্থান এবং বিভিন্ন কারনে মন্চে নাট্য কর্মীর সংকট রয়েছে, আর তাই নিউইয়র্ক এর বড় দুটি নাট্য সংগঠন থিয়েটার অব আমেরিকা এবং ড্রামা সার্কল নাট্যকর্মী সংকটের কারনে নতুন কোনো বড় প্রযোজনা কন্টিনিউ না করতে পারলেও দেখা গেছে ঢাকা ড্রামা সহ প্রতি বছরই বর্তমান সময়ের বেশ কিছু নাটকের দল মাঝে মাঝেই নাটক মন্চায়ন করছেন।তাদের মধ্যে বাংলা নাট্যদল, লং আইল্যান্ডের শিল্পাংগন এবং অবশ্যই বিশিষ্ট নাট্যজন জামাল উদ্দিন হোসেনের নাগরিক অ্যানসাম্বল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।এ ছাড়াও মিথুন আহমেদ ও সীতেশ ধর এর উদ্যোগেও নাটকের মন্চায়ন হয়েছে নিউইয়র্ক এর মন্চে।
আরও অনেক তথ্য দিয়ে লেখাটি হয়তো বড় করে লেখা যেতো, আমি লেখাটি খুব বেশী বড় করতে চাইনি বিধায়, আঠারো কিংবা পঁচিশ বছর আগের সামান্য কিছু স্মৃতি থেকেই লেখাটি লেখার চেষ্টা করেছি।তখন বয়সে তরুন ছিলাম, তখনকার অনেক স্মৃতিই এখন হয়তো খুব একটা মনেও নেই, তারপরও চেষ্টা করেছি স্মৃতি হাতড়ে সামান্য কিছু লিখবার।লেখায় কারও নাম বাদ পড়লে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং মার্জনা করবেন আশাকরি।
নিউইয়র্কে বাংলা নাটকের মন্চায়ন আরও এগিয়ে যাক এই প্রত্যাশা করছি।